স্বাধীনতা, সে তো আমার প্রিয় মানুষের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা
গণতন্ত্র বলেতে আমরা বুঝি পশ্চিমা গণতন্ত্র । সেই গণতন্ত্রের উৎকৃষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রহাম লিংকন- "গণতন্ত্র হলো জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জণগণের শাসন"।
আব্রহাম লিংকনের সংজ্ঞানুসারে স্বয়ং যুক্তরাস্ট্র আমেরিকাতেও সেই গণতন্ত্র নেই যা আছে তাকে গণতন্ত্র বলে না বরং বলে প্লুটোক্রাসি । সেখানেও নির্বাচনকালীন প্রচুর টাকার খেলা সেটা হোক বৈধ বা অবৈধ উপায়ে। যেখানেই পুজিবাদ সেখানেই রাস্ট্র সবসময় ধনিক শ্রেণীদের স্বার্থ রক্ষা করতেই ব্যস্ত থাকে।
অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট আণ্দোলন থেকে জানা গেছে মাকিন শাসনযন্ত্র ৯৯% জনগণের প্রতিনিদ্ধিত্ব করে করে না ! বিশ্বের কোনো দেশই প্রকৃত গণতন্ত্র নেই । কোথাও যেমন প্লুটোক্রাসি, কোথাও থিওক্রাসি, কোথাও রাজতন্ত্র,আমীরতন্ত্র কোথাও স্বৈরতন্ত্র আবার গণতন্ত্রের নামে কোথাও পরিবারতন্ত্র । আবার কোথাও এসব মিলে মিশ্রতন্ত্র !
মাহাথির মোহাম্মদ একবার বলেছিলেন, ’গণতন্ত্রের নিকৃষ্ট শাসকের চেয়ে স্বৈরতন্ত্রের উৎকৃষ্ট শাসন অনেক উত্তম। ’ অনেকেই এরসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, গণতন্ত্রের বিকল্প শুধু গণতন্ত্রই । কথাটা হয়তো ঠিক এই কারণে যে স্বৈরতন্ত্রের শাসক যে উৎকৃষ্ট হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সেই শাসনকাল উৎকৃষ্ট হবে কিনা এটা নির্ভর করে ব্যক্তির উপর। এজন্য ইতিহাসে আমাদের বর্তমানের যে কোনো গণতান্ত্রিক শাসকের চেয়েও উৎকৃষ্ট স্বৈরাচার যেমন পাওয়া যায় তেমনি উৎকৃষ্ট রাজাও পাওয়া যায়। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে মাহাথির মোহাম্মদের উক্তিটি যথার্থ বটে !
আমাদের বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ছিটেফোটাও নেই যা আছে গণতন্ত্রের ছদ্মনামে ধনতন্ত্র+পরিবারতন্ত্র+আমীরতন্ত্র। আমীরের ইচ্ছায় কর্ম । এখানে আমীর হলেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী নামের আমীরকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ! বাংলাদেশের মত এরকম দেশে সকলেই তার প্রজা, তার আজ্ঞাধীন দেশ। বলা হয়, গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ইচ্ছাই কর্ম অর্থাৎ জনগণের দ্বারা শাসন। একথাটা এক্কেবারে ডাহা মিথ্যা কথা! যে দেশে জনগণ একটি ভোট না দিয়েও কোনো এক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সেই দেশের গণতন্ত্রের চেয়ে মাহাথির মোহাম্মদের স্বৈরতন্ত্র শতগুণে উত্তম ।
গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞা আব্রাহাম লিংকন দিয়েছেন তা মূলত কাগজেই সীমাবদ্ধ যেমন কাগজের মধ্যে পাওয়া যায় অন্যান্য কিছু নীতিকথা। শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা বা শাসন কখনোই জনগণের উপর নির্ভর করেনা, পরাশক্তিদের ক্ষেত্রে নির্ভর করে ধনকুবেরদের উপর।
মিডিয়া সূত্রে আমরা সবাই জানি যুক্তরাস্ট্রে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দু’জন, কিন্তু আসলে তা না। যুক্তরাস্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুইয়ের অধিক প্রার্থী থাকে। এমনকি ডেমোক্রাট ও রিপাবলিক্যান প্রার্থীর বাইরে তৃতীয় কোনো প্রার্থীকে রাস্ট্রীয় আয়োজনে টিলিভিশন বিতর্কে অংশগ্রহন করতে দেওয়া হয় না ! বুশের সময় এক প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল অথচ এই নিউজগুলো মিডিয়াতে আমরা পাই না । এরকারণ ধনকুবেরদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই কর্পোরেট মিডিয়া। গরীব ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কখনো মিডিয়া কাজ করে না যদিও কখনো করতে দেখা যায় সেখানে অবশ্যই কর্পোরেট মিডিয়ার স্বার্থ থাকতে হবে।
