মজুরি বৃদ্ধির হিসাব-নিকাশ এখনো বুঝে উঠতে পারেননি পোশাকশ্রমিকেরা। কোনো পক্ষ থেকে এই বেতন বৃদ্ধির হিসাব শ্রমিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে শ্রমিকপাড়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে সন্দেহ, অবিশ্বাস। থামছে না অস্থিতিশীলতা।
এর মধ্যে শ্রমিকনেতারা বলছেন, এই বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবে অনেক কারসাজি রয়েছে।
এটা বাজারদরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণও নয়। তাঁরা শ্রমিক-অধ্যুষিত এলাকায় বাসা ভাড়া ও বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছেন।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সুপারিশ করা নতুন মজুরিকাঠামোতে সর্বনিম্ন মজুরি ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। ১ ডিসেম্বর থেকে এটি কার্যকর হবে। তবে এটি এখনো গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি।
গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আশুলিয়ার জামগড়া, জিরাব, নরসিংহপুরের শ্রমিক-অধ্যুষিত এলাকাগুলো ঘুরে অন্তত ৩৫ জন শ্রমিকের সঙ্গে সরাসরি কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। টেলিফোনে কথা হয়েছে কয়েকজন শ্রমিকনেতার সঙ্গে।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, তাঁদের বেশির ভাগই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। এগুলো হলো: আদৌ বেতন বেড়েছে কি না, বাড়তি বেতন কবে থেকে কার্যকর হবে, লাঞ্চ বিল (দুপুরের খাবারের ভাতা) কি উল্লিখিত বেতনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, না আলাদাভাবে দেওয়া হবে, ওভারটাইম কী হিসাবে দেওয়া হবে। আর সোয়েটার কারখানার শ্রমিকদের কী হিসাবে বেতন বাড়ানো হবে।
জিরাব এলাকায় কথা হয় শ্রমিক আরমান হোসেনের সঙ্গে। তিনি শুনেছেন, সুপারিশ করা বেতনকাঠামোতে লাঞ্চ বিল, হাজিরা বোনাস—সবকিছুই বেতনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, কোনো কিছুই আলাদাভাবে দেওয়া হবে না। তিনি হিসাব কষছেন, তাঁর বেতন মাত্র ২০০ টাকা বেড়েছে।
কিন্তু যখন আরমানকে মজুরি বোর্ডের সুপারিশ করা মজুরিকাঠামো দেখিয়ে জানানো হলো, শুধু লাঞ্চ বিল বেতনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, হাজিরা বোনাস নয়। তখন তিনি হিসাব করে দেখলেন, প্রায় ৭০০ টাকা বেতন বেড়েছে তাঁর।
তিনি গ্রেড-৪ (অপারেটর)-এর বেতনভুক শ্রমিক। গত মাসে বেতন, হাজিরা বোনাস আর দুপুরে খাওয়ার বিলসহ (ওভারটাইম বাদে) পাঁচ হাজার ৭৫০ টাকা তুলেছেন। আর সুপারিশ করা কাঠামোতে তিনি পাবেন ছয় হাজার ৪২০ টাকা। তবু সন্দেহ ঘোচে না এই শ্রমিকের। ঘর থেকে গত মাসের বেতনের স্লিপ বের করে আরেকবার মিলিয়ে দেখেন তিনি।
আরমানের সঙ্গে থাকা শ্রমিক ছৈয়দ আলী বলেন, সদ্য গ্রেডভুক্ত হওয়া শ্রমিকেরা এই বৃদ্ধিতে লাভবান হবেন। যাঁদের আগের ইনক্রিমেন্ট রয়েছে, তাঁদের খুব বেশি বাড়বে না। হিসাব কষে দেখা যায়, এই বছর গ্রেড-৪-এ অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছৈয়দের স্ত্রী আরজিনা বেগমের বেতন নতুনকাঠামোতে বাড়ছে এক হাজার ৮০৯ টাকা। মুঠোফোনের ক্যালকুলেটরে আরমান, ছৈয়দসহ সাত-আটজন হিসাব কষে দেখেন, প্রত্যেকেরই বেতন বেড়েছে ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এত দিন তাঁরা শুনে আসছেন, তাঁদের বেতন বাড়ছে না।
এটা একটা ধোঁকাবাজির বেতনকাঠামো।
বর্তমান কাঠামোতে শ্রমিকেরা লাঞ্চ বিল (দুপুরের খাবার বিল) আলাদা করে পাচ্ছেন। আর নতুন কাঠামোতে লাঞ্চ বিলও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাকিগুলো আগের মতো আলাদাভাবে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকপাড়ায় গুজব হলো—এই কাঠামো বাস্তবায়িত হলে ওভারটাইমের টাকা তাঁরা ঠিকমতো পাবেন না, হাজিরা বোনাসও দেওয়া হবে না।
থাকবে না ইনক্রিমেন্টও (বার্ষিক প্রণোদনা)।
গতকাল দুপুরের পরে পুড়ে যাওয়া তাজরীন গার্মেন্টসের পেছনে নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদেরই একজন আইয়ুব আলী উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলছিলেন, তাঁর বেতন সাকল্যে বাড়বে ৪০০ টাকা। কিন্তু জানুয়ারি মাস থেকেই বাসা ভাড়া অন্তত ৩০০ টাকা বাড়বে। আর বাড়িমালিক বলে দিয়েছেন, গ্যাস-সংযোগ এলে ঘরভাড়া হবে তিন হাজার টাকা।
জানতে চাইলে আইয়ুব আলী বলেন, নয় বছর আগে এক হাজার ৬৬৫ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ওভারটাইম, লাঞ্চ বিল—সব মিলিয়ে পেতেন এক হাজার ৯০০ টাকার মতো। তখন ঘরভাড়া দিতেন এক হাজার ১০০ টাকা। আর এখন সব মিলিয়ে বেতন পান নয় হাজার টাকা। এখন ঘরভাড়া দুই হাজার টাকা।
তাঁর স্ত্রীও আট থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা উপার্জন করেন। একটি মেয়ে আছে। নয় বছরে প্রায় পাঁচ গুণ বেতন বাড়লেও তাঁর দাবি ‘সংসার চলে না’। কারণ, বাজার ঊর্ধ্বমুখী।
শ্রমিক শাহীনা আক্তার বলেন, ছয় বছর আগে তাঁরা থ্রিপিস কিনতেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।
এখন সেই একই কাপড় কিনতে লাগে ৬০০ টাকা। বেড়েছে জামা বানানোর মজুরি। মোটা চালের কেজি ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। আর এই এলাকার কাঁচাবাজার, চালের বাজারে সব জিনিসের দামই বাড়তি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢাকার চেয়েও বেশি।
তিনি জানান, বেশির ভাগ শ্রমিক মাসভর বাকিতে দোকান থেকে জিনিসপত্র নেওয়ায় দোকানদার বাড়তি দাম নিলেও করার কিছুই থাকে না।
তবে বেতন বাড়ায় খুশি চল্লিশোর্ধ্ব শ্রমিক সাবিনা বেগম। সাবিনার স্বামী কবির মিয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। স্বামী-স্ত্রী মিলে তাঁদের সংসারের মোট আয় ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এই দম্পতির তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে চাঁদনীর বিয়ে দিয়েছেন ১৫ বছর বয়সেই।
ছোট দুই মেয়ে নিয়ে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় এক হাজার ৮০০ টাকা ভাড়ার একটি ঘরে থাকেন তাঁরা। মেজো মেয়েটি তৃতীয় শ্রেণীতে আর ছোটটি সাড়ে তিন বছরের। সংসারের খরচ মিটিয়ে এই দম্পতি প্রতি মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা জমাতে পারেন।
সাবিনার পাশের ঘরেই থাকেন তাঁর মেয়ে ১৬ বছরের চাঁদনী আর তার স্বামী খোরশেদ মিয়া। চাঁদনী-খোরশেদ দুজনই আল মুসলিম কারখানায় কাজ করেন।
তাঁদের দুজনের আয় মাসে গড়ে ১৮ থেকে ১৯ হাজার। এই দম্পতি খেয়ে-পরে মাসে ১০ হাজারের মতো টাকা জমাতে পারেন।
সোয়েটার কারখানা: শ্রমিকেরা জানান, উভেন গার্মেন্টসে (যেগুলোতে শুধু সেলাই করা হয়) শুধু মেয়েদেরই নেওয়া হয়। আয়রন সেকশন ছাড়া অন্য কোনো সেকশনে ছেলেদের নেওয়া হচ্ছে না। আর সোয়েটার কারখানায় পুরুষ শ্রমিকদের প্রাধান্য।
কিন্তু এখন সোয়েটার কারখানাগুলোতে কাজের চাপ কম থাকায় অনেক শ্রমিক বেকার বসে রয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় এঁদেরই রাস্তায় নেমে পড়ার আশঙ্কা ও সন্দেহের কথা জানা গেল শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায়।
সুজন ও সুমন নামে রংপুর থেকে আসা দুই ভাই কাজ করেন একটি সোয়েটার কারখানায়। তাঁরা জানান, প্রতিটি সোয়েটার ধরে তাঁদের মজুরি দেওয়া হয় (পিসরেট হিসেবে)। কিন্তু কাজ শুরুর আগে এই পিসরেট ঘোষণা করা হয় না।
ফলে প্রতিবার বেতন তোলার সময় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করে। নতুন মজুরিকাঠামোতে সোয়েটার কারখানা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি বলে তাঁরা শুনেছেন। এ কারণে কয়েক দিন ধরেই অন্যদের সঙ্গে তাঁরাও রাস্তায় গিয়ে ঢিল ছুড়েছেন।
সোয়েটার কারখানার আরেক শ্রমিক বলেন, নতুন একটি ডিজাইনের অর্ডার আসার পর প্রথম কয়েক দিন তাঁদের উৎপাদনশীলতা কম থাকে। তখন পিসরেট বেশি থাকে।
আবার যখন তাঁরা সেটিতে অভ্যস্ত হয়ে বেশি উৎপাদন করেন, তখন পিসরেট কমিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে দিনে সাত থাকি আটটা বানাবার পারি। পরে হাতোত বসি গেলে দিনে ১৩-১৪টাও হয়। কিন্তু প্রথমে যদি প্রতি পিস ৪০ টাকা করে ধরে, পরের দিকে তা ২০ টাকায় নামি আসে। ’
সন্তুষ্ট নন শ্রমিকনেতারা: গত সাড়ে চার বছরে দুই দফা বৃদ্ধির ফলে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন এক হাজার ৬৫০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা হয়েছে।
তবে শ্রমিকনেতারা বলছেন, এটা যথেষ্ট নয়।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, এই কাঠামো বাজারদরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এখানে শ্রমিকের সক্ষমতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ওপরের গ্রেডগুলোতে বেতন বৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম। এগুলো বুঝতে পেরে এখন শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
আর সরকার ও মালিকপক্ষ শ্রমিকনেতাদের ওপর সব দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছে। তাঁরা ইতিমধ্যে চার শ্রমিকনেতাকে গ্রেপ্তার করেছেন। এভাবে মামলা-নির্যাতন করে এই খাতকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আক্তারও বলেন, বাজারমূল্যের সঙ্গে এই কাঠামো সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি দাবি করেন, মজুরি বোর্ড স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়নি, সরকারের পুতুল হয়ে ছিল।
তবে তিনি এও বলেন, ‘সরকার ঘোষণার পরে আমরা এই মজুরি মেনে নিয়েছি। ’
শ্রমিকনেতারা শ্রমিক-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বাড়িভাড়া ও বাজারদর নিয়ন্ত্রণের তাগিদ দিয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।