আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবেগ চেপে অপেক্ষায় মুম্বাই!

যেখানে দাঁড়িয়ে নেট বোলারদের তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার আবদার মেটাচ্ছেন শচীন টেন্ডুলকার, সেখান থেকে মুখ তুললেই দেখতে পাচ্ছিলেন স্টেডিয়ামের একটা অংশ ফুলের মালায় শোভিত। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ক্রিকেট মহানায়কের বিদায়ী টেস্ট ম্যাচ, ফুল-টুল তো থাকবেই।

যে লিফটটি আপনাকে ওয়াং-খেড়ে স্টেডিয়ামের ফুলশোভিত ওই অংশটায় নিয়ে যাবে, সেটির প্রবেশদ্বারও এমন ফুলে ফুলে সজ্জিত, যা দেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি দলের মিডিয়া ম্যানেজারকে বলবেন, ‘কী সুন্দর! ক্রিসমাসে আমরাও ঠিক এভাবে সাজাই, তাই না?’

লিফটে ‘থ্রি’ চাপলে যেখানে সেটির দুয়ার খুলবে, সেখানে যেন ফুলের বাগান। ছাদ থেকে দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছে বাহারি ফুলের মালা, যা দেখে ড্যারেন স্যামির মনে সিরিজ শুরু থেকে যে অনুভূতিটা কাজ করছে, সেটি আবার ফিরে আসবে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখানে নিমিত্ত মাত্র। পরদিন থেকে শুরু হতে যাওয়া টেস্ট ম্যাচটাও এমন কিছু নয়। এই সিরিজের একটাই মন্ত্র —‘সবার উপরে শচীন টেন্ডুলকার সত্য, তাহার উপরে নাই। ’

মুম্বাইয়ে তাঁর ২০০তম, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচের আগে ওই সত্যটার আরও বড় সত্য হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক এটাই যে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ওই ফুলসজ্জা শচীন টেন্ডুলকারের জন্য নয়!


ড্যারেন স্যামি পরে হয়তো জেনেছেন অথবা আদৌ জানেননি, সংবাদ সম্মেলনে যাওয়া-আসার পথে যে ফুলসজ্জা দেখলেন, তা আসলে অন্য একজনের প্রতি উৎসর্গকৃত।

পরিচিতজনেরা যাঁর ক্রিকেটপ্রেম সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। তবে ক্রিকেট-বিশ্ব তাঁর নাম শুনতে পেত শুধু একটা সময়ই—পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ভারত সফরে আসার সম্ভাবনা দেখা দিলে। পাকিস্তানের সফর ভন্ডুল করার জন্য যাঁর সৈন্যসামন্তরা পিচ খুঁড়ে ফেলার মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটিয়েছে। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, ওই ফুল-টুল সব প্রয়াত শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরের জন্য!

ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের নাম এখন ‘বাল ঠাকরে প্রেসবক্স। ’ কাল সন্ধ্যায় সেটির সাড়ম্বর উদ্বোধন হলো।

যেটিকে উপলক্ষ করে ওই ফুলসজ্জা। টেন্ডুলকারের শেষ টেস্ট ম্যাচের আগে বাল ঠাকরেকে নিয়ে এত শব্দ খরচ করে ফেলায় আপনি বিস্মিত হতে পারেন, হয়তো বিরক্তও। কিন্তু এই টেস্টের আগের দিন ওয়াংখেড়েতে প্রায় সারা দিন কাটিয়ে এই প্রতিবেদক যাতে সবচেয়ে বিস্মিত, সেটি পাঠকদের জানানো কর্তব্য বলেই মনে হলো।


ওয়াংখেড়েতে শচীন টেন্ডুলকার যে একেবারেই নেই, তা নয়। বছর সাত-আট ধরেই গ্যালারির একটা অংশের নাম শচীন টেন্ডুলকার স্ট্যান্ড।

এই মহালগ্নে যোগ হচ্ছে নতুন কিছুও। প্যাভিলিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে বাঁ দিকে তাকিয়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ ঘুরিয়ে আনলে প্রায় দুই যুগের টেন্ডুলকার মূর্ত হয়ে উঠবেন চোখের সামনে। ১ থেকে ৫১—স্কোর, ভেন্যু এবং সালসমেত তাঁর সব কটি টেস্ট সেঞ্চুরি শোভা পাচ্ছে সেখানে। তবে সেখানেও যে সমস্যা নেই, তা নয়। টেন্ডুলকারকে খুঁজতে হবে বিরাট কোহলির বিরাট বিরাট সব ছবির ফাঁকে ফাঁকে।

কোহলি সেখানে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির গুণগান গাইছেন। সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনার পর অন্তত এই টেস্টে বাণিজ্যকে অগ্রাধিকারের তালিকায় দুই নম্বরে রাখা হবে কি না, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে (এমসিএ) তর্ক চলছিল।

বাল ঠাকরের জন্য ওই ফুলসজ্জা নিয়ে বিস্ময়ের কথা বলছিলাম। বিস্ময়ের তালিকায় সেটি দুই নম্বরে। এক নম্বরে টেন্ডুলকারের বিদায় নিয়ে আমজনতার নিস্পৃহতা।

নিয়ম অনুযায়ী এমসিএর অধিভুক্ত ক্লাব, স্পনসর, গণ্যমান্য লোকদের টিকিট দেওয়ার পর আমজনতার ভাগে পড়েছে হাজার পাঁচেক টিকিট। টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি তাই একটুও বিস্ময়কর নয়। বিস্ময়কর হলো, গত দুই দিন মুম্বাইয়ের ব্যস্ততম আড্ডায়, হোটেলে, নামী রেস্তোরাঁয় আবেগের সেই প্রত্যাশিত বিস্ফোরণ দেখতে না-পাওয়া। গত পরশু বিমানবন্দর থেকে শহরে আসার পথে বরং মনে হলো, এটি বোধ হয় মহেন্দ্র সিং ধোনির বিদায়ী টেস্ট! ধোনি আর ধোনি—রাস্তার দুই পাশে স্টার স্পোর্টসের বিজ্ঞাপনে ধোনির মুখ। টেন্ডুলকারের সম্মানে গত পরশু হয়ে যাওয়া ইন্ডিয়া টুডে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের একটা বড় হোর্ডিং ছাড়া আর কোথাও টেন্ডুলকার নেই।


মুম্বাইয়ের সাংবাদিকের ব্যাখ্যা, এটাই মুম্বাই, আবেগ-টাবেগ পাশের আরব সাগরে ছুড়ে ফেলে এখানে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ৩২ হাজার ধারণক্ষমতার ওয়াংখেড়ে প্রতিদিন দর্শকে ঠাসা থাকবে—এটাও নাকি সংশয়াতীত নয়। তবে ওয়াংখেড়েতে টেন্ডুলকারের শেষ প্র্যাকটিস সেশনে আবেগের প্রদর্শনী যথেষ্টই হলো। সেটির মূলে অবশ্য সাংবাদিকেরা। বোলারদের সঙ্গে ছবি তোলার পর সাংবাদিকদের সঙ্গেও একটা ফটোসেশন হলো।

সেখানে বাকি সবাই দাঁড়িয়ে বা বসে, টেন্ডুলকারের পাশে চেয়ারে বসার অধিকার পেলেন মাত্র তিনজন। আনন্দবাজার পত্রিকার গৌতম ভট্টাচার্য, আজকাল-এর দেবাশিস দত্ত এবং দ্য হিন্দুর দীর্ঘদিনের ক্রিকেট প্রতিনিধি ও এখন দক্ষিণের অখ্যাত এক পত্রিকায় কর্মরত রামস্বামী মোহন। কাল ওয়াংখেড়েতে সমবেত সাংবাদিককুলের মধ্যে শুধু এই তিনজনই যে কাভার করেছেন টেন্ডুলকারের অভিষেক টেস্ট।


ছবি তোলা শেষ হওয়ার পর টেন্ডুলকারের কাছে যাওয়ার জন্য সাংবাদিকদের মধ্যেও হুড়োহুড়ি। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সেখান থেকে তাঁকে বের করে নিয়ে যাওয়াই মুশকিল।

টেন্ডুলকারকে কিন্তু একটুও বিচলিত দেখাল না। বরং তিনি স্মিত হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। তাঁর কাছে তো আর এটি নতুন কিছু নয়। ‘নতুন’ বলতে এখানে আমজনতার বদলে পেশাদার সাংবাদিক। তা পেশাদার সাংবাদিকদেরও তো কখনো কখনো আবেগ ছুঁয়ে যায়।

শচীন টেন্ডুলকার তো আর শুধুই একজন ক্রিকেটার ছিলেন না। ছিলেন এক আবেগের নাম। এত দিন সবাইকে আবেগে ভাসিয়েছেন, এখন হয়তো নিজেই তাতে আক্রান্ত। বাইরে যতই নিষ্কম্প দেখাক, ক্রিকেটের সঙ্গে দুই যুগের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলার ম্যাচে তাঁকেও আবেগ না ছুঁয়ে গিয়ে পারেই না। বেস্ট-শিলিংফোর্ডকে বল করতে দেখবেন ঠিকই, কিন্তু টেন্ডুলকার এখানে সবচেয়ে বড় যে ‘বোলার’কে খেলবেন, তার নামও ‘আবেগ’।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.