ভোরের আলো ফুটতে বেশি দেরি নেই। সারা রাত বই পড়তে পড়তে একটা অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে শরীরে। চোঁখ দুটো পিটপিট করছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। কি করা যায়? সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিল টলিন।
দু’টো সিগারেট আছে। নাহ্ থাক, এই ভোর রাতে আর সিগারেট খাবেনা। সিগারেটের বিষাক্ত কটূগন্ধ এই সময়ের কোমলতা নষ্ট করে দেয়। প্যাকেটটা আবার টেবিলে রেখে দিল। খানিক বাদে তার মনে হল নিচে থেকে ঘুরে আসলে শরীরের ছটফটানিটা কমবে।
সে বাইরে বের হবার জন্য তৈরী হল। নিচের গেটটা খোলা নয়। তবে তার কাছে তালার চাবি আছে। এই চাবি সবার কাছে থাকে না। সে রাতে কম ঘুমায়।
মাঝেমাঝে রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে সাত রাস্তার মোড়ে যায়। কোলড্রিংক্স ও সিগারেট নিয়ে রোড আইল্যান্ডের বট গাছের তলে বসে শহুরে গভীর রাতের পরিবেশটা উপভোগ করে।
আজ সাতরাস্তায় এসে কিছুই কিনলো না। এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিবেশটা দেখে নিল। আজ্বান হচ্ছে।
হুশ করে একটা পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে গেল রয়েল মোড় দিয়ে। সুইপাররা বেরিয়েছে রাস্তা পরিস্কার করতে। তারা যে পরিমান ময়লা পরিস্কার করে প্রতিদিন তার মধ্যে অধিকাংশই থাকে সিগারেটের পোড়া ফিল্টার এবং খালি প্যাকেট। মানুষ এত সিগারেট খায় কেন? যেন সবাই ধোয়ার সাগরে টার ও নিকোটিন নিয়ে খেলা করে! সেও সিগারেট খায় তবে এতটা নয়। চব্বিশ ঘন্টায় মাত্র তিন-চারটা।
মোড়ের দোকানগুলো খোলাই থাকে সারা রাত। হোটেল দু’টো রাত দেড়টার পরে কাস্টমারের কাছে কিছু বিক্রি না করে মশলা পিষতে লেগে যায় ফুটপাতে বসে।
সে হাটা শুরু করলো পূর্ব দিকে। এই পথে আড়াই কি.মি. হাটলেই রূপসা ঘাট। ওখানেই যেতে ইচ্ছা হল।
অনেকদিন প্রাতঃকালে হাটা হয়না। একটা প্রেম করেই তার সকালে ওঠার বারোটা বেজেছে। রাত জেগে ফোনে কথা বলে ভোরের দিকে অঝর ধারায় ঘুম ঝরে পড়ে চোঁখে। তখন তাকে ওঠায় কার সাধ্য।
হাটতে হাটতে দেখলো ভোরের আলো ফুটে উঠছে।
কয়েকজন বেরিয়েছে জগিং করতে। ভাল লাগছে তার। শরীরের ক্লান্তি, অস্বস্তিটা দূর হয়েছে। তাছাড়া শহরটা এই মুহূর্তে খুব সুন্দর! সারাদিনের মানুষের কোলাহল, গাড়িঘোড়ার যান্ত্রিক গর্জন নেই। রাস্তাঘাট পরিস্কার, বাতাসটাও সুন্দর! ঠান্ডা একটা অনুভূতি আছে।
যদিও এটা ‘মে’ মাস। তবে তার কাছে মনে হয় ‘সারা বছরই ভোরবেলাটা শীতকাল!’
