আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের জাতিয় পতাকার ইতিহাস

স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম

কিছুদিন আগে দেখলাম এক ফেসবুক বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা শিবনারায়ণ দাসের ছবির সাথে ক্যাপশন আবেগপূর্ণ কয়েকটা লাইনসহ পোস্ট দিয়েছেন। পোষ্টের মূল বক্তব্য হচ্ছে শিবনারায়ণ দাস আমাদের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার, যাকে কখনই তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এবং এটা নিয়ে শিবুদা'র মধ্যে একটা চাপা অভিমান আছে। আমি নিজেই সেই বন্ধুর মস্ত বড় ফ্যান এবং সে ফেসবুকে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তো ঐ পোস্টে কমেন্টের পর কমেন্ট চলছে।

আমি সবগুলো কমেন্ট পড়লাম। এমন একজন মানুষকে উপস্থাপন করার জন্য সবাই ধন্যবাদ জানাচ্ছেন, কেউ বা কৃতজ্ঞতা। সাথে শিবুদার প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়ার দাবী। সেখানে আমিও কমেন্টে বললাম - জাতীয় পতাকা এবং শিবু'দা প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, যদি শিবনারায়ণ দাসকে জাতীয় পতাকার ডিজাইনার বলি তাহলে একই কারণে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলতে হয়!! কারণ, এটা যেমন আমরা সবাই জানি সেদিন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে জিয়ার উপস্থিতি এবং স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করাটা ঘটনা চক্রে। সেদিন ওখানে জিয়া না থেকে মীর শওকত বা মঞ্জুর, খালেদ মোশাররফ যে কেউই থাকতে পারতেন এবং যিনি থাকতেন তিনিই ঘোষণাটা পাঠ করতেন।

ঠিক তেমনি ১৯৭০ সালের ৬ই জুন তৎকালীন ইকবাল হলে শিব নারায়ণ দাসের উপস্থিতিও ঘটনা চক্রে। ঐ দিনই কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছেন এবং সেই রাতে ইকবাল হলে অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বুয়েট) শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু সাহেবের সাথে। ঐ দিন যদি উনি ইকবাল হলে উপস্থিত না থাকতেন তাও পতাকাটা বানানো হতোই। তাছাড়া ডিজাইনার কাকে বলবো? যারা রঙ, নকশা বা থিম করেছেন তাদেরকে, নাকি যিনি এঁকে দিয়েছেন তাঁকে? ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঐ ঘটনায় (পতাকা বানানো) উপস্থিত বেশ কয়েকজনের লেখাতে এসেছে কাজী আরেফ, শাহজাহান সিরাজ, মার্শাল মণি মিলে পতাকার রঙ এবং থিমটা ঠিক করার পরেই আঁকার জন্য শিব নারায়ণ দাসকে ডাকা হয় কারণ তাঁর আঁকা জোঁকার হাত ভালো। তখন থেকে সেলাই করিয়ে আনা পর্যন্ত তিনি পতাকা তৈরির কাজে জড়িত ছিলেন।

তিনি একজন জাতীয় বীর। আজীবন সম্মানের পাত্র। তবুও তার প্রতি সম্মান রেখেই একদম প্রথম কথাটা বললাম যে, যদি শিবনারায়ণ দাসকে জাতীয় পতাকার ডিজাইনার বলি তাহলে একই কারণে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলতে হয়! আমাদের কোমল মতি শিশুদের শেখানো হচ্ছে জাতীয় পতাকার ডিজাইনার পটুয়া কামরুল ইসলাম। তিনিও একজন খ্যাতিমান শিল্পী। আমাদের সম্মানের পাত্র।

