রাজনীতিতে তাঁদের অবস্থান দুই মেরুতে। নিজেদের মধ্যে আছে কয়েক দশকের অবিশ্বাস। কিন্তু দেশ দুটির বর্তমান দুই সরকারপ্রধানের মধ্যে আছে একটি মিল। নিজ দেশে তাঁদের সমালোচক ও বিরোধীর অভাব নেই; বিশেষ করে আলোচ্য দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে।
হ্যাঁ, বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আর ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কথা।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার বিষয়ে তাঁরা দুজনই আছেন নিজ নিজ দেশের ‘যুদ্ধবাজ’ নেতাদের চাপের মধ্যে। সমঝোতা বা চুক্তি যে রকমই হোক, উভয় পক্ষের সমালোচকেরা ‘গেল গেল’ রব তুলবেন।
ইরানের গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হাসান রুহানি মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত। তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা নিরসন করা। এই অঙ্গীকারের বাস্তবায়নে তিনি পাশ্চাত্যের সঙ্গে আলোচনায় আন্তরিক আগ্রহ দেখান।
এই প্রেক্ষাপটেই চলমান সংলাপ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় জেনেভায় ৭ থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত পি ৫+১ ও ইরানের কূটনীতিকদের আলোচনা হয়। পি ৫+১ হচ্ছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দেশটির সঙ্গে আলোচনার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীনের সঙ্গে বাড়তি হিসেবে জার্মানিকে নিয়ে গঠিত জোট।
সদ্যসমাপ্ত জেনেভা আলোচনায় কোনো চূড়ান্ত সমঝোতা না হলেও মনে করা হচ্ছে, সে লক্ষ্যে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। পরবর্তী আলোচনার জন্য ২০ নভেম্বর তারিখ ঠিক করা হয়, যা অবশ্যই অগ্রগতির লক্ষণ; বিশেষ করে কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কথাবার্তা এবং মুখ দেখাদেখি কার্যত বন্ধ থাকার পর জেনেভায় তিন দিনের বৈঠকে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেশ কয়েক ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা করাই একটি বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
জেনেভায় আলোচনা শেষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি প্রধান ক্যাথরিন অ্যাশটন বলেছেন, আলোচনায় ‘যথেষ্ট অগ্রগতি’ হয়েছে, তবে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
আলোচনায় পাশ্চাত্যের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন অ্যাশটনই।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ বলেছেন, আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান নতুন কিছু করতে পারে। তিনি আলোচনার ফলাফলে অখুশি নন।
তবে, গত রোববার পর্যন্ত চলা তিন দিনের আলোচনা (হওয়ার কথা ছিল দুই দিন) ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সংলাপ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি আলোচনা শেষে মন্তব্য করেন, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সমঝোতার অনেক কাছাকাছি আসা গেছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার তিনি বিবিসিকে বলেছেন, জেনেভা আলোচনায় উভয় পক্ষ মতৈক্যের ‘খুব কাছাকাছি’ চলে এসেছিল।
জেনেভা আলোচনার আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের আলোচকেরা কাজ করার জন্য সময় ও রাজনৈতিক সুযোগ কমই পেয়েছিলেন। এটি আলোচনায় কোনো সমঝোতা না হওয়ার কারণ হতে পারে।
মুশকিল হচ্ছে, ওয়াশিংটনে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেক রাজনীতিক আলোচনার এই উদ্যোগকে ইরানের চাল বলে মনে করেন। একই ধরনের মত পোষণ করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
তিনি চান, ইরানের ‘প্রলোভনে’ না ভুলে ওয়াশিংটন দেশটির ওপর আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করুক।
