বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে দেশের ১৩টি স্থানে নাশকতা ও বড় ধরনের হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রেল যোগাযোগ। গত সোমবার রাত থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত রেলে ৬০টি ছোট-বড় নাশকতা ও হামলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বগি পোড়ানো, লাইন-ফিশপ্লেট খুলে ফেলা ও রেললাইনে অগ্নিসংযোগ।
গত দুই দিনে অন্তত ২০টি জেলার রেল যোগাযোগ পাঁচ থেকে ২৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। ঢাকা থেকে ২১টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে হয়েছে।
বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ট্রেনের সময়সূচি। চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। নাশকতা-হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়ও কমে গেছে। বর্তমানে দেশের ৪৪টি জেলার সঙ্গে রেলসংযোগ রয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, নাশকতা ও হামলার কারণে মঙ্গলবার থেকে ১৫টি কমিউটার ও ডেমু ট্রেনের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে প্রতিদিন প্রায় ১০০ ট্রেন ছেড়ে যায়। এখন যেসব ট্রেন চলাচল করছে, সেগুলো এক থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ছাড়ছে। নাশকতার কারণে পথে আটকে থেকে যাত্রীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহান।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি চূড়ান্ত করা না হলেও তা সাত থেকে আট কোটি টাকা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুই দিনে কোটি টাকার বেশি আয় কমে গেছে।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে, নাশকতার কারণে কয়েকটি জেলার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। গত দুই দশকে রেলকে কখনো একসঙ্গে এতগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্বিপাকে পড়তে হয়নি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রেলকে এর আগে এভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে রেলের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালকের সঙ্গেও বৈঠক করা হয়েছে।
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক গতকাল রেলভবনে সাংবাদিকদের বলেন, গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে রেলের প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
কয়েকটি জেলা এখনো রেল যোগাযোগবিচ্ছিন্ন: সোমবার রাত থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা থেকে দেশের অন্তত আটটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যে ৫ থেকে ২৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন যেতে পারেনি। এসব ট্রেনে চলাচলকারী আরও অন্তত ১২টি জেলার যাত্রীদেরও যাতায়াত বন্ধ থাকে। ঢাকার বাইরের বড় শহরগুলো থেকে অন্য শহরে চলাচলকারী অনেক ট্রেনও বন্ধ ছিল।
গাজীপুর সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুরে নাশকতার কারণে মঙ্গলবার রাত সোয়া ১০টার দিকে আন্তনগর অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়।
এরপর ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও নেত্রকোনার রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই পথ চালু করা যায়নি। এ পথে প্রতিদিন পাঁচ জোড়া করে আন্তনগর ও মেইল ট্রেন চলাচল করে। রেলের কর্মকর্তারা জানান, এ পথের সব ট্রেনেরই যাত্রী চাহিদা ব্যাপক। এর আগে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে লাইনে নাশকতার কারণে আন্তনগর ট্রেন হাওর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয় এবং ঢাকা-নেত্রকোনা পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
গতকাল বেলা সোয়া দুইটায় লাইনটি চালু হলেও হাওর এক্সপ্রেসের বগি নষ্ট হওয়ার কারণে ট্রেনটি চলেনি।
অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর সোমবার রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের ইমামবাড়ী এলাকায় তিনটি স্থানে প্রায় দুই কিলোমিটার রেললাইন উপড়ে ফেলেন অবরোধ-সমর্থকেরা। এ কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় ২৬ ঘণ্টা।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বগুড়ার সুজায়েতপুরে বগুড়া-লালমনিরহাট পথের পদ্মরাগ এক্সপ্রেস ট্রেনের হোসপাইপ খুলে ফেলেন হরতালকারীরা। মঙ্গলবার রাতে অবরোধ-সমর্থকেরা বগুড়া রেলস্টেশনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেন।
বগুড়ায় গতকাল হরতাল ডেকেছিল ১৮-দলীয় জোট। সোমবার গভীর রাতে ঈশ্বরদীতে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি বগি।
মঙ্গলবার রাতে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের গাজীরচর এলাকায় ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় ময়মনসিংহের সঙ্গে ভৈরব, চট্টগ্রাম, সিলেট পথে পাঁচ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এ পথে বেশ কয়েকটি মেইল ও লোকাল ট্রেন চলাচল করে। গতকাল সকালে সিরাজগঞ্জের হরিপুরে কয়েক ফুট রেললাইন কেটে ফেলা হয়।
এমন ঘটনা সোমবার রাত থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে।
সময়সূচিতে বিপর্যয় ও যাত্রী দুর্ভোগ: গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত ঢাকা থেকে নয়টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। মঙ্গলবারও ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের ১২টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়।
যেসব পথে নাশকতা হয়েছে, সেসব পথের ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। আর যেসব পথ চালু আছে, সেগুলোতে শুরু হয়েছে সময়সূচি বিপর্যয়।
লালমনিরহাট থেকে মঙ্গলবার রাত ১০টায় লালমনি এক্সপ্রেসের কমলাপুরে পৌঁছার কথা থাকলেও সেটি পৌঁছেছে গতকাল সকাল আটটায়। ২৯টি ট্রেন ৫০ মিনিট থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ঢাকা ছেড়ে যায়। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে বিপর্যয় কাটাতে অন্তত ১০ দিন লাগবে বলে জানিয়েছেন রেলের কর্মকর্তারা।
গতকাল রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, রেলে নাশকতা ঠেকাতে র্যাব, পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ৮০০ আনসার সদস্যকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে মুঠোফোনের মাধ্যমে রেলের সম্পদ রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে খুদে বার্তা (এসএমএস) দেওয়া হচ্ছে।
আয় কমেছে: গত দুই দিনে ২১টি ট্রেনের যাত্রা বাতিলের কারণে ২৫ থেকে ৩০ হাজার যাত্রী ঢাকা থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে পারেননি। আগে বিক্রি হওয়া এসব টিকিট ফেরত দিয়ে কাউন্টার থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন যাত্রীরা। মঙ্গলবার কমলাপুর স্টেশন থেকে যাত্রীদের নয় লাখ ৪৯ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে মঙ্গলবার কমপক্ষে সাত হাজার যাত্রী দূরপাল্লার ট্রেনে চড়ে গন্তব্যে যেতে পারেননি। এ স্টেশনে ছয় লাখ ৭২ হাজার টাকা যাত্রীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে।
সিলেট স্টেশন থেকে প্রায় তিন হাজার যাত্রী এক লাখ ৮১ হাজার টাকা ফেরত নিয়েছেন।
গতকাল চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে মহানগর গোধূলী ট্রেনে চড়ে ঢাকা যাওয়ার কথা থাকলেও টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়েছেন ব্যবসায়ী সাইদ বিন সাত্তার। তিনি বলেন, হরতালে গেলেও অবরোধে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।