আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা দেবেন- একটি সংগঠন স্বাধীনতা দিবস পালন করে না, বিজয় দিবস পালন করে না, ভাষা শহীদ দিবস পালন করে না। তারা শুধু দেশের মুক্তিযুদ্ধেরই বিরোধিতা করেনি, এর বিরুদ্ধে অবস্থানকে জিহাদ হিসেবে প্রচার চালিয়েছিল। তারা এমনকি কোনো কর্মসূচিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে না। তাদের মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগীত পর্যন্ত গাওয়ার অনুমতি নেই। যাদের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটেরও প্রভাবশালী নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, বেগম খালেদা জিয়া যে জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ও কওমি মাদ্রাসাভিত্তিকসংগঠন হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক তৎপরতা নিয়ে একটি শ্বেতপত্রে এমন অনেক অস্বস্তিকর ঘটনার বয়ান রয়েছে। ঢাকায় গত ৮ নভেম্বর 'হেফাজত-জামায়াতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ৪০০ দিন' শিরোনামে এই শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি গত ১ জুন গণতদন্ত কমিশন গঠন করে এ শ্বেতপত্র প্রস্তুত করে।
সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ছিলেন এ কমিশনের প্রধান। গণতদন্ত কমিশনের অনুসন্ধানের বিষয়গুলো হলো- ক. হেফাজতে ইসলামের ৫ মে'র সমাবেশ ঘিরে কীভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল, খ. হেফাজতের স্বরূপ উন্মোচন এবং গ. হেফাজতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দাবিসমূহ। বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীসহ সুশীল সমাজের স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্বদের এ কমিশনের সদস্য করা হয়। পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে কমিশন। হেফাজতের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে আলাপ ছাড়াও এক হাজারেরও বেশি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালানো হয়। রয়েছেন হেফাজত, জামায়াত ও হুজির সাবেক ও বর্তমান অনেক কর্মীও।
তদন্তে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে। প্রথমত, ঢাকায় গত ৫ মে'র সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে কয়েক হাজার নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছিল বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজত। শ্বেতপত্র এই দাবি অমূলক প্রমাণ করেছে। সঠিক তথ্য হলো, ৫-৬ মে'সহ কয়েক দিনের সহিংসতায় সারা দেশে সর্বমোট ৩৯ জন নিহত হন। দ্বিতীয়ত, হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক ও সম্পূর্ণ ইসলামিক সংগঠন হিসেবে দাবি করে। কিন্তু এর পুরো কাঠামো রাজনৈতিক, সংগঠনের অধিকাংশ নেতা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত। যেমন, হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফী নিজাম-ই-ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বর্বরতা চালাতে সহায়তা করেন। হেফাজতের সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী আফগানিস্তানে কথিত জিহাদে আল-কায়েদা ও তালেবানদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তালেবানদের পতনের পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং পরবর্তীতে হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামীর (হুজি) গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবিভর্ূত হন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট হুজিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। হেফাজতের নায়েবে আমির মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীও হুজির সঙ্গে জড়িত। তিনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোটের প্রধান। ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর মতো হেফাজতের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাই ১৮ দলীয় জোটের নেতা। তৃতীয়ত, শ্বেতপত্র হেফাজতের গভীর জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি উন্মোচন করেছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি নেতারা সদস্য সংগ্রহের জন্য এসব মাদ্রাসায় নিয়মিত সফর করেন। আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত বেশকিছু মাদ্রাসায় তাদের স্থাপনাও রয়েছে, যেখানে তালেবানদের মতো ইসলামিক বিপ্লব ঘটানোর জন্য সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মানসিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়। চতুর্থত, হেফাজতের সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার সম্পৃক্ততার বিষয়টিও শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার সেই নাইন-ইলেভেনের পর পাকিস্তানে কুয়েতভিত্তিক রিভাইভাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটির (আরআইএসএস) ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। অন্যদিকে, আল-কায়েদা সম্পৃক্ততার কারণে সৌদিভিত্তিক আল হারমেইন ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গ্রুপ এসব কওমি মাদ্রাসায় অর্থায়ন করে। পরিশেষে, শ্বেতপত্র এও দেখিয়েছে যে, সরকারের পতনের জন্য ৪ মে খালেদা জিয়ার ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম ও হেফাজতের সহিংসতার যোগসূত্র রয়েছে। মূকাভিনেতা হিসেবে বেগম জিয়া ও জামায়াত-হেফাজতের নেতারা এর দায়ভার এড়াতে পারেন না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত বলেও মনে করেন ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবীর।
শ্বেতপত্র স্পষ্টতই দেখিয়েছে যে, জামায়াত ও বিএনপির বি-টিম হিসেবে আবিভর্ূত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম, যার শেকড় মৌলবাদে গ্রথিত এবং অসংখ্য কওমি মাদ্রাসা থেকে এই ভাবাদর্শ বিস্তৃতি লাভ করছে। রাজপথে গত কয়েক মাসে জামায়াত-বিএনপির সহিংস কর্মকাণ্ডে এ সংগঠনটি সম্পূরক শক্তি জুগিয়েছে। হেফাজতের সঙ্গে জামায়াত ও ১৮ দলের এই ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখন উন্মোচিত। যদিও বিএনপি-জামায়াত এই সত্য আড়ালেই রাখতে চায়। খালেদা জিয়া ও বিএনপি জোটভুক্ত এসব স্বাধীনতা ও দেশবিরোধী মৌলবাদী শক্তিকে আরও গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে। বিএনপি নেতারা যদি মনে করেন, এদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন এবং উসকে দিয়ে রাজপথে তাদের সহিংস শক্তি কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করে যাবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
সালিম মালিক : বিশ্লেষক, এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই), দিলি্ল।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।