অন্যদিকে ইরানের নির্বাচনে হাসান রুহানির সাফল্য কিছুটা হলেও মুখ বন্ধ করেছে তেহরানের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক রক্ষণশীলদের। তাই অপছন্দ হলেও পাশ্চাত্যের সঙ্গে রুহানির আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে তাঁরা মোটের ওপর নীরব আছেন।
পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সুজান ম্যালোনি বলেন, পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনাকে জটিল করে তুলতে পারে—এমন রাজনৈতিক কারণ দুই দেশেই যথেষ্ট পরিমাণে আছে।
কোনো ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই তেহরানকে অস্ত্রমুখী পরমাণু কর্মসূচি থেকে দূরে রাখতে পারলে তা হবে ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির একটি মাইলফলক।
যুক্তরাষ্ট্রের যে সিনেট সদস্যরা ইরানের ওপর আরোপিত থাকা নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করার পক্ষে, তাঁদের ভয় হচ্ছে, কট্টরপন্থীদের চাপে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে রুহানির শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নস্যাৎ হতে পারে। সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান প্রভাবশালী ডেমোক্রেটিক সিনেটর রবার্ট মেনেনডেজ এবং তাঁর রিপাবলিকান সহকর্মী ম্যাক ক্রিক যুক্তি দিয়ে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার কায়দা হিসেবেই ইরান আলোচনার টেবিলে এসেছে। তাঁদের ভাষায়, ইরানের ওপর আরও ‘কড়া ওষুধ’ (নিষেধাজ্ঞা) প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
কংগ্রেসকে দিয়ে ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির তেল খাতের শ্বাসরোধ করা এক বিষয়, আর জেনেভা বৈঠকে অংশ নেওয়া আলোচকদের বিভক্তি দূর করা ভিন্ন বিষয়। পরেরটিই আসল চ্যালেঞ্জ।
ওবামার হাতে ইরানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন করার ক্ষমতা আছে। তবে বড় সিদ্ধান্ত নিতে আইনপ্রণেতাদের সহায়তাও তাঁর প্রয়োজন হবে। কিন্তু বিশেষ করে সিরিয়া সংকটে তাঁর ভূমিকার কারণে কংগ্রেসে ওবামার প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ইরানের ব্যাপারে আদর্শ না হলেও এর কাছাকাছি একটি চুক্তিতে সম্মত হতে হবে ওবামাকে। এই চুক্তিতে ইরান কোনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে না, এই নিশ্চয়তা থাকবে।
কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ছাড় পাবে। দেশের আইনপ্রণেতাদের এই ছাড়ে সম্মত করতে পারলেই শুধু ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসা সম্ভব।
এদিকে সম্প্রতি তেলআবিবে ওবামা প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা রবার্ট ইনহর্ন বলেন, ইরানের সঙ্গে একটি ‘ভালো চুক্তিতে’ আসা অসম্ভব হতে পারে। কারণ, ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর ওপর নজর রাখেন এমন পর্যবেক্ষকদের মতে, নিষেধাজ্ঞার পরিধি যতই বাড়ানো হোক বা যুক্তরাষ্ট্র যতই সামরিক হুমকি দিক, মার্কিন ও ইসরায়েলি শর্ত ইরান কখনোই মেনে নেবে না।
রুহানির প্রতি অবশ্য ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সমর্থন আছে।
সম্প্রতি খামেনি মন্তব্য করেন, ‘আলোচনায় ইরানের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে একই সঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, আলোচনার ব্যাপারে ‘আশাবাদীও নন’। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা শুধু খামেনিরই আছে।
আলোচনা শুরুর আগে খামেনির উল্লিখিত মন্তব্যের কারণ প্রসঙ্গে উড্রো উইলসন সেন্টার অব স্কলারসের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কর্মসূচির ব্যবস্থাপক হালেহ এসফানদিয়ারি বলেন, ঘনিষ্ঠ নেতাদের চাপে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে রুহানির সমঝোতার চেষ্টাকে সমর্থন করেন খামেনি। এই সমর্থনের ওপর নির্ভর করে রুহানি কোনো সমঝোতার পথ বের করতে পারেন কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: এএফপি ও রয়টার্স।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।