এজন্য তাদের সরকার ব্যবস্থা ডেমোক্রাসি নয় বরং প্লুটোক্রাসি। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম ও লুটেরা শ্রেনী যে সুরে কথা বলে মিডিয়াও সেই সুরে কথা বলে ! এক মালালা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াসহ আমাদের মিডিয়া কি না করল ? না, আমি মালালাকে ডিসঅ্যাভো করতেছি না কিন্তু পাকিস্থানে , আফগানিস্থানে, ইরাকে, সিরিয়ায় এরকম শত শত মালালা প্রাণ হারাচ্ছে অঘোরে যুক্তরাস্ট্র ও তালেবান উভয়ের হাতে ! সেসব মালালার খবর আমরা জানি না, নেইনা বা পাইনা কারণ আমাদের কর্পোরেট মিডিয়ার তাতে কোনো স্বার্থ নেই তেমনি আর একটা উদাহরণ-ভারতের আন্না হাজারে । এই আন্না হাজারেকে নিয়ে ভারতের মিডিয়া ও আমাদের মিডিয়া কোন নিউজটা করা বাকি রেখেছে ? অথচ দেখুন-ইরম শর্মিলা চানু, টানা ১২ বছর অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন, মুখে একফোটা পানি না তুলেও । ভারতের একটি রাজ্যের নাম মনিপুর। সেই মনিপুর রাজ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী গণহত্যার পর AFSPA নামের একটি কালো আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনশনে বসেন মণিপুরি এই তরুণী কবি।
অথচ ভারতীয় প্রচার মাধ্যম এই মহিয়সী নারীর সমর্থনে এপর্যন্ত একটি রিপোর্টও পাবলিশ করেনি ! আবার এই কর্পোরেট মিডিয়াই আন্না হাজারেকে নিয়ে কি তুলকালাম কাণ্ডটাই না করলো !
আর আমাদের বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ক্ষেত্রে শাসনযন্ত্র কখনোই জনগণের উপর নির্ভর করে না বরং আমাদের মত দেশগুলির শাসনযন্ত্রের নিয়ামক হলো দুটি উপাদান। ১. সেনাবাহিনীর শক্তি ও সমর্থন ২. আন্তর্জাতিক সমর্থন তথা দু’তিনটি পরাশক্তির সমর্থন। তবে ২য়টি অনেকাংশে নির্ভর করে প্রথমটির উপর আবার প্রথমটিও মাঝে মাঝে নির্ভর করে ২য়টির উপর। এক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ, পাকিস্থান, মিসর, লিবিয়া ও সিরিয়ার উদাহরণ গ্রহন করলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
মিসরে যখন গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলো তারমাত্র ১৮ দিনের মাথায় সেনাবাহিনী জানিয়ে দিল তারা আর মোবারককে সমর্থন করে না , সো মোবারকের পতন অনিবার্য হয়ে গেল! মিয়ানমারে দীর্ঘকালীন সামরিক শাসন আমরা দেখেছি ও দেখেছি সেখানে কিভাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেত্রীকে বছরের পর বছর গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল ।
লিবিয়াতে সেনাবাহিনী অবশ্য গাদ্দাফি সরকারকে শেষ পর্যন্ত সমর্থন দিয়ে গেছে কিন্তু আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাবে ও পরাশক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের কারণেই গা্দ্দাফি সরকার টিকতে পারেনি। সিরিয়াতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই ২০০১ সালের মার্চে। তো সেই সময় অনেক বাঘা বাঘা আন্তর্জাতিক বিশ্লেকই বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাশারের পতন সময়ের ব্যাপারমাত্র! অথচ আমি সেসময় লিখেছিলাম-বাশারের