আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কামরুল

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!!

কামরুলের বিয়ে হয়েছিল অনেকটা আকস্মিকভাবে। একদিন বসে বসে একা একা ঘরের কাজকর্ম করছে, এমন সময় কামরুলের মা হুট করে বাসায় এসে বললেন, “আজ থেকে তোর কলেজে যাওয়া বন্ধ”।

কামরুল ঈষৎ কষ্ট পেয়েছিল। কলেজ তাকে দু চারজন সখা দিয়েছে যারা প্রায়ই তাদের বিবাহিত জীবনের সেন্সরড গল্প টল্প বলে কামরুলকে চরমভাবে শিহরিত হতে বাধ্য করে। তাছাড়া কলেজে যাবার পথে যে তিন চারটা বখাটে মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে আর বিশ্রীভাবে শিষ দেয় এদের মধ্যে একজনের শিষ কামরুলের কানে কোকিলের সুমধুর গান হয়ে বাজে।

সুতরাং কলেজে যাওয়া মানা করার মধ্যে কামরুলের জন্য কষ্ট পাবার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে।

জানা গেল, কামরুলের সম্ভাব্য স্ত্রীর অনেক টাকা। অনেক বড় ব্যবসায়ী সে। দেখতে শুনতেও বেশ। বংশও ভালো।

সমস্যা খালি এক কানে একটু বেশি শোনে। আর আগে বেশি না, মাত্র একবার বিয়ে হয়েছিল। ব্যাপার না। মহিলা মানুষ বিয়ে করতেই পারে। একটা বিয়ে করলেই তো আর কারো অন্য পুরুষের দিকে তাকানোর অধিকার কেড়ে নেয়া হয় না, তাই না? তাছাড়া চার বিয়ে পর্যন্ত সরকারের পারমিশন আছে।

সো নো প্রবলেম।

তো একদিন মেয়ে, মেয়ের বাবা, ফুপি আর এক বান্ধবী মিলে কামরুলকে দেখতে এল। কামরুল তাদের সামনে এক লাইনে হেঁটে দেখাল, সুন্দর হাতের লেখায় নিজের নাম লিখে দেখাল, চেহারা দেখাল, নাকের ফুটো দেখাল, কানের ফুটো দেখাল, একত্রিশ পাটি ঝকঝকে সাদা দাঁত দেখাল, নগ্ন হাত দেখাল, পায়ের পাতা দেখাল, চা বানিয়ে খাওয়াল, অন্যান্য খাবার পরিবেশন করে নিজের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঘরের এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

চলে যাবার সময় মেয়ের ফুপি বলে গেল, ছেলে তাদের খুবই পছন্দ হয়েছে। মেয়ের বাবা বলল, আগামী সপ্তাহে বিয়ে।

মেয়ের বান্ধবী বলল, চল বাইরে গিয়ে বিড়ি খাই। মেয়ে বলল, আগেরটা ছিল ভুত। এইটা ফেরেশতা। কামরুল স্বভাবতই এই কথা শুনে লজ্জায় পাকা টমেটো হয়ে গেল।

বিয়ে হল।

কামরুলকে সাজিয়ে গুছিয়ে পুতুল বানিয়ে বিয়েবাড়ির এক ঘরে রেখে দেয়া হল। কামরুলের গায়ে মেয়ের দেয়া দামী লাল শাড়ি, কানে নাকে সোনার গহনা, গলায় ভারী হার, হাতে কয়েকগাছি করে চুড়ি, সিঁথিতে সোনার টