আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাটির পিরামিডের দেশে


১৯১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জগৎবিখ্যাত মানসিক রোগচিকিৎসক এবং মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মী কার্ল গুস্তাভকে চিঠি লিখল ‘…… আসছে গ্রীষ্মের ছুটিতে আমার প্রয়োজন এমন এক লোকালয় যেখানে একটু একা থাকতে পারব শুধু ধারেকাছে অরণ্য থাকলেই চলবে’। আগস্ট মাসে বন্ধুকে আবার চিঠি লিখে ফ্রয়েড জানিয়ে দেয় ‘...... রেননের এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে আমরা চমৎকার আছি, নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকার অপার আনন্দ আমি নিজের মাঝে খুঁজে পেয়েছি’।
ঘটনার অন্তরালের কাহিনী কিন্তু আরেক। ফ্রয়েড সাহেব তাঁর প্রানতমা স্ত্রীকে নিয়ে বোলজানো শহরের পাহাড়ি স্বাস্থ্যনিবাস রেনন(RENON) গিয়েছিলেন তাঁদের ২৫তম বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করতে। আর একদম যে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থেকেছেন একথাও সত্যি না, ফ্রয়েড সাহেবের বিখ্যাত কিতাব Totem and Taboo এর প্রথম অধ্যায় The Horror of Incest লিখে ফেলেন রেননের Hotel Bemelmans Post এর কামরায় বসে।


রেননের গির্জা
ফ্রয়েড সাহেবের এসব গল্পের কিছুই আমার জানা ছিলনা। ২০০৭ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে বোলজানো(Bolzano) যাবার পরিকল্পনাও ছিল হুট করে নেয়া। ইতালির স্বায়ত্তশাসিত ত্রেনতো(Trentino Alto-Adige) প্রদেশের পাহাড় ঘেরা দু-চারটি হ্রদের ধারে কিছু উইকএন্ডের ছুটিছাটা করা হয়েছিল আগেই কিন্তু সুদূর বোলজানো যাওয়া হয়নি কখনো। আর সেবার তো ছোট বোনের আব্দারে পুরা এক সপ্তাহের বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। সকালবেলা প্রাতরাশ করতে গিয়ে দেখি অনেকটা ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বিশাল এক চার তারকা হোটেল দাঁড়িয়ে আছে একদম সিটি সেন্টারের পাশে।

কিন্তু চার তারকার থেকেও জ্বলজ্বলে আভিজাত্তের প্রতীক হয়ে রয়েছে এক স্মারকলিপি। যা অনুবাদ করলে পোষ্টের শুরুর গল্পটাই বলা হয়ে যায়।

স্মারকলিপিটি দুটি ভাষায় লিখা, ইতালিয়ান আর জার্মান। রেননের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ কথা বলে তাঁদের মাতৃভাষায়, রাষ্ট্রের ভাষায় নয়। ইতালিয়ান নাগরিক হয়েও এরা জার্মানভাষী জনগোষ্ঠী।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯১৯ সালে পুরো বোলজানো প্রদেশটা ইতালির অন্তর্ভুক্ত হবার পূর্বে ছিল অস্ট্রিয়ার অধীনে। স্বায়ত্তশাসন দিতে বাধ্য হয় ইতালিয়ান সরকার, অফিস-আদালত আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জার্মান আর ইতালিয়ান দুটি ভাষার ব্যাবহারই চালু রাখা হয়। প্রায় শত বছর পেরিয়ে যাবার পরও রেননের মত বোলজানোর পাহাড়ি জনপদগুলিতে জার্মান ভাষাভাষী জনগণ তাঁদের মাতৃভাষা আর কৃষ্টি বজায় রেখেছে সমুন্নত। টুরিস্ট সিজনে চালাবার মত ইতালিয়ান ভাষাজ্ঞান এদের অবশ্যই আছে। সুপারমার্কেট থেকে শুরু করে ট্র্যাকিং পথের দিকনির্দেশনা সবখানেই দুটি ভাষার সহঅবস্থান।

