এখন দেশের সব আলোচনাই নির্বাচনকেন্দ্রিক। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, উপর্যুপরি হরতাল, সরকার ও বিরোধীদের অনমনীয় অবস্থানের কারণে সবার মনেই প্রশ্ন, নির্বাচন হবে কি না এবং হলে কী ধরনের নির্বাচন হবে। সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। নির্বাচনের প্রশ্নে যে তিনটি বিকল্প ছিল—সবার অংশগ্রহণে একটা নিয়মিত রুটিন নির্বাচন, একতরফা নির্বাচন ও নির্বাচন না হওয়া, তার মধ্যে দেশ এখন দ্বিতীয় বিকল্পের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে নাটকীয় ঘটনা না ঘটলে সবার অংশগ্রহণে, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কিন্তু কমবেশি সবাই মনে করেন যে নির্বাচন অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ।
এই নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ? যেকোনো বিষয়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলার একটা প্রবণতা আমাদের রয়েছে, সেটা অতিরঞ্জনের স্বাভাবিক প্রবণতারই অংশ। এযাবৎ অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনকে ঐতিহাসিক না বললেও ১৯৯১ সালের পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোকে দেশের গণমাধ্যম ও রাজনীতি বিশ্লেষকেরা প্রায় সমস্বরে এই রকম কোনো না-কোনো বিশেষণে ভূষিত করেছেন। এ বিষয়ে তাঁরা যে ভুল করেছেন তা নয়, বরং এটাই সত্য যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য এগুলোর প্রতিটির গুরুত্ব ছিল। এবারের নির্বাচন তার চেয়ে ভিন্ন নয়।
বাংলাদেশে এই নির্বাচনের গুরুত্ব যেমন, তেমনি আমরা দেখতে পাচ্ছি নির্বাচন কীভাবে হবে—সে বিষয়ে সরকারি দল এবং বিরোধীরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না। এমনকি তারা পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করতেও সফল হয়নি।
নির্বাচন প্রশ্নে আলোচনায় সবচেয়ে বড় বাধা নির্বাচন কীভাবে হবে তা যেমন, তেমনি নির্বাচনের ব্যাপারে সমাজে ও রাজনীতিতে যে মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে তা-ও। সে কারণে বিরাজমান অবস্থা ও কী ঘটতে পারে, তা বোঝার জন্য আমাদের আসন্ন নির্বাচনের গুরুত্ব এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের আশঙ্কার বিষয়গুলো উপলব্ধি করা দরকার।
নির্বাচনই যে গণতন্ত্র নয় এবং তা যে গণতন্ত্রের একটি উপাদানমাত্র, এ কথা এখন প্রায় সবারই জানা এবং তা কার্যত বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
গণতন্ত্র নিয়ে যাঁরা পঠনপাঠন করেন তাঁরা যেমন এখন এ বিষয়ে জোর দেন, তেমনি জোর দেন নীতিনির্ধারকেরা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এখন এ বিষয়েই বরং বেশি উৎসাহী যে গণতন্ত্রের আর কোন দিকগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে একটি দেশের গণতন্ত্রের প্রকৃতি ও মান বিচার করা যাবে। এ অবস্থা কিন্তু এক দিনে তৈরি হয়নি। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়ও এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক, রাজনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গণতন্ত্র বলতে নির্বাচনের ওপরেই বেশি জোর দিত।
যে কারণে আমরা সত্তরের দশকে দেশে দেশে সামরিক শাসকদের ‘গণতান্ত্রিক’ বলে বর্ণনা করার ঘটনা দেখতে পাই, অন্যদিকে স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসকেরাও নির্বাচনের আয়োজন করে নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে জাহির করার চেষ্টা করেছেন এবং এ জন্য তাঁদের আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে কোনো ব্যাখ্যা দিতে হয়নি।