কিন্তু লাল সবুজের আমার জাতীয় পতাকার ইতিহাস জানার পরে তাঁকে আমি কোন ভাবেই পতাকার ডিজাইনার বলতে পারি না। এবারে দেখা যাক সেদিন পতাকা বানানোর পিছনের ইতিহাস। ৬ জুন '৭০, জয় বাংলা বাহিনীর ব্যাটেলিয়ন ফ্ল্যাগ বানানো : পতাকা পিছনের ইতিহাস জানতে আমাদেরকে একটু পিছনে যেতে হবে। সময়টা মুক্তিযুদ্ধের নয় বছর আগে, ১৯৬২ সাল। দুই অংশের মধ্যে ১২ শত মাইলের দূরত্ব স্বত্বেও শুধু মাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পনেরো বছর পার হয়ে গেছে।

কিন্তু যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এদেশের মানুষ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমেছিল স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছর না পেরুতেই সব ধূলিসাৎ হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর একের পর এক চরম বৈষম্য মূলক আচরণে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বুঝতে পারে এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। আর এই লক্ষেই দুর্দান্ত প্রতাপশালী শাসক স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের 'মার্শাল ল' বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে একটা ছোট্ট একটা গ্রুপ বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তিন জনের সেই গ্রুপে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান, ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এবং কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই তিন ছাত্রলীগ নেতার উদ্যোগে গঠিত হয় 'নিউক্লিয়াস' নামের গোপন সংগঠনটি, যা 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' নামেও পরিচিত।

প্রকাশ্যে এই নিউক্লিয়াসের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। তবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ে বাঙ্গালী জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটিয়ে প্রচারধর্মী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি প্রগতিশীল সংগঠনে রূপান্তর করে তারই ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কর্মী সৃষ্টি করে বাঙলার ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া ভিত্তিক আন্দোলনকে ধাপে ধাপে বাঙ্গালির স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তর করাই ছিল নিউক্লিয়াস বা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের লক্ষ্য। জয় বাংলা শ্লোগানের উত্থান, জাতীয় পতাকা তৈরী ও উত্তোলন করা, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তার অনুমোদন, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যাবতীয় নীতি কৌশল প্রণয়ন হয় এই নিউক্লিয়াস থেকেই। বঙ্গবন্ধু নিউক্লিয়াস সম্পর্কে অবগত ছিলেন শুরু থেকেই এবং তাঁর সমর্থন ছিল এদের প্রতিটা কাজে। তবে নিউক্লিয়াস সকল বিষয়ে যার কাছ থেকে সব থেকে বেশী সহযোগিতা পেয়েছে তিনি হলেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা ।

'৬৯ সালে জেল থেকে বেরিয়ে গোল টেবিল বৈঠকে প্যরোলে মুক্তির কঠিন সিদ্ধান্তটি শেখ ফজিলাতুন্নেসার দৃঢ়তার জন্যই ফলপ্রসূ হয়নি। এছাড়াও '৭১ সালে মুজিব-ভুট্টো, মুজিব-এহিয়ার আলোচনার সময় বেগম মুজিবের দৃঢ় ও আপোষহীন ভূমিকার কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। যাই হোক, আমাদের আলোচনার বিষয় নিউক্লিয়াস নয়, তবুও জাতীয় পতাকার ইতিহাস বলতে গেলে প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসে যায় নিউক্লিয়াস নামটি। যা মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এবং পরে মুজিব বাহিনী নাম ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের পরে বেশ জোড়ে সোরেই এগিয়ে যেতে থাকে এই গোপন সংগঠনের কাজ।

তেমনি এক সময়ে ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে "১৫ই ফেব্রুয়ারী বাহিনী" গঠন ও মার্চপাসটের মাধ্যমে ছাত্র যুবকদের সুশৃঙ্খল বাহিনীতে রূপান্তরের পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস থেকে নেওয়া হয় । ১৯৭০ সালের ০৭ জুন ছয় দফা দিবসে (মনু মিয়া দিবস) ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশ্য এইদিন শ্রমিক লীগই প্রথম শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই প্রেক্ষিতেই ছাত্রলীগ ও উপরোক্ত সিদ্ধান্ত নেয়। এই গার্ড অফ ওনার দেয়াকে আরও অর্থবহ এবং একটা পেশাদারী সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজে পরিণত করতে পোশাক হিসেবে ছেলেদের প্যান্ট শার্ট এবং মেয়েদের সালোয়ার কামিজ বা শাড়ীর রঙ করা হয় সাদা।