এক সময় সে রূপসা ঘাটে পৌছে গেল। সূর্যটা নদীর অপর পাড় ঘেষা গ্রামের মাথার উপর দিয়ে উঠছে বিশাল এক সোনালী গোলক হয়ে। নদীর পানি ঝিকঝিক করছে সেই রঙে। রূপসা ঘাট ব্যস্ত এলাকা।
দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাইকেরি মাছ বাজার এখানে। জেলেরা নৌকা করে আসছে মাছ নিয়ে। কেউ ভ্যানে, টেম্পুতেও আনছে। অনেকগুলো ট্রাক থেকেও মাছ নামানো হচ্ছে। বোটকা আঁশটে গন্ধ চারপাশে।
সে পাইকেরি বাজারে ঢুকলো না। বাসস্টেশনে, চায়ের দোকানে বসে একটা কলা ও দু’টো নোনতা বিস্কুট খেয়ে চায়ের অর্ডার দিল। লোক সমাগম বাড়ছে। সকালের প্রথম বাসটা এখনি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে বলে কন্ডাকটর, হেল্পাররা হাকাহাকি শুরু করেছে। এখানে আর না থাকাই ভাল।
দ্রুত চা খেয়ে দাম মিটিয়ে সে একটা ইজিবাইকে চেপে বসলো। সাতরাস্তার মোড়ে আসতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগলো না।
বাইক থেকে নেমেই দেখলো রাস্তার আইল্যান্ডে, ফুটপাতে নারী পুরুষেরা জড় হয়েছে। প্রতিদিন এমন জড় হয় সকালে। এরা নিম্নবিত্ত মানুষ।
কামলা খাটে। এদের সাথে কোদাল, কাঁচি, ঝাঁকা, থালা-বাসন ও কাপড়ের ব্যাগ পর্যন্ত থাকে। এখান থেকে শহরের বিভিন্ন লোক বা মহাজনেরা এসে দিন বা সপ্তাহ চুক্তিতে কাজের জন্য নিয়ে যায়। যত্ক্ষণ না কেউ এসে চুক্তি করে তত্ক্ষণ তারা নিজেদের মাঝে গল্প করে, বিড়ি টানে ও পান চিবোয়।
টলিন রাস্তার পাশে দাড়িয়ে বেশ গভীরভাবে দেখতে লাগলো এদের।
তার কাছে প্রতিদিনের এই শ্রমচুক্তি কোন চুক্তি বলে মনে হয়না। এ যেন স্বাধীন দেশে, আধুনিক সভ্যতার মাঝে একটা ‘ক্রীতদাসের হাট!’
সত্যিই এটা ‘ক্রীতদাসের হাট!’ লোকজন এসে তাদের পছন্দমত শ্রম কেনে ঠিকই কিন্তু সেই সাথে শ্রমিককেও যেন কিনে নেয়। দিনের জন্য হোক বা সপ্তাহের জন্য। শ্রমিকরা খুবই কম মূল্যে তাদের বিক্রি করে প্রতিদিন। বিক্রি বা চুক্তি না হলে মন খারাপ হয়ে যায়।
না খেয়ে থাকার চিন্তা শুরু হয়।
আগে দাস ব্যবসায়ীরা নর-নারী ধরে এনে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মহাজনের নিকট বিক্রি করতো। শ্রমের সাথে শরীর-মন সবই মহাজনের দখলে চলে যেত। দাস-দাসীর কিছু করার থাকতো না। কিন্তু এখন নিজেরা নিজেদের অন্যের কাছে বিক্রি করছে।
আপাত দৃষ্টিতে শ্রম বিক্রিই মনে হয়। কিন্তু অনেকাংশে দেখা যায় সেই পুরোনো প্রথার মতই শ্রমের সাথে শরীর-মন দুটোও। আগে যেটা ছিল চিরস্থায়ী বন্দবাস্ত স্বরূপ এখন সেটা হয় মাত্র একদিন বা সপ্তাহের জন্য। বড়জোর মাস। তাই এই দাস-দাসীদের মহাজন দিনে-দিনে, সপ্তাহে-সপ্তাহে, মাসে-মাসে পরিবর্তীত হয়।
বিভিন্ন মহাজনের সংস্পর্শে এসে তাদের মানসিক পরিবর্তনও বিভিন্ন রকমের হয়। তাদের অভিজ্ঞতা অনেক। অথচ এত অভিজ্ঞতা নিয়েও নিজেকে বিক্রি করা ছাড়া গতি নেই। খাওয়া জুটবেনা এটা না হলে। বর্তমান কালের এই মহাজন কারা? টলিনের মতই লোকজন বা তার বাবা, চাচা, মামা, খালুদের মত লোক।
চোঁখ সওয়া হয়ে গেছে তো তাই এদের নিয়ে কেউ ভাবেনা।
সে এবার একটা সিগারেট ধরালো। দু’টো টান দিয়ে আইল্যান্ডের দিকে হেটে গেল। একজন মধ্যবয়স্ক লোক মাথায় বিড়ে পরে বসে আছে। হাতের কাছে একটু মোটা কঞ্চি লাগানো ঝুড়ি।
পায়ের কাছে কোদাল। দোখলেই বোঝা যায় মাটি কাটার শ্রমিক। পাশে গিয়ে বসলো সে। জিজ্ঞাসা করলো, ‘ কি অবস্থা চাচা.. কেউ ডাকতিছে না?’
লোকটি তার দিকে ফিরে তাকে দেখে নিয়ে বলল, ‘ একজন ডাকছেল। মোটে আশি টাকা দেবে।
কিন্তু দেড়শো টাকার নিচে যাবনা...। ’
-‘ও.. বাড়ি কোই আপনার?’
-‘কেশোবপুর..’
-‘চাচা, পানি কি সরছে আপনাগে এলাকারতে?’
-‘হ্ বাপু..এই শুকনোর সুমায় এট্টু সরে কিন্তু কাজকাম নাই। তাই দেখনা কামলা খাটতি আসলাম। ’
-‘সিগারেট খাবেন..?’
