আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হঠাৎ যে কারণে এ সিদ্ধান্ত

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হঠাৎ করে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় সব মহলে নানা আলোচনার সূত্রপাত হয়। সরকার ও মহাজোটের শরিক অন্য রাজনৈতিক দল এমনকি নিজের দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণশুরু হয়। সবার শুধু একটাই প্রশ্ন- হঠাৎ এমন কী হলো যে কারণে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন এরশাদ। জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে আলাপ করে বেশ কয়েকটি বিষয় জানা গেছে। জানা যায়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি, মঞ্জুর হত্যা মামলা থেকে মুক্তি, দলীয় প্রতীক 'লাঙ্গল' মার্কা দাবি করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর করা মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির জন্য নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পার্টির একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কারণের কথা জানিয়ে বলেন, এটাই মোক্ষম সময় আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করা। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব বিষয় সুরাহা করতে আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হবে। কারণ, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না এলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনই করতে পারবে না।

জাতীয় পার্টির কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব কারণ ছাড়াও রয়েছে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর এরশাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব। কাজী জাফর আহমদ পৃথক দল গঠন করেছেন। সারা দেশে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ওপর হামলা ও অফিস ভাঙচুর হলেও নিরাপত্তা পাওয়া যায়নি। পার্টির ৩৮ জন মনোনীত প্রার্থী ইসির বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারেননি এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হওয়ায় সব মিলিয়ে নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। জানা যায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় প্রধান বিরোধী দলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল জাতীয় পার্টির। আবার আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার ধসকে কাজে লাগিয়ে সরকার গঠনেরও স্বপ্ন দেখত দলটি। এ লক্ষ্যে জাতীয় পার্টিকে ৭০টি আসন আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেবে এমন কথাও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ২৯৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করায় খেপে যান এরশাদ। প্রেসিডিয়াম সদস্যরা বলছেন, জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোয় আওয়ামী লীগ প্রার্র্থীদের নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সময়ের মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হবে। নইলে পরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মানবেন না। তারা বলছেন, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে মহাজোটগতভাবে ৪৬টি আসন দিলে ১৭টি আসনে নৌকা প্রতীকে তাদের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে রাখে। ১৮ নভেম্বর নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন এরশাদ। ২০ নভেম্বর মঞ্জুর হত্যা মামলার সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় রেহাই পাবেন এমনটাই আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু মামলাটির পরবর্তী তারিখ আগামী বছরের জানুয়ারিতে ধার্য করা হয়েছে। একইভাবে লাঙ্গল প্রতীক দাবি করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মামলাটিও ঝুলে আছে। ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব সমস্যার সমাধান চান এরশাদ। জানতে চাইলে ঢাকা-৫ আসনে এরশাদের মনোনীত প্রার্থী, পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। যে জন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সব দল না আসায় এবং নির্বাচনের পরিবেশ না থাকায় তিনি (এরশাদ) নির্বাচন বয়কট করেছেন। তিনি আগেই বলেছিলেন পরিবেশ না থাকলে নির্বাচন বয়কট করবেন। পার্টির চেয়ারম্যানের ঘোষণা অনুযায়ী তিনিসহ সব প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করবেন। জানা যায়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার আরও কারণের মধ্যে রয়েছে কাজী জাফর আহমদের স্ট্যান্ডের সঙ্গে অনেক নেতা-কর্মীর আনুগত্য প্রকাশ। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের প্রার্থীর বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিলেটে জকিগঞ্জে উপজেলা চেয়ারম্যান ও মনোনীত প্রার্থীর বাড়ির সামনে বোমা বিস্ফোরণ, কুড়িগ্রামে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে নাজেহাল, সিলেটে বাবলুল ইসলাম বাবুলের বাড়ির সামনে বোমা বিস্ফোরণ, পার্টির মহাসচিব, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের বাসভবনের সামনে বোমা বিস্ফোরণ, এরশাদের বনানী অফিসের সামনে বোমা বিস্ফোরণ। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ধর্ম মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি পার্টির সাতবারের নির্বাচিত এমপি মজিবুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার, প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম এম আলম, ফকির আশরাফ, এস এম আবদুল মান্নান এমপিসহ প্রথম সারির ৩৮ জন নেতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। তারা বিভিন্নভাবে পার্টির চেয়ারম্যানকে নির্বাচন থেকে সরে আসার চাপ দিচ্ছিলেন। জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গতকাল বলেছেন, জেনারেল মঞ্জুর হত্যার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ঘটনার ১৪ বছর পর। কোনো মামলায় যখন আমাকে আটকানো যাচ্ছিল না তখন মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলা আজ ১৮ বছর ধরে চলছে। ১৩ জন বিচারক বদল হয়েছেন, কিন্তু মামলার গতি-প্রকৃতি বদলানো হয়নি। অর্থাৎ আমাকে ঝুলিয়ে রাখতেই হবে। কোনো সাক্ষী আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি তথাপিও মামলা শেষ হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমার দলীয় প্রতীক লাঙ্গল। তাও কেড়ে নেওয়ার জন্য মামলা হয়েছিল। সে মামলা এখনো উচ্চ আদালতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

