^^^^^^^^^
সময়টা ভালো যাচ্ছে না। ব্যবসা'য় স্থিতিশীলতা নাই বেশ কিছুদিন ধরে। আর যখন সবকিছু আপনার বিপরীতে যাবে তখন সামান্য ভালো কোন অনুভূতি জীবনে অনেক কিছু নিয়ে আসে। অনেকগুলো খারাপের মাঝে একটা ভালো জিনিস বলেই সম্ভবত: আজ সম্পূর্ন অপরিচিত একজন মানুষের কাছ থেকে একটা গিফট পেয়ে সীমাহীন আনন্দ লাগছে। জীবনটা এমনি, যাদের কাছ থেকে অনেক কিছু পাওয়া তাদের কাছে হয়তো কিছুই চাইতে চাইবেন না অথবা চাওয়া এতটাই বেশি যে দিনে দিনে না পেয়ে পেয়ে সেগুলো এখন জীবনে কোন গুরুত্বই বহন করে না।
লোকটার সাথে আজ সকালেই প্রথম পরিচয়, বাসের টিকেট কাটার জন্য কাউন্টারে দাঁড়িয়েছি এমন সময়ে অনেকটা দৌঁড়ে আমার পাশে এসে বলে, ''চট্টগ্রাম যাবেন? টিকেট কাটার দরকার নাই, আমার কাছে বাড়তি একটা কাটা আছে, চাইলে আপনি নিতে পারেন''। হকচকিত আমি না করার আগেই বাসের কাউন্টার মাস্টার বলে উঠেন, "স্যার, ভালই হল। অবরোধের কারণে আমাদের আজ সারাদিনের সব টিকেট অগ্রিম বুকড''। নিরুপায় আমি, কোন বাক্য বিনিময় না করেই লোকটার কথায় সাই দিলাম কারণ যে কোন উপায়ে আমাকে আগামিকাল সকালে চট্টগ্রাম থাকতে হবে। লোকটাকে টিকেটের টাকা'টা দিতে চাইলে বলেন, ''একসাথে যাচ্ছি, কম করে হলেও আরও আট ঘন্টা একসাথে আছি, এত ব্যস্ততা কিসের?''।
বিশালাকার গ্রে-হাউন্ড বাসের প্রথম দিকে পাশাপাশি সিট দু'জনের। কাউন্টারে বসে টুকটাক যেটুকু কথা হয়েছে তাতে জেনেছি লোকটা দেশের বাইরে থাকে, দেশেও বিজনেস আছে, এর কাজেই ঢাকা আসা। কম কথা বলে, তবে যেটুকু বলে সেটুকুতে একটা ডমিনেটিং পাওয়ার আছে, আমাদের দু'জনের বয়স কাছাকাছি, চল্লিশের ঘরেই। এও জানা হয়েছে তার আর আমার গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি থানায়। অল্পভাষী হলেও লোকটার সাথে পথে অনেক গল্প হল, সমসাময়িক রাজনীতি-ব্যবসা নিয়ে টুকটাক আলাপ হল।
ইন্টারেস্টিং ব্যপার হল, কুমিল্লা এসে লোকটা নিজ থেকে বলল খাবারের বিলটা যেন আমিই পরিষোধ করি, কয়েকপদের ভর্তা আর সবজি দিয়ে অনেকটা দেরির লাঞ্চটা মন্দ লাগেনি।
বাস চট্টগ্রাম পৌঁছালে তার ব্যাগ থেকে একটা পারফিউম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলে, 'এটা আপনার জন্য'। দু'জনের বিজনেস কার্ড বিনিময় করে আসার পথে পারফিউমের প্যাকেট'টা খুলতে গিয়ে বক্সের ভেতরের ভাজটায় একটা কিছু লেখা, ''ভালোবাসা কাছে রাখার জিনিস, ভালোবাসার কাছে যেতে পারাটাই আসল, যে কোন উপায়ে .......''