সাথে সবার জন্যই সাদা কাপড়ের জুতা ও মাথাতে নেতাজী সুবাস চন্দ্র বোসের সামরিক পোশাকের সাথে ব্যবহৃত টুপির সাদৃশ্য টুপি। তবে টুপির রঙ হয় কালচে সবুজের সাথে নীচের দিকে টকটকে লাল। সামনের দিকে হলুদের মাঝে গোল করে "জয় বাংলা" লেখা আলাদা এক খণ্ড কাপড় সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। ছাত্রলীগের স্বেচ্ছা সেবকদের নিয়ে মহড়া চলতে থাকে ইকবাল হলের মাঠে। চূড়ান্ত মহড়া হয় ০৬ জুন বিকেলে এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কুচকাওয়াজে বাদক দল সংযোজনের।

টুপির কালচে সবুজ ও লাল রঙের এক খণ্ড কাপড় বাদ্যযন্ত্রীদের পিঠে ঝোলানোর ব্যবস্থা করা হয়। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এই কুচকাওয়াজ ও গার্ড অব অনার অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অর্পিত হয় "নিউক্লিয়াস" এর তিন প্রতিষ্ঠাতার একজন কাজী আরেফ আহমেদের উপর। ছাত্রলীগের এই বাহিনীর নাম দেওয়া হয় "জয় বাংলা বাহিনী"। ব্যাটেলিয়নের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় আসম আব্দুর রবকে। সব কিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরে 'নিউক্লিয়াস' থেকে জয় বাংলা বাহিনীর ব্যাটেলিয়ন ফ্ল্যাগ তৈরীর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গার্ড অব অনার অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা কাজী আরেফ আহমেদ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় আসম আব্দুর রবকে। সব কিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরে 'নিউক্লিয়াস' থেকে জয় বাংলা বাহিনীর ব্যাটেলিয়ন ফ্ল্যাগ তৈরীর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গার্ড অব অনার অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৭০ সালের ৬ই জুন রাতে ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জোহূরুল হক হল) ১১৬ নম্বর রুমে আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও মনিরুল ইসলামকে (মার্শাল মণি) ডেকে জানান জয় বাংলা বাহিনীর ফ্ল্যাগ তৈরীর প্রয়োজনীয়তার কথা। এও জানালেন যে, জয় বাংলা বাহিনীর এই ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগই অদূর ভবিষ্যতে বাঙ্গালী জাতীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকার সম্মান লাভ করবে। ঐ রুমেই অর্থাৎ ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে শুরু হলো পতাকা বানানোর প্রক্রিয়া।

আসম আব্দুর রব ও মনিরুল ইসলাম মণি (মার্শাল মনি) বললেন, পতাকার জমিনটা হবে ব্যাটল গ্রিন। শাহজাহান সিরাজ বললেন রক্ত লাল একটা কিছু যেন থাকে পতাকায়। কাজী আরেফ আহমদ তখন গাড় সবুজ জমিনের মাঝখানে গোলাকার লাল রঙের উদিত সূর্য এঁকে সবাইকে দেখান। সেই সময় পাকিস্তানী সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে "United state of Bangle" বা "যুক্ত বাংলা" নামের এক কাল্পনিক রাষ্ট্রের প্রচারণা চালাচ্ছিল। তাই কাজী আরেফ বললেন, পতাকার মাঝখানে রক্ত লাল প্রভাত সূর্যের মাঝে সোনালি রঙের (পাটের রং সোনালী এবং পাকা ধান ক্ষেতের রঙও সোনালী) পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা থাকবে।

