আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘শচীন’ ‘শচীন’ ধ্বনি শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত কানে বাজবে

হাতে ধরা দীর্ঘ তালিকা। ধরে আসছিল গলাটাও। সামলানোর চেষ্টা করেছেন উথলে ওঠা আবেগটাকে। সিকি শতাব্দীজুড়ে লেখা ক্রিকেটের এই অপূর্ব উপাখ্যানে যাঁরা সামান্যতম অবদান রেখেছেন, বিদায়ী বক্তৃতায় মহানায়ক সবাইকেই জানালেন কৃতজ্ঞতা...

বন্ধুরা, একটু শান্ত হোন, নইলে আমি আরও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ব। (গ্যালারির চিৎকার বাড়তেই থাকে, এই ফাঁকে নিজেকে গুছিয়ে নেন টেন্ডুলকার)
বিশ্বাস করতে পারছি না, ২২ গজে আমার ২৪ বছরের অসাধারণ পথচলা অবশেষে শেষ হলো।

এই সুযোগে আমি তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই, যাঁরা আমার এই পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। (হাতে একটা কাগজ দেখিয়ে) এই প্রথম আমি একটা তালিকা করে এনেছি, পাছে কারও নাম বলতে ভুলে যাই। আশা করছি আপনারা ভুল বুঝবেন না। (আবেগাপ্লুত) কথা বলাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি পারব আশা করি।
আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন আমার বাবা, ১৯৯৯ সালে যিনি চলে গেছেন।

তাঁর নির্দেশনা না পেলে আজ আমি এখানে থাকতাম না। ১১ বছর বয়সেই তিনি আমাকে স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু বলেছিলেন, স্বপ্নকে তাড়া করো, তবে কোনো শর্টকাট খুঁজো না। পথ হয়তো কঠিন হবে কিন্তু হাল ছেড়ো না। আমি তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করেছি মাত্র।

আর বলেছিলেন, ভালো মানুষ হও। আমি যখনই ভালো কিছু করেছি, ব্যাট দেখিয়ে বলেছি—এটা বাবার জন্য।
আমার মা, আমি মাঝেমধ্যে ভাবি আমার মতো দুরন্ত বাচ্চাকে উনি কীভাবে সামলেছেন। আমাকে সামলানো সহজ ছিল না। তাঁকে কতই না ধৈর্য ধরতে হয়েছে! একজন মায়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাঁর সন্তান যেন নিরাপদ ও সুস্থ থাকে।

তিনি এ নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন থাকতেন। গত ২৪ বছর তিনি আমার দেখাশোনা করেছেন, এমনকি তারও আগে যখন আমি ক্রিকেট খেলা শুরু করেছি তখন থেকেও। যখনই খেলেছি, তিনি প্রার্থনায় বসেছেন। আমার মনে হয় তাঁর প্রার্থনাই আমাকে পারফর্ম করার শক্তি জুগিয়েছে। আমার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেটার জন্য মাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।


আমার কাকা ও কাকি, বাড়ি থেকে স্কুল দূরে বলে আমি ওনাদের সঙ্গে থেকেছি। তাঁরা মা-বাবার মতোই আমাকে দেখে রেখেছেন। কাকি নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিয়েছেন, যাতে আমি ঠিকমতো প্র্যাকটিসে যেতে পারি। আমি ওঁদের সন্তানের মতো ছিলাম এবং এখনো আছি।
আমার বড় ভাই নীতিন আর তাঁর পরিবার সব সময়ই আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।

বড় ভাই কথা কম বলেন। শুধু একটা কথাই বলতেন, যা-ই করো, শতভাগ ঢেলে দিয়ো। তাঁর এই সাহস আমার জন্য ছিল অনেক কিছু।
আমার বোন সবিতা ও তার পরিবারও ব্যতিক্রম নয়। আমাকে প্রথম ব্যাটটা দিয়েছিল আমার বোন।

কাশ্মীরের কাঠের তৈরি ব্যাট, তা দিয়েই আমার যাত্রা শুরু। আমি যখনই ব্যাট করেছি, ও উপোস থেকেছে।
অজিত, ওর সম্পর্কে আমি কী বলব জানি না! আমরা একসঙ্গেই পথটা পেরিয়েছি। আমার জন্য ও নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছে। ও আমার মধ্যে কিছু একটা দেখেছিল।

১১ বছর বয়সে ও আমাকে আচরেকার স্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল এবং তারপর আমার জীবনটাই বদলে গেছে। কাল রাতেও আমাকে ফোন করে আমার আউটটা নিয়ে আলোচনা করেছে। আমি আর হয়তো ব্যাটিং করারই সুযোগ পাব না, এটা জেনেও! এ এমনই অভ্যাসের ব্যাপার! আমরা টেকনিক নিয়ে আলোচনা করেছি, কখনো কখনো মতবিরোধও হয়েছে, কিন্তু ও না থাকলে আমি এর চেয়ে অনেক খারাপ ক্রিকেটার হতাম।
আমার জীবনে সবচেয়ে সুন্দর ঘটনাটা ঘটে ১৯৯০ সালে, যখন আমি আমার স্ত্রী অঞ্জলির দেখা পাই। ওই বছরগুলো আমার জীবনে বিশেষ কিছু, আশা করি এখনো তেমনই থাকবে।