এই ধারণা বদলানোর পেছনে যে কারণগুলো কাজ করেছে তার অন্যতম হলো ১৯৭৪ সালের পর থেকে সারা দেশে ন্যূনতম গণতন্ত্রের প্রসার এবং সে বিষয়ে সবার উৎসাহ। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় স্যামুয়েল হান্টিংটন দেখান, শাসনব্যবস্থা হিসেবে ইতিহাসে তিন দফা গণতন্ত্রের প্রসার হয়েছে; একে তিনি বলেন ‘গণতন্ত্রের তিন ঢেউ’। তিনি বলেন, প্রতিটি ঢেউয়ের পরেই এসেছে ভাটার টান। প্রথম ঢেউয়ের ঘটনা ১৮২৬ থেকে ১৯২৬ সাল।
দ্বিতীয় ঢেউ দেখতে পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, যার শেষ হয়েছে ১৯৬২ সালে। এবং তৃতীয় ঢেউয়ের সূচনা হয়েছে ১৯৭৪ সালে। ১৯৯১ সালে তাঁর গবেষণার শেষে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে খুব শিগগির ভাটার টান আসবে। তাঁর ধারণা ও পদ্ধতিগত বিভিন্ন দিক নিয়ে পরে সমালোচনা হলেও এটা লক্ষ করা যায় যে মোদ্দা কথার দিক থেকে এটা ঠিক, ১৯৭৩ সালে সারা পৃথিবীর মোট দেশের এক-চতুর্থাংশ ছিল গণতান্ত্রিক, ১৯৮০ সালে তা দাঁড়ায় এক-তৃতীয়াংশে ও ১৯৯২ সালে প্রায় অর্ধেকে।
নব্বইয়ের দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোয় একদলীয় শাসনের অবসান ঘটলেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হয়।
আশাবাদী গবেষক ও নীতিনির্ধারকেরা আগে থেকেই এই ধারণা দিচ্ছিলেন যে একবার গণতন্ত্রে ‘উত্তরণের’ পর এই দেশগুলোয় গণতন্ত্র ধীরে ধীরে হলেও ‘সংহত’ রূপ লাভ করবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একাংশ যখন এই নতুন ‘গণতান্ত্রিক’ দেশগুলোয় গণতন্ত্রায়ণ কীভাবে ঘটল সে বিষয়ে উৎসাহী হলো, আরেক অংশ গণতন্ত্র সংহত করার উপায় বাতলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু এই দুই প্রবণতার বাইরে গিয়ে কিছু গবেষক সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন এই বিষয়ে যে এই ‘নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলো’র অনেকেই গণতন্ত্রের পথে খুব বেশি অগ্রসর হয়নি, অর্থাৎ সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিয়মিতভাবে, নাগরিকেরা সীমিতভাবে অধিকার পাচ্ছেন এবং অবশ্যই অধিকাংশ দেশ আগের স্বৈরাচারী বা প্রত্যক্ষভাবে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় ফিরে যায়নি (কয়েকটি দেশে যদিও আবার পুরোনো ব্যবস্থা ফিরেও এসেছিল), কিন্তু এসব দেশে নির্বাচনের বাইরে গণতন্ত্রের আর কোনো দিকই বিকশিত হচ্ছে না। এ ধরনের গণতন্ত্র, যেখানে নিয়মিত নির্বাচন আছে, কিন্তু নাগরিকের অধিকার সীমিত, ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ সুস্পষ্ট, কিংবা সাংবিধানিকভাবেই জবাবদিহির ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। প্রমাণ পাওয়ার জন্য গবেষকদের খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি।
কমবেশি সবাই স্বীকার করে নিলেন, গণতন্ত্রকে কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক বলে বিবেচনা করাটা যথাযথ নয়। এসব গণতন্ত্রকে কীভাবে বর্ণনা করা হবে, সে বিষয়ে আলোচনায় এদের ‘সংকর সরকার’ বলে চিহ্নিত করার একটি ধারা তৈরি হলো। এই প্রেক্ষাপটেই গণতন্ত্রের ব্যাপকতর দিকগুলোর প্রশ্ন জোরেশোরে ওঠে। এই আলোচনায় এই ব্যাপকতর বিষয় বলতে মানবাধিকারের প্রশ্ন, মত প্রকাশের অধিকার, নাগরিকের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন এবং সর্বোপরি জবাবদিহির প্রশ্নগুলো গুরুত্ব পেতে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই অবস্থান নিতে থাকল যে এ ধরনের গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা গণতন্ত্রকে স্থায়ী করবে; সেগুলো গড়ার কাজে মনোনিবেশ করাই সমীচীন।