এরশাদের শেষ ঘোষণা দেখার অপেক্ষায় ইসি! : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিলেও প্রার্থিতা প্রত্যাহার পর্যন্ত এরশাদের শেষ ঘোষণার অপেক্ষায় থাকবে নির্বাচন কমিশন। এবার ২৬৫ জন প্রার্থী জাতীয় পার্টির পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাপা প্রার্থীরা সরে না দাঁড়ালে বা দল প্রার্থীকে বহিষ্কার করলে ইসির নির্দেশনা এবং প্রার্থিতা রক্ষায় শেষ পর্যন্ত প্রার্থীকে আদালতে যেতে হতে পারে। তবে কমিশন এ নিয়ে চূড়ান্তভাবে কিছু বলতে চাচ্ছে না। এদিকে ৬১ আসনে শুধু দুজন করে প্রার্থী রয়েছেন। এসব আসনে জাতীয় পার্টি সরে গেলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের তালিকা দীর্ঘ হবে। ইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, দল মনোনয়ন দেয়, দল প্রত্যাহারও চাইতে পারে। এবার এ নিয়ে জটিলতা হলে ইসির নির্দেশনা ও আদালতই এর সিদ্ধান্ত দেবে।

জাপার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ জানান, আগে থেকে তো কিছুই বলা যাচ্ছে না। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন শেষ হোক তখন বলা যাবে। আর আপিলে এলে দেখবে ইসি। প্রত্যাহারের পর বোঝা যাবে।

দলের চেয়ারম্যানের ঘোষণাই যথেষ্ট নাকি প্রার্থীকে লিখিতভাবে প্রত্যাহার করতে হবে তা জানতে চাইলে কাজী রকিব বলেন, বিধিবিধান রিটার্নিং অফিসার যাচাই-বাছাই করবেন, তা প্রয়োগ করবেন। আমরা এপিলেড অথরিটি। আপিলে এলে আমরা দেখব। কী হবে তা আগে-ভাগে বলা যায় না।

একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, এরশাদের কথার শেষ বলে কিছু নেই। দেখতে হবে শেষ দিন পর্যন্ত (মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার) কি বলেন! অপেক্ষা করেন। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হলে দল নয়, প্রার্থীকেই লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট আসনে আবেদন করতে হবে। দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি একেক সময় একেক কথা বলেছে। মনোনয়ন দাখিলের পরদিন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, সব দল আসেনি, জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে যাবে না। আমি নিজে আমার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছি। জাতীয় পার্টির যেসব প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন তাদেরও নির্দেশ দিয়েছি মনোনয়নপত্র তুলে নাও।

জানতে চাইলে ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, কোনো আসনে দলের প্রার্থী প্রত্যাহার করতে হলে দলীয় ঘোষণা নয়, বরং প্রার্থী বা তার পক্ষে এজেন্টকে প্রত্যাহারের আবেদন করতে হবে। মনোনয়নপত্র বাছাই চলবে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর। প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৩ ডিসেম্বর। ভোট হবে ৫ জানুয়ারি। একজন কর্মকর্তা জানান, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোনো প্রার্থী তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করলে দল সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে প্রতীক না দিতে অনুরোধ জানানোর সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে নতুন করে জটিলতাও হতে পারে বলে জানান ইসি কর্মকর্তারা। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিল। কিন্তু যাচাই-বাছাইয়ের পর জাপা চেয়ারম্যানের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। পরে ইসির কাছে আপিলে তৎকালীন সিইসি এম এ আজিজ কমিশন এরশাদের মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করলে একযোগে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা হয়। ইসির উপ-সচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জানান, ওই সময় ইসির কাছে দুটি দলই ৩০০ আসনের প্রার্থীর তালিকা দিয়ে তা প্রত্যাহারের আবেদন জানায়। কিন্তু এবার সে সুযোগ নেই। প্রতিটি আসনে প্রার্থীকে স্বয়ং বা তার পক্ষে এজেন্টকে আবেদন করতে হবে। তবে সব কিছু রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। ১৭ নভেম্বর ২৯৯ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেয় জাতীয় পার্টি। সোমবার ছিল মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন। এদিন এরশাদের পক্ষে ঢাকা-১৭, লালমনিরহাট-১ ও রংপুর-৩ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.