পতাকায় ভূখণ্ডের মানচিত্র সুনির্দিষ্টভাবে থাকলে জনগণকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে না পাকিস্তানী সরকারের পক্ষে। সকলে একমত হলেন। ঠিক হয়ে গেলো ব্যাটেলিয়ন ফ্ল্যাগের রঙ, নকশা এবং থিম। তখন প্রয়োজন পড়লো একজন অংকন শিল্পীর। সমস্যার সমাধানও হয়ে যায় সাথে সাথেই।

কারণ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা কুমিল্লার শিব নারায়ণ দাস ঐ দিনই ঢাকায় এসেছেন এসএম হল ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষে ব্যানার ফেস্টুন লেখার জন্য এবং সেই রাতে ইকবাল হলেই অবস্থান করছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিপ্লবী পরিষদের সদস্য হাসানুল হক ইনুর সাথে। সবাই জানতেন শিব নারায়ণ দাসের আঁকা আঁকির হাত খুব ভালো। তাদেরকে ডাকা হলো ১১৬ নম্বর কক্ষে। কাপড় সংগ্রহ ও সেলাই এর দায়িত্ব দেয়া হলো হাসানুল হক ইনু ও শিব নারায়ণ দাসকে। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে নিউ মার্কেট এলাকার বলাকা বিল্ডিঙে ছাত্রলীগের অফিস সংলগ্ন নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্সে গিয়ে কাপড়ের পরিমাণ জেনে নিলেন ইনু ও শিবনারায়ণ দাস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নিউ মার্কেট থেকে নিয়ে আসলেন লেডি হ্যামিলটন কাপড়। বারোটার দিকে কলাপসেবল গেইট বন্ধ করে দিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে পতাকা সেলাই করে দিলেন পাক ফ্যাশনের আব্দুল খালেক ও নাসিরুল্লাহ। কারণ, পাকিস্তানী আইনে এই কাজ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। রাত তিনটার দিকে বানানো হয়ে গেলো দুইটি পতাকা। পতাকা নিয়ে ইনু ও শিবনারায়ণ দাস ফিরে আসলেন ইকবাল হলে।

তখনও মানচিত্র বসানো বাকী। সিদ্ধান্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র লাল বৃত্তের মাঝে রঙ দিয়ে আঁকা হবে। এসব করতে করতে রাত প্রায় শেষ। বলাকা ভবনে ছাত্রলীগ অফিস হওয়ায় নিউ মার্কেট কাঁচা বাজার সংলগ্ন এক আর্টিস্ট এর দোকান থেকে তাঁকে ডেকে সংগ্রহ করা হলো সোনালী রঙ এবং তুলি। এদিকে ইনু ছাত্রলীগের একজনকে সাথে নিয়ে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ হলের (বর্তমানে তিতুমীর হল) এনামুল হকের (ইনু সাহেবের কাজিন) ৪০৮ নং কক্ষে।

তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র একে আনলেন ইকবাল হলে। ১১৬ নাম্বার রুমের মেঝেতে বিছিয়ে শিবুদা তার নিপুণ হাতে ট্রেসিং পেপার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে। তাতে দিলেন সোনালি রঙ। তৈরি হয়ে গেল জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা এবং অনেকের অজান্তেই রচিত হলো ইতিহাস। এক গর্বিত ইতিহাস।

পতাকা তৈরীর পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ, আসম রব, হাসানুল হক ইনু, মার্শাল মণি, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, শিব নারায়ণ দাস, শাহজাহান সিরাজ, গোলাম ফারুকসহ আরো কয়েকজন। তাঁরা সত্যিই ভাগ্যবান গর্বিত এই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন। পরদিন অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ০৭ জুন ছয় দফা দিবসে (মনু মিয়া দিবস) আগের রাতে তৈরী করা ব্যাটেলিয়ন ফ্লাগসহ পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদানের কথা থাকলেও সকালে আবহাওয়া মেঘলা থাকায় এবং এই পতাকার আবেগ বেশী মাত্রায় অনুভব করায় পতাকা প্রদর্শিত করে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে একটা ছোট্ট লাঠিতে পেঁচিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বাহিনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানাতে মঞ্চের কাছে গেলে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আসব আব্দুর রব লাঠিতে মোড়ানো পতাকাটি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু ফোল্ড করা পতাকাটি খুলে একবার আন্দোলিত করেই পাশে থাকা একজনের (কাজী আরেফ বা আব্দুর রাজ্জাক) হাতে দিয়ে দেন।