পতন হচ্ছে না । সেনাবাহিনী সেই শুরু থেকে যেমন বাশার সমর্থক ছিল তেমনি এখনো তারা বাশারকে সমর্থন করেই যাচ্ছে। রাশিয়া ও ইরানের প্রত্যক্ষ ভুমিকার কারণে যুক্তরাস্ট্রের মত পরাশক্তিরা হস্তক্ষেপ না করাতে বাশার আল আসাদ এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে অথচ এরমধ্যেই এক লক্ষেরও বেশি সিরিয়ান প্রাণ হারিয়েছে ! এত ক্ষয়ক্ষতির পরেও এখন বাশার শুধু টিকে থাকা নয় বরং এই মুহুর্তে সিরিয়ায় ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন হলেও বাশার আল আসাদ ৭০%+ ভোটে বিজযী হবেন ।
এখন এমনই তার জনপ্রিয়তা ! কারণ জনগণ এতদিনে বুঝে গেছে আসাদের প্রতিপক্ষ কারা । তারা আর যাইহোক আসাদের চেয়ে কোনোক্রমেই উত্তম হতে পারে না । সেটা উপলব্ধি করতে পেরেই সেনবাবাহিনী ত্যাগ করা হাজার হাজার সেনাসদস্য পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে আসতেছে। দুদিন পর শুনবেন, যুক্তরাস্ট্রসহ পুরো পশ্চিমা বিশ্ব আসাদকে মেনে নিয়েছে।
আপনারা এখন বলতে পারেন, আপনি যা উদাহরণ দিলেন তাতো সব স্বৈরশাসকের উদাহরণ।
কথা ঠিক তবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সেনাবাহিনী বা আন্তজার্তিক পরাশক্তি উৎখাত করেছে। সেখানে জনসমর্থনের বিষয়টা কখনোই বিবেচনা নেওয়া হয়নি। যেমন ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী ড. মোসাদ্দেককে যুক্তরাস্ট্র ও ব্রিটেন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্যু করে উৎখাত, তুরস্কেও আমরা এরকমটি দেখেছি বারবার সেখানে নির্বাচিত ও জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাত ফাঁসিতেও ঝুলানো হয়েছে, পাকিস্থানে তো প্রায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী। আর হাল আমলের মিসরে কিভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করা হলো তাতো কারো অজানা নয়। আর জনগণের সমর্থন নিয়েই যদি আমাদের মত তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলির সরকার নির্বাচিত হয় তাহলে বিদেশী প্রভুদের মনোরন্জনের জন্য তাদের পিছনে রাজনৈতিক দলগুলির এত ছোটাছুটি কেন? দেখা যায় যে দল বিদেশীদের সবচেয়ে বেশি স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন ও বিদেশী প্রভু যে দলের উপর সন্তুষ্ট সেই দলই নির্বাচিত হয় ও সরকার গঠন করে-একথা তো বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই ।
আমরা এরকমটি দেখে আসতেছি-সেখানে নির্বাচন জাস্ট আইওয়াশ ! একথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী বুঝেন বলেই তিনি এবার নির্বাচনের পথে না যেয়ে সমঝোতাতন্ত্রের মাধ্যমে বিনা ভোটেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন এবং এমনকি তিনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নিয়েও সমঝোতার মাধ্যমে আসন ভাগাভাগির কথা বলেছেন। উপরে যতসব তন্ত্র আলোচনা করলাম, এবার রাস্ট্রবিজ্ঞানে নতুন এক তন্ত্রের উৎপত্তি হলো-সমঝোতাতন্ত্র ! বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার যদি কৌশলী ও দক্ষতার সাথে আরো এক বছর বা দেড় বছর যেতে পারে আর এরপরে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন দিলেও তারাই হয়তো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে অনায়াসে যেমনটা হচ্ছে সিরিয়ায়-সরকার মনে হয় সেদিকেই যাচ্ছে। দেশের যা ক্ষতি হয় হবে তবে সরকার কতটুকু সফল হয় তা দেখার বিষয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।