আজ সকাল থেকে মুনের ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে দুই বার রিং এসেছে। অনেকদিন থেকে একটা অভ্যাস সে রপ্ত করেছে, অপরিচিত বা অল্পপরিচিত নাম্বার থেকে আসা কল রিসিভ না করা, একান্ত আপনজন ভা খুব কাছের বন্ধুদের ছাড়া কাউকে মোবাইল নাম্বার না দেওয়া। এর সবচেয়ে বড় উপকার হল উঠকো কলের জ্বালা থেকে বাঁচা, আর ঘন ঘন সিম কার্ড বদলের প্রয়োজন না হওয়া।
সাধারণত ক্লাস না থাকলে দশটা'র আগে ঘুম থেকে উঠেনা সে, নাশতা করার সময় বাসার ল্যন্ডলাইনে আবারো মুনের কল আসে। লোকাল ফেডেক্স অফিস থেকে কল, মুনের নামে একটা শিপমেন্ট আছে, মুন কখন বাসায় থাকবে সেটা নিশ্চিত হতেই ফোন করা।
মুনের নামে আসা বক্সটা হাতে পেয়ে সে কোনভাবেই বুঝতে পারছে না কে এটা পাঠিয়েছে, বক্সের উপরের লেভেলে একটা অনলাইন শপের এড্রেস দেওয়া, কন্টেন্টে পারফিউম লেখা দেখে সাহস করে প্যাকেটা খুলেই ফেলে সে। খুব অবাক হয় ভেতরে পুরূষদের বেশ নামি ব্র্যান্ডের একটা পারফিউম দেখে। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও যে পাঠিয়েছে তার প্রতি সুন্দর হাসিটা দিতে সে কার্পণ্য করে না।
পারফিউমটা না খুলেই আলমারিতে রেখে দেয় সে, ভাবে কখনো সুযোগ মত কাউকে গিফট করা যাবে বা ভাইদের কারো জন্মদিনে গিফট করা যাবে।
তার অনেকদিন পর নিজের আলমারি গুছাতে গিয়ে মুনের হাতে পড়ে সে পারফিউমটি, সুন্দর কালো রংয়ের বক্সটি হাতে নিয়ে খুলে ভেতরটা খুলে দেখে যে। অন্যমনষ্কভাবে পারফিউমটি বের করতে গিয়ে মুহূর্তের অসাবধানতায় মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সেটি। পলকে চির পরিচিত একটা সুবাসে মুনের সারা ঘর, সমস্ত ফ্ল্যাট ভরে যায়। এত বছরের জমানো ক্ষোভ সে সুগন্ধে মুনের চোখের জ্বল হয়ে ঝড়ে পড়তে থাকে।
যে ভালোবাসা তার জীবনে পরিপূর্ণতা পায়নি আজও সেটা তার হল না। কতদিন নিজের ক্লসেটে পড়ে ছিল শত শত পুরনো স্মৃতি, খুলে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি, আজ সব ভালোলাগা স্বল্প সময়ে আবার মিলিয়ে যাবে বলেই কি এভাবে তার কাছে ফিরে এসেছিল। কান্নার তোড়ে কিছুই মনে ছিল না, হাতে থাকা বক্সটি কুচি কুচি করে ছিঁড়তে গিয়ে দেখে ভেতরে প্রিন্ট করা একটা নোট, তাতে লিখা- 'এভাবেই হয়তো বারবার তোমার কাছে ফিরে আসব"।
যদি মেয়েটি মুন হয়, তবে ধরে নিলাম ছেলেটির নাম মেঘ। ঠিক ধরেছেন, প্রত্যেক রোমান্টিক গল্পের নায়ক নায়িকার মত তাদের মাঝেও কিছু একটা ছিল।
প্রথমে নিখাদ বন্ধু, তারপর ভালোলাগা, ভালোবাসা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন সবই ছিল। পরিচিতদের মাঝে যারা জানত তারা আড়ালে বলত, "দে আর মেইড গর ইচ আদার!"। মেঘ এর একটা ব্যপার মুন কে সবসময় আকর্ষণ করত, সেটা হল তার ব্যবহার করা পারফিউম, এমন সাইট্রস আর উডি ফ্লেভর যেটা যে পরিবার আত্বীয় কারো কাছে পায়নি। অনেকবার সে মেঘ এর কাছে এর নাম জানতে চেয়েছে কিন্তু সে বলেনি। প্রতিবার সে উত্তর দিত, আমিতো কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি না, তোমার কাছে সবসময় এই পারফিউম নিয়ে ফিরে আসব।
আর আমি যদি আসতে না পারি যে কোনভাবে তোমার কাছে আমার এই সুবাস আমি ঠিক পাঠিয়ে দিব।
প্রত্যেক ভালোবাসার গল্পের মত তাদের গল্পেও বিচ্ছেদ আসে। বিচ্ছেদ সবসময়ই বিচ্ছেদ, এখানে সাময়িক বা চিরন্তন কোন টার্ম নাই। একদিন ম্যারাথন ফোনালাপ, সিঙারার দোকানে আড্ডাবাজি, বিচের বোল্ডারে বসে দিগন্ত দেখার মাঝে ছেদ আসে মেঘ এর দেশের বাইরে যাওয়ার সুয়োগের মধ্য দিয়ে। না গিয়ে উপায় ছিল না সে-সময়।
যেদিন মেঘ চলে যাবে তার আগের দিন সন্ধ্যায় দু'জনের শেষ দেখা। দু'জনের কেউই কাঁদছে না বরং একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, তারা জানে দূরত্ব-সময়-সমাজের কি এমন সাধ্য তাদের ভালোবাসায় বাধা হয়। একে অপরকে টুকটাক উপদেশ দেওয়ার ফাঁকে একসময় মেঘ তার সবসময়ের ব্যবহার করা পারফিউমটি খুব করে মুনে'র ওড়নায় স্প্রে করে দিয়ে বলে, "অনেকদিন তোমার কাছে আসতে পারব না, এই ওড়না প্লিজ ধুতে দিবে না, এর মাঝে একটা সময় পর্যন্ত তুমি আমাকে অনুভব করবে"।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।