এ ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতা।


ফ্রয়েড সাহেব রেননের অরণ্যে তাঁর বিবিসাহেবার হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে অবশ্যই এক প্রাকৃতিক বিস্ময় অবলোকন করেছেন। জানিনা তাঁর মনস্থত্তে কি অনুভূতি হয়েছিল, আমি ট্র্যাকিং করতে গিয়ে হঠাৎ চোখের সামনে সারি সারি মাটির পিরামিড দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। মাটির পিরামিড নামটি আমি দেইনি। এ নামেই পরিচিত প্রাকৃতিক এই বিস্ময়।




এসব পিরামিড গঠনের মূল কারণ বিশেষ ভঙ্গুর মাটিতে মুষলধারে বৃষ্টি এবং খরার ক্রমাগত পরিক্রমণ । সুউচ্চ তিনকোণা পিরামিড সদৃশ এই মাটির প্রাকৃতিক স্থাপনার শীর্ষে আছে টুপির মত এক বড়সড় পাথর। পিরামিডটাকে বৃষ্টিজনিত ক্ষয় থেকে রক্ষা করাই যেন এই পাথরের কাজ। একদিন যদি এই প্রস্তর স্থানচ্যুত হয় যায় তাহলে পুরো পিরামিডটাই ধীরে ধীরে ধসে যাবে প্রাকৃতিক নিয়মেই। প্রায় ৩০ মিটার উঁচু পিরামিডও রেননে আছে, বোলজানোর আরও কিছু এলাকাতে মাটির পিরামিডের দেখা মিলে কিন্তু সেগুলি এতটা উঁচু নয়।

রেননের অন্যতম প্রধান টুরিস্ট আকর্ষণ এই পিরামিডগুলি। বিস্তারিত জানতে উইকির এই পাতায় ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন। পিরামিডের ছবিদুটি উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া হয়েছে ভাল রেজুলুয়েশনের জন্য।
রেননের আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় এর রেলগাড়ি যা আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে সচল। টুরিস্ট আকর্ষণ হিসেবে এখনও ছবির মত সুন্দর দোলোমিতি পর্বতমালার ভ্যালি আর পাহাড়ি তৃণভূমির বুক চিরে ঝিকঝিক শব্দে গন্তব্বে ছুটে চলে রেলগাড়ি।

এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা! আমি যেবার গিয়েছিলাম সে বছরই শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে নানান সাজে মেতেছিল এই রেলসার্ভিস। শুনেছি হালে ধীরে ধীরে বদলে ফেলছে আগের মডেলের রেলগাড়িগুলি।


ইষ্টিশন
ফ্রয়েড সাহেবের নামে রেননের সবচেয়ে সুন্দর ট্র্যাকিং পথের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর জন্মের ১৫০ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৬ সালে। এক বছর পরেই সবুজ অরণ্যের বুক চিরে এগিয়ে যাওয়া সেই মেঠো পথ ধরে ২২৬০ মিটার উঁচু রেনন শৃঙ্গে (corno di renon) আরোহণের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে যায় আমার। খামারবাড়ি, জলাভূমি, পাইনের অরণ্য, পশুর হাট, গ্রাম্য মেলা পেরিয়ে ৫ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে রেনন শৃঙ্গে পদার্পণের স্মৃতি হৃদয়ে আজও অম্লান।

নাম না জানা এক অদ্ভুত পাইপ আকৃতির সুরযন্ত্রের বাদনভঙ্গি বিস্মিত করেছে আমায়। দক্ষিণ তিরলের অধিবাসী এই উপত্যকার পাহাড়ি মানুষদের হাজার বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্যর প্রতি অবাক ভালোবাসা আমার হৃদয়কে আপ্লুত করেছে।
ফ্রয়েড সরণি
খামারবাড়ি
নীল-সবুজের মেলা
পশুর হাট
সুরযন্ত্র
হোটেলের কাঠের বারান্দায় বসে কাটিয়েছি জীবনের সবচেয়ে আনন্দের কিছু মুহূর্ত। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি এই দোলোমিতি পর্বতমালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই পাহাড় বেয়েই একদিন লোকাল বয় রেইনহোল্ড মেসনার শুরু করে তাঁর পর্বতারোহণের দুর্দান্ত নেশা।

ফিরে যেতে মন চায় বারবার, যাওয়া হয় না। কত সুখস্মৃতি, কত নতুন অভিজ্ঞতা জমে আছে হৃদয়ে......... মুছেনি আজও।


.........জিপসি

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.