গত এক দশকে এ-ও আবিষ্কৃত হয়েছে, এ ধরনের দেশগুলোয় গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। যে কারণে গবেষক, বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নির্বাচনের আগে কীভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে—তাতে সবার অংশগ্রহণের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না, ভোটারদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি রয়েছে কি না, আদর্শিক বা ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিকূল পরিবেশ করা হচ্ছে কি না—সে বিষয়ে নজর দেওয়ার তাগিদ দেয় এবং তা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। কেননা, এগুলোর অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানেও পূরণ করতে পারবে না।
ঠিক এই জায়গায় এসেই বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে। সেটা ২০০৬ সালেও ছিল, ২০০৮ সালে ছিল এবং আসন্ন নির্বাচনের ব্যাপারেও তা সমপরিমাণে বহাল।
স্যামুয়েল হান্টিংটন বলেছেন, একটি দেশের গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ নিয়েছে কি না, সেটা বোঝা যাবে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে ওই দেশ পর পর দুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারছে কি না; যাতে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। একে তিনি বলেছেন ‘টু টার্নওভার টেস্ট’ (দুবার বদলের পরীক্ষা)। পরাজিতরা ফলাফল মেনে নিয়েছে কি না এবং বিজয়ীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানকে পাল্টে দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূচনা করেছে কি না, সেটা গণতন্ত্রায়ণের নির্ধারক পরীক্ষা। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পর থেকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সেই পরীক্ষায় বারবার ব্যর্থ হয়েছে। কীভাবে তা ব্যর্থ হয়েছে, তা বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৯৯৪-৯৬ সালের সহিংসতা, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, ২০০৪ সালের চতুর্দশ সংশোধনী—সবই বিরাজমান সীমিত আকারের গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। ২০০৬ সালে ক্ষমতাসীন বিএনপি যে সাজানো নির্বাচনের চেষ্টা চালিয়েছিল, সে সময়ও আমরা দেশে ও দেশের বাইরে উদ্বেগ লক্ষ করেছি।
বাংলাদেশে যে ‘সংকর গণতন্ত্র’ চালু হয়েছে, তা সংহত গণতন্ত্রে রূপ নেবে, এমনটা এই মুহূর্তেই আশা করার কারণ নেই। এ পর্যন্ত যেসব দেশ গণতন্ত্রে উত্তরণের পর এই নতুন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, সেগুলোর কিছু কিছু দেহের পেছনের দিকে হেঁটে কর্তৃত্ববাদী শাসনে ফিরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। ২০০৬ সালের পর সারা পৃথিবীতেই এই প্রবণতা আমরা লক্ষ করছি।
২০০৬ সালে সারা দুনিয়ার ৬৪ শতাংশ দেশকে কোনো না-কোনোভাবে ‘গণতান্ত্রিক’ বলে বর্ণনা করা যেত, এখন তার হার কমেছে। বাংলাদেশ সে পথেই যাবে কি না, সেটাই এই নির্বাচনগুলোতে মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বারবারই আমরা নির্বাচনকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে চিহ্নিত করি। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই প্রশ্নটা ওঠার মানে এই নয় যে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনই এই আশঙ্কা থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। বরং একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন, সাংবিধানিক বিবেচনায় বাধ্যবাধকতামূলক হলেও সে পথেই দেশকে ঠেলে দিতে পারে।
আগামীকাল: নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা
আলী রীয়াজ: পাবলিক পলিসি স্কলার; উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।