লোকটি মাথা হেলিয়ে বলল, ‘ দ্যাও, এ পর্যন্ত অনেকগুলো বিড়ি শেষ হয়ে গেল...আর কিনা যাবে নানে। ’
টলিন হাতের সিগারেটটা দিল।
জিজ্ঞাসা করলো, ‘ প্রত্যেক দিন আসেন এখানে?’
একটা গভীর সুখ টান দিয়ে লোকটি বলল, ‘ নাহ্...মাঝে মাঝে, তয় গ্রামের আরো অনেকে আসে ডেলি। ’
-‘সবাই কি গ্রামের থেকে আসে?’
-‘না সবাই গ্রামেরতে আসে না..শহরের অনেক বস্তিরতেও আসে। ’
-‘ও..আচ্ছা চাচা..থাকেন, আমি আসি। ’
লোকটির উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠে চলে এল সে। এই লোকের সাথে কথা বলে মনে হল এরা নিজেদের বিক্রি করছে নিতান্ত নিরুপায়ে।
কাজ পছন্দ না হলেও করতে বাধ্য হচ্ছে। এই সব লোকের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় ভাতের কষ্ট এরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করে। অথবা খাবারের জন্য কষ্টটা এদের চেয়ে শিল্পিত করে কেউ লিখতে পারতো না যদি এরা কলম ধরতো।
আমাদের নাগরিক, সরকার, প্রশাসন সবই দেখছে। কিন্তু কোন প্রতিকার নেই।
এদের নিয়ে কেউ উদ্যোগ নেয়না। নেতারা ভোটের সময়ই যা বুকে জড়িয়ে ধরে, প্রতিশ্রুতি দেয়। ভোট শেষ তো ভোলা সারা।
দেশের প্রায় সব সরকারি বাহিনীর সকল সদস্য ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বেশ ভালই বেতন পান। উপরন্তু তেলো মাথায় তোল দেওয়ার মত তাদের রেশনও দেওয়া হয় অকল্পনীয় সাশ্রয়ে।
অনেকে আবার ঘুষও খান। এরাই দেশের সবচেয়ে অবিবেচক, অমানুষ।
অথচ, এই গরিবেরা নিজেদের বিক্রি করে প্রতিদিন পেট পুরে দু’মুঠো খাবারের আশায়। এদের কোন রেশন নেই। বয়স্ক ভাতা বা বিধবা ভাতা নামে যে ভাতা আছে তা এদের কোন কাজে লাগেনা।
এই ভাতা প্রদান করে স্থানিয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা পছন্দসই লোক বেছে প্রদান করে বিধায় সুষ্ঠুভাবে ভাতা বিতরণ হয়না। কোনকোন সময়ে অভিযোগ আসে এই নিঃস্বদের টাকাও মেরে খাওয়ার! তাই চড়া বাজার মূল্যে এদের চাল, ডাল, তেল, নুন কিনে খেতে হয়।
তার মনে প্রশ্ন জাগে, এইসব ডিফেন্স, পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনের রেশন বন্ধ করে এগুলো কি গরীবের মাঝে দেওয়া যায়না? একদম ফ্রিতে নয় অবশ্যই। তবে সরকার যেখানে এক লিটার পিওর রূপচাঁদা সয়াবিন তেল মাত্র এক বা দুই টাকায় দেয় কোন এক ঘুষখোর পুলিশকে, সেটা বন্ধ করে একশো ত্রিশ টাকা লিটারের সেই তেল পঞ্চাশ কি ষাট টাকায় রেখে গরীবদের হাড়ে একটু বাতাস লাগালে দেশ সত্যিই উপকৃত হত।
শুধু মাত্র তেলেই এমন সাশ্রয় নয়। চাল, আটা, চিনি, ডাল, দুধ, ঘি, কাঠ পর্যন্ত নাকি রেশনে এমন শায়েস্তা খায়ী দাম! অমানবিক, অবিবেচক, লোভী, স্বার্থপর এই বৃটিশ নিয়ম সত্যিই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তার বদলে চাকরির বেতন স্কেল একটু বাড়িয়ে দিলেই হয়।
সে যা ভাবছে তা মনে হয় এই জীবনে দেখে যেতে পারবেনা। মানুষ বিক্রির এই হাট এমনই চলতে থাকবে!
রুমে চল এল ভাবতে ভাবতে।
ঘুম আসছে খুব। তাই কোন মতে কাপড় চেঞ্জ করে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণের ভাবনা চিন্তা তাকে আরো অসাড় করে দিয়েছে। রাজ্যের ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে সে। যেভাবে দেশের তথাকথিত এলিট সমাজ জেগে থেকেও ঘুমিয়ে আছে।
শাশ্বত ০৬.০৭.১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।