ও চিকিৎসক, সামনে ছিল দারুণ একটা ক্যারিয়ার। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ও বলল, তুমি ক্রিকেট নিয়েই শুধু ভাবো, পরিবারের দায়িত্ব আমার। এটি না হলে আমি এভাবে চালিয়ে যেতে পারতাম না। আমার হতাশা, আমার দুঃখ, আমার উত্থান-পতন সবকিছুর সঙ্গী হয়ে থাকার জন্য ধন্যবাদ। আমার জীবনের সেরা জুটিটা তোমার সঙ্গেই হয়েছে।


আমার জীবনের অমূল্য দুই হীরকখণ্ড অর্জুন আর সারা। ওরা এখন বড় হয়ে গেছে। সারা এখন ১৬, অর্জুন ১৪। সময় কীভাবে চলে যায়! ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে চেয়েও পারিনি। বিশেষ উপলক্ষগুলো যেমন ওদের জন্মদিন, স্কুলে স্পোর্টসের দিনে থাকতে পারিনি, ওদের নিয়ে ছুটি কাটাতে যেতে পারিনি।

তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না, তোমরা আমার কাছে কতটা স্পেশাল। গত ১৬ বছর তোমাদের সময় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখতে পারিনি। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করছি, আগামী ১৬ বছর কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় সবকিছুই তোমাদের জন্য।
আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, আনন্দ মেহতা ও অ্যানাবেল...জীবনের নানা বিষয় নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, উপদেশ নিয়েছি। আপনারা করতালি দেওয়ার আগেই বলে দিতে চাই, সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা আমার সঙ্গে অঞ্জলিকে বিয়ে দিয়েছেন।


গত ২৪ বছরে আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে। তবে আমার জীবনে ছেলেবেলার বন্ধুদের অনেক অবদান। ওরা আমার জন্য ক্লান্তিহীনভাবে নেটে বোলিং করেছে। কষ্টে থাকলে আমার মন ভালো করতে ছুটিতে নিয়ে গেছে। যখন আমি চোটগ্রস্ত, অনেক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হয়েছে, আমার ক্যারিয়ার শেষ।

ওরা আমাকে সেই ভাবনা থেকে ফিরিয়ে এনেছে। ওরা না থাকলে আমার জীবন অসম্পূর্ণ থাকত।
আমার ক্যারিয়ার শুরু ১১ বছর বয়সে, যখন অজিত আমাকে আচরেকার স্যারের কাছে নিয়ে যায়। এখানে ওনাকে স্ট্যান্ডে দেখতে পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। এমনিতে উনি টেলিভিশনে আমার সব ইনিংসই দেখতেন।

আমার ১১-১২ বছর বয়সে আমাকে স্কুটারের পেছনে বসিয়ে এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে নিয়ে যেতেন। শিবাজি পার্কে হয়তো ব্যাটিং করার পর আবার আজাদ ময়দানে, যাতে আমি ম্যাচ প্র্যাকটিস পেতে পারি। তবে এই ২৯ বছরে কখনো উনি আমাকে ‘ওয়েল প্লেড’ বলেননি, কারণ তিনি ভাবতেন আমার হয়তো আত্মতুষ্টি চলে আসবে এবং আমি পরিশ্রম করা ছেড়ে দেব। এখন আমাকে শুভকামনা জানাতে পারেন স্যার, আমার ক্যারিয়ারের প্রশংসা করতে পারেন, কারণ আমার জীবনে আর কোনো ম্যাচ নেই। আমি এখন থেকে ক্রিকেট দেখব, ক্রিকেট আমার হূদয়ে থাকবে।

আমার জীবনে আপনার অবদান অপরিমেয়। ধন্যবাদ, স্যার।
মুম্বাইয়ের হয়ে আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল এই মাঠেই। মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আমার খুব কাছের। আমার মনে আছে, নিউজিল্যান্ড থেকে আমি ভোর চারটায় এসে নেমেছি, সকাল ৮টায় এখানে খেলেছি।

কেউ আমাকে জোর করেনি, ভালোবাসার কারণেই এটা করতে পেরেছি। এমসিএ সভাপতি এখানে আছেন। আপনাকে, আপনার টিমকে ধন্যবাদ আমার দিকে এত খেয়াল রাখার জন্য।
আমার স্বপ্ন ছিল ভারতের হয়ে খেলা। শুরু থেকেই বিসিসিআই ছিল আন্তরিক, ওরা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছে।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে আমাকে দলে ডাকা ছিল বিরাট ব্যাপার। নির্বাচকদের সবাইকে ধন্যবাদ, আমার ওপর বিশ্বাস রাখার জন্য। বিসিসিআই সব সময় আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, যখনই চোট পেয়েছি তখন যাতে আমার চিকিৎসার ত্রুটি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেছে।
২৪ বছরের এই পথচলা ছিল অসাধারণ। আমি অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলেছি, আরও অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারদের খেলা টিভিতে দেখেছি।