সেখান থেকে ঐ পতাকা চলে যায় হাসানুল হক ইনুর হেফাজতে। এই কুচকাওয়াজের পর পরই ঢাকায় পাড়া মহল্লায় ছাত্র যুব স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে বাহিনী গঠন করে গার্ড অফ ওনার প্রদান শুরু হয়ে যায়। নিজ মহল্লায় চূড়ান্ত কুচকাওয়াজের জন্য তখন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ নেতা জাহিদ পতাকাটা ইনুর কাছে থেকে নিয়ে যান। কিন্তু পরবর্তীতে ঘটনা প্রবাহ এতো দ্রুত ঘটতে থাকে যে গার্ড অফ ওনার দেয়ার বিষয়টা চাপা পরে যায়। আর পতাকাটা থেকে যায় জাহিদের মালিবাগের বাসাতেই।

প্রায় এক বছর আগে বানানো জয় বাংলা বাহিনীর এই পতাকাই ১৯৭১ এর ২ মার্চ ঢাকা ইউনিভার্সিটির বট তলায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আহূত ছাত্র জনসভায় লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে প্রদর্শন ও উত্তোলন করেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আসম রব। ঐ দিন পতাকা প্রদর্শনের (উত্তোলনের) সিদ্ধান্তও ছিল নিউক্লিয়াসের। ১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান রিপাবলিক দিবসে পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। জয় বাংলা বাহিনীর চারটি প্লাটুন কুচকাওয়াজ দ্বারা ঐ পতাকাকে অভিবাদন জানান। কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন জয় বাংলা বাহিনীর কমান্ডার আসম রব, সাথে ছিলেন হাসানুল হক ইনু ,কামরুল আলম খান খসরু।

আসম রব সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানান এবং পতাকা বঙ্গবন্ধুকে প্রদান করেন। তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে মঞ্চে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ। ঐ দিনই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ও গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। উত্তোলনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু নিজেই পতাকাটি বাসার সামনে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে কয়েকবার আন্দোলিত করেন। এই পতাকাই পরবর্তীতে প্রবাসী সরকার অনুমোদন করেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই পতাকাই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর লাল সবুজের মাঝে সোনালী রঙের মানচিত্র বসানো এই পতাকা নিয়েই বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফেরেন। জাতীয় পতাকায় সামান্য পরিবর্তন/সংশোধন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লাল সবুজের মাঝে সোনালী রঙের মানচিত্র বসানো পতাকাই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা মুজিব নগর সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কিছু সমস্যা ও জটিলতার কারণে স্বাধীনতার পর পরই (১৯৭২ সালের প্রথমেই) এই পতাকা সামান্য পরিবর্তন/সংশোধনের করা হয়। কারণ, মানচিত্রসহ পতাকা বানানোটা ছিল বেশ কঠিন, তাছাড়া মানচিত্র উভয় পাশ থেকে একই রকম লাগেনা দেখতে।

এক পাশে মানচিত্র প্রদর্শিত হলেও অপর দিকে উল্টোভাবে প্রদর্শিত হয়। দায়িত্ব পরে পটুয়া কামরুল হাসানের উপরে। তিনি শুধু পতাকা থেকে বাংলাদেশের মানচিত্র বাদ দেন। সবুজ বাংলার পটভূমিতে টকটকে লাল সূর্য ও শত শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীনতার প্রতীক এই পতাকা। শেষ কথা : পটুয়া কামরুল হাসানকে জাতীয় পতাকার ডিজাইনার বলা হচ্ছে পাঠ্য পুস্তকে।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে ১৯৭০ এর ০৬ জুন দিবাগত রাতে বানানো এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিব নগর সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত পতাকা থেকে তিনি শুধুমাত্র মানচিত্রটা বাদ দিয়েছেন। তাই আমি কোন ভাবেই এটা বলতে পারি না আমাদের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার কামরুল হাসান। আগেই বলা হয়েছে ঐ পতাকা বানানোর সাথে কারা জড়িত ছিলেন। আসলে এই পতাকা ছিল একটা সম্মিলিত প্রয়াস। তাই কারও নাম নিতে হলে ঐ দিন পতাকা বানানোর প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রত্যেকের নামই বলা উচিৎ।

সেই সাথে চূড়ান্ত করার জন্য পটুয়া কামরুল হাসানের। কিন্তু আমরা কি তা করছি? করছি না। পাঠ্য পুস্তকে ডিজাইনার হিসেবে নাম বলা হচ্ছে কামরুল হাসানের, আমাদের কোমল মতি শিশুদের পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার ভুল ইতিহাস শেখানো হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। ৬ জুন ১৯৭০ রাতে পতাকা বানানোর প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যে এই বিষয়ে প্রত্যেকের ভাষ্য পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র শিব নারায়ণ দাস এই প্রসঙ্গে কোন কথা বলেননি। তাই তাঁর ভাষ্য পাওয়া যায়নি।

তিনি এড়িয়ে যান। শিবুদা অভিমানী। তাঁর হয়তো কোন অভিমান রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করার স্বার্থেই তাঁর উচিৎ নীরবতা ভেঙে আমাদের জাতীয় পতাকার গর্বিত ইতিহাসকে সম্পূর্ণ এবং সমৃদ্ধ করা। পতাকায় লাল বৃত্তে সোনালী মানচিত্র বসানোর প্রস্তাবটা কে দিয়েছেন তা নিয়ে দুই ধরণের বক্তব্য পাওয়া যায়।

কাজী আরেফ এবং ইনুর বক্তব্য অনুয়ায়ী প্রস্তাবটা করেছেন কাজী আরেফ এবং মার্শাল মণির বক্তব্য সেটা করেছেন নিউক্লিয়াসের প্রধান সংগঠক সিরাজুল আলম খান। তবে প্রস্তাব যে ই করে থাকুন সব কিছুর মতো এই সিদ্ধান্তটা গ্রহণ করেন নিউক্লিয়াসের তিন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং তা বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতসারেই। পতাকা প্রদর্শনের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন নেন আব্দুর রাজ্জাক। যিনি ছিলেন নিউক্লিয়াস তথা ছাত্রলীগ ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সমন্বয়কারীর দায়িত্বপ্রাপ্ত। এপ্রসঙ্গে সাংবাদিক লেখক মাসুদুল হকের "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ" গ্রন্থে লেখক কর্তৃক নেয়া ছাত্রলীগ নেতা জাহিদ, তাঁর মা, আসম রব ও ইনুর সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানা যায়।

কৃতজ্ঞতা: শহীদ কাজী আরেফ আহমেদের বড় ভাইয়ের কন্যা কাজী সালমা সুলতানা। যিনি কাজী আরেফ আহমেদের অপ্রকাশিত শিরোনামহীন পাণ্ডুলিপি (আইএইচএন কর্তৃক প্রকাশিতব্য) থেকে লিখেছেন ফেসবুক নোট "স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও জয় বাংলা বাহিনী"। তথ্য সুত্রঃ ১. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র : মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মণি) ২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ : মাসুদুল হক ৩. প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর পরে তাঁকে নিয়ে লেখা নিউক্লিয়াসের সদস্য স্কোয়াড্রন লিডার এবিএম আহসান উল্লাহ সাহেবের প্রবন্ধ। ৪. বিভিন্ন সময়ে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ, হাসানুল হক ইনু, আসব বর, শাহজাহান সিরাজের সাক্ষাৎকার। (সংগৃহিত)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.