বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম (৩৫)। শুয়ে আছেন বার্ন ইউনিটের সাধারণ ওয়ার্ডে (গ্রীন ওয়ার্ড)। ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা বুক থেকে পা পর্যন্ত। নড়াচড়া নেই। আগুনে ঝলসানো মুখ কালো হয়ে ফুলে বীভৎস রূপ নিয়েছে।
মাঝে মাঝে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে গালে। ঘুমের মধ্যেই যন্ত্রণায় কেঁপে উঠছেন শফিকুল। সিটের পাশে ফ্লোরে বসে স্বামীকে পাহারা দিচ্ছেন তার স্ত্রী ও দেড় বছরের একমাত্র অবোধ শিশু সন্তান সাফাওয়ান মাহির। বাবার বীভৎস পোড়া চেহারা দেখে ভয়ে অাঁতকে ওঠে সে। কান্না করে বার্ন ইউনিটের বাইরে চলে যেতে চায়।
তার মামা 'সে তোমার বাবা' বলে বোঝাতে চাইলেও বুঝতে রাজি নয় মাহির। কারণ সাত সকালে বাবাকে এমন চেহারায় বিদায় জানায়নি। তাই মাহির মাথা নেড়ে বোঝায় ওইটা তার বাবা হতে পারে না। ছোট্ট মাহির জানে না, অপরাজনীতির শিকার হয়ে তার বাবার এ করুণ পরিণতির কথা। শফিকুল ইসলামের পিতা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস শরীফ ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।
শুধু নোংরা রাজনীতির খেলা বন্ধের আকুতি জানাচ্ছেন বার বার। বার্ন ইউনিটের বাম পাশের ফটকের সামনে রক্ত সংগ্রহের চেষ্টা করছেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ওয়াহিদুর রহমান বাবুর দুলাভাই সোহায়েব বাবলু। মুঠোফোনে আত্দীয় স্বজনদের তাগাদা দিচ্ছেন বার্ন ইউনিটে ছুটে আসতে। তিনি জানান, বাবুর শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত। নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে আছে।
তার ১২ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। তবে ঢাকা কলেজের বাবুর বেশ কিছু বন্ধু রক্ত দিতে এসেছে।
পুলিশের এএসআই নুরুন্নবী (৫৫)। ৩ মেয়ে, ১ ছেলে নিয়ে থাকেন রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে। তার শরীরের ৩৫ ভাগ পুড়ে গেছে।
পুড়েছে শ্বাসনালিও। তিন দিন ধরে নুরুন্নবীকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। নুরুন্নবীর স্ত্রী এবং সন্তানরা চোখে-মুখে হতাশা নিয়ে আইসিইউর ফটকে আপনজনের সুস্থতার অপেক্ষায় দিন-রাত পার করে দিচ্ছেন। বার্ন ইউনিটের গ্রীন ওয়ার্ড, রেড ওয়ার্ড এবং পোস্ট অপারেটিভ ও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে অগি্নদগ্ধ রয়েছেন ৩৭ জন। তাদের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, সরকারি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম মৃধা (৪৫), ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমান বাবু (২৪), পুলিশের এএসআই নুরুন্নবী (৫৫), ব্যবসায়ী আবু তালহা (৪২) ও রাহাজুলকে (২৩) আইসিইউতে রাখা হয়েছে। বিহঙ্গ পরিবহনের চালক গাইবান্ধার মাহবুব হোসেনসহ সাতজনকে রাখা হয়েছে পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে। সাধারণ ওয়ার্ডে আছে ২৫ জন। চিকিৎসকরা জানান, এক মাসে হরতাল ও অবরোধের আগুন আর বোমায় মুকুল, মনির, নাছিমা, কাশেম, মন্টু পাল, আসাদ, মোজাম্মেল, নাহিদ এবং সর্বশেষ রবিন মারা যায়। বার্ন ইউনিটে ভর্তি করানো হয় ৬০ জনকে।
আর বহির্বিভাগে ৬০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এদিকে গতকাল সকালে আগুনে দগ্ধ রোগীদের দেখতে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যান নির্বাচনকালীন সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী রওশন এরশাদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তারা আহতদের খোঁজখবর নেন। এ সময় সাংবাদিকদের যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই দানবীয় বর্বরতার শেষ কোথায়। এটা আমাদের নিষ্ঠুর রাজনীতির নির্মম কৌশল।
রাজনীতির জন্য কতটা নির্মম হতে পারে মানুষ তা এখানে এসে দেখা যায়। দেশ কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী রওশন এরশাদ বিএনপির অপরাজনীতির নিন্দা জানিয়ে বলেন, আমরা রাজনীতি করি দেশ ও মানুষের কল্যাণে। প্রতিবাদ করার অনেক ভাষা আছে। জনগণের কল্যাণে বিরোধী দলকে এই অপরাজনীতি বন্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।