সবাইকে ধন্যবাদ। আমি হয়তো ওদের অনেকের সঙ্গে খেলতে পারিনি কিন্তু ওদের অর্জন আর অবদানকে সম্মান জানাই।
বড় পর্দায় রাহুল, লক্ষ্মণ, সৌরভকে দেখছি। অনিল এখানে নেই। আর আমার এখনকার সতীর্থরা।

পরিবারের বাইরে তোমরা আমার কাছে আরেকটি পরিবারের মতো। এত অসাধারণ সময় কাটিয়েছি যে আর এই ড্রেসিংরুমের অংশ হতে না পারাটা হবে খুব কঠিন। সব কোচকে ধন্যবাদ জানাতেই চাই তাদের গাইডেন্সের জন্য। টেস্টের প্রথম দিন ধোনি আমাকে ২০০তম টেস্টের ক্যাপ দিয়েছিল যখন, তখনই সবাইকে আমি একটা কথা বলেছিলাম, আবারও বলছি, ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য হয়ে, দেশের হয়ে খেলতে পেরে আমরা সবাই গর্বিত। আমি সবাইকে চিনি এবং জানি তোমরা সবাই একই উৎসাহ আর মূল্যবোধ নিয়ে দেশের হয়ে খেলে যাবে।

আমরা সৌভাগ্যবান যে ঈশ্বর আমাদের বেছে নিয়েছেন। তোমাদের সবার প্রতি শুভকামনা রইল।
এতগুলো বছর ধরে যাঁরা আমাকে খেলার মতো ফিট রেখেছেন সেসব চিকিৎসক, ফিজিও আর ট্রেনারদের ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় হবে। আমি যতবার চোটে পড়েছি, জানি না কীভাবে আপনারা আমাকে ফিট রেখেছেন, কিন্তু এটা জানি আপনাদের চেষ্টা ছাড়া এটা কখনো সম্ভব হতো না। আমি আপনাদের যখন-তখন বিরক্ত করেছি।

মুম্বাই, চেন্নাই, দিল্লি যেখানে-সেখানে। কাজ, পরিবার ফেলে আমার জন্য পরের ফ্লাইটেই উড়ে এসেছেন। অনেক ধন্যবাদ আমাকে এভাবে ফিট রাখার জন্য।
আমার বন্ধু মার্ক মাসকারেনহাস, আমার প্রথম ম্যানেজার ছিল সে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০১ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা তাকে হারিয়েছি।

কিন্তু সে ছিল ক্রিকেটের, আমার খেলার, ভারতীয় ক্রিকেটের বিশাল শুভাকাঙ্ক্ষী। ও জানত একটা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে কী পরিমাণ আবেগ দরকার হয়। আমাকে কখনো কোনো কিছু নিয়ে জোর করেনি। বিজ্ঞাপন, স্পনসর—সবকিছু সামাল দিয়েছে। আজ আমি তাকে অনেক মিস করছি।

অনেক ধন্যবাদ, মার্ক।
এখন যারা মার্কের কাজটা করছে, আমার ম্যানেজমেন্ট টিম, তাদেরও ধন্যবাদ। ওরা বোঝে আমি কী চাই। ১৪ বছর ধরে আমার সঙ্গে আছে আরও একজন, আমার ম্যানেজার বিনোদ নাইডু। ও আমার পরিবারের মতোই।

আমার কাজের জন্য সে নিজের পরিবারকে সময় দিতে পারেনি। ওর আর ওর পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
স্কুল থেকেই আমি যখন ভালো খেলেছি, সংবাদমাধ্যম আমার পাশে থেকেছে। আজও ওরা সেই কাজটাই করছে। এটা আমার জন্য এক বড় পাওয়া আলোকচিত্রীরা যে অসাধারণ সব মুহূর্ত ধরে রেখেছেন তা আমার সঙ্গে থাকবে সারা জীবন।


জানি, বক্তৃতাটা বড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেষে একটা কথা বলতে চাই। যাঁরা আমাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন, আমি শূন্য করি বা এক শ, আমাকে সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এটা আমার কাছে অনেক কিছু।
আমি অনেককে চিনি যাঁরা আমার জন্য উপোস থেকেছেন, প্রার্থনা করেছেন, আরও কত কিছু করেছেন।

এসব ছাড়া আমার জীবনটা এ রকম হতো না কোনো দিন। আমি অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই। সময় দ্রুত চলে গেছে কিন্তু আপনাদের সঙ্গে আমার যে স্মৃতি, সেটা রয়ে যাবে চিরদিন। বিশেষ করে ‘শচীন’, ‘শচীন’ ধ্বনি আমার জীবনের শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত কানে বাজবে।
অনেক ধন্যবাদ।

যদি কিছু ভুলে গিয়ে থাকি, আপনারা বুঝবেন।
বিদায়।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.