জনতার প্রচন্ড ভীড় থেকে অস্থির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে, বেশিরভাগই হতাশামাখা। কি যে হয়ে গেলো এতো দ্রুত অনেকেই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলোনা।
একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে তারা বলছে, ''হায়! তিনি কোথায় চলে গেলেন''
একজন বলছে, ''আমি ঘোর পাপী, তাই ঈশ্বর আমাকে দেখা না দিয়েই চলে গেলেন''
ভীড় ঠেলে বের হয়ে এসে কেউ একজন সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ''এই ভর দুপুরে ঈশ্বর কোথায় যেতে পারেন বলে মনে হয়?''
কেউ একজন নিজের হিউমার দেখাতে বললো, ''মনে হয় ঈশ্বর স্বর্গে ফিরে গেছেন?''
সমবেত জনতার মাঝে দু:খ নেমে আসলো, ঈশ্বর দর্শন না হবার ব্যথা এবং ঈশ্বরের কাছে বর না চাইতে পারার হতাশা তখন মানুষের চোখে-মুখে। ঈশ্বর, তুমি কোথায়?
এদিকে বাজার থেকে বেশ দূরে জলাভূমির পাশে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে একটি মানুষ। বস্ত্রহীন, আহত, মাথার উস্কো-খুস্কো অবস্থা, অনেক জায়গায় চুল নেই, বেশ রক্তারক্তি অবস্থা।
ভয় যেনো তাকে জড়বস্তুতে পরিণত করেছে। জীবন সত্যিই একটি উঁচু-নিচু অধ্যায়, ভীড় থেকে যখন লোকজন টানাটানি করছিলো, মৃত্যুভয় বেশ ভালোভাবেই অনুভব করেছিল মানুষটি।
''আমি ঈশ্বর নই, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাদের এলাকারই একজন''-বলে কতবার যে জনতাকে ফেরানোর চেষ্টা করেছে লোকটি তার হিসেব নেই।
কিন্তু কে শুনে কার কথা, জনতাকে মদ্যপান থেকে দূরে রাখা সম্ভব, সুন্দরী নারীর সংস্পর্শ থেকে দূরে পাঠানো সম্ভব। কিন্তু ঈশ্বর ভক্তি থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া- সে অসম্ভব।
নিজেকে কিভাবে জনতা থেকে দূরে নিরাপদে রাখবেন এ ইস্যুতে খোদ ঈশ্বরও হয়তো এখনো কোন সমাধানে আসতে পারেননি।
বেলা প্রায় বারোটা, দুপুর হয়ে এলো। সূর্যের আলো যখন মাথার ঠিক উপরে, তখন হেলতেদুলতে লোকটি তার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। গতরাতে ড্রিংক যথেষ্টই বেশি হয়েছে, দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা যাচ্ছেনা, শরীর যেনো নড়ছেই না। শরীরের ওজন একরাতেই অনেক বেড়ে গেছে বলে মনে হলো।
রাস্তার মোড়ের গ্রোসারিতে ঢুকে চিনির বড় বাক্সটা থেকে একটা ছোট প্যাকেটে চিনি নিল লোকটি, বাসায় দুধ-চা পাতা আছে। বেশ একটা চা বানিয়ে খেতে হবে, এরপর পত্রিকা নিয়ে বসতে হবে। উইকেন্ডে পুরো একবেলা রাজ্যের সব পত্রিকা পড়েই কাটিয়ে দিতে হয়।
কাউন্টারে এসে দাম দেয়ার জন্য মানিব্যাগ হাতে নিতেই দেখা গেলো শুন্য মানিব্যাগ-ঠিক যেনো গড়ের মাঠ। মনটা উদাস হয়ে গেলো, টাকা কোথায় গেলো? এরই মাঝে মনে পড়লো গতরাতে মদ কেনার সময় ক্যাশ যা ছিলো সবই দেয়া হয়ে গেছে।
এমন সময় দোকানি জিজ্ঞেস করলো, 'কি হলো ভাই?'
মানিব্যাগের দিকে তাকিয়ে থেকে লোকটি বললো, ''ঈশ্বর জানে কোথায় আমি টাকাগুলো হারালাম, এতগুলো টাকা ছিল, কোথায় সেগুলো হাওয়া হয়ে গেলো?''
-কোন সমস্যা নাই, টাকা আপনি পরে একসময় এসে দিয়ে গেলেই হবে
-না, তা ঠিকাছে, কিন্তু এত্তগুলো টাকা
-আরে ভাই, চিন্তার কোন কারণ নেই, সামান্য একটু চিনিই তো। টাকা কাল দিলেই হবে।
চিনি নিয়ে লোকটি দোকান থেকে বের হয়ে আসলো, বের হয়ে আসার আগে দোকানিকে মনভুলানো একটা আশীর্বাদ করে আসতে ভুললোনা সে। ''ঈশ্বর মহান! তিনি যেনো আপনার সমস্ত চিনিকে স্বর্ণ বানিয়ে দেয়''
এরই মাঝে দোকানে কাজ করা ছোকরা জোরে বলে উঠলো, ''দেখেন, চিনির বাক্স স্বর্ণ হয়ে গেছে''
দোকানি তা চেক করে এসে উপস্থিত সব খদ্দেরের সামনে বললো, ''ঈশ্বর, তিনি সত্যিই ঈশ্বর''
দোকানের সব লোক বের হয়ে আসলো, সবাই ঈশ্বর, ঈশ্বর বলে চেচামেচি শুরু করে দিলো। আশেপাশের সমস্ত দোকান থেকে, ফুটপাত থেকে, বাড়িঘর থেকে সব লোক এসে ঈশ্বরকে রাস্তার মোড়ে ঘিরে ফেললো।
লোকজনের হই-হুল্লোড়ে কিছুই শুনার মতো অবস্থা নেই। কে কার আগে ঈশ্বরের কাছে পৌছাবে, কে ঈশ্বরের কাছে আগে বর চাইবে তা নিয়ে মারামারি শুরু হলো। বহু মানুষ আহত হলো, মানুষের পায়ের নিচে মানুষ, রক্তারক্তি অবস্থা। এ ওকে ধাক্কা দিচ্ছে, এ ওকে খামচি দিয়ে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর এদিকে বেচারা ঈশ্বর, স্বর্গ থেকে দলবলহীন একলা পথে নেমে এসেছিলেন, জনতার ঠেলাঠেলি, টানাটানি, খামচিতে আহতপ্রায়।
এই যখন অবস্থা, তখন ভীড় এর এক ফাঁক গলে লোকটি বের হয়ে ভো-দৌড় দিলো। এরপর জনতার সামনে তাকে আর দেখা যায়নি।
ঈশ্বর অদৃশ্য হয়েছে প্রায় মিনিট বিশেক হয়েছে এমন সময় একটি পুলিশ ভ্যান এসে থামলো। পুলিশের কর্তা ভুঁড়িতে তা দিতে দিতে গাড়ি থেকে নেমে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো, ''ঈশ্বর কোথায়?''
রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের নিচে বসে থাকা গৃহহীন পাগলটি বললো, ''ঈশ্বরতো একটু আগে নিজের প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিলো’’
-----------------------------------------------
শব্দ পথিক
নভেম্বর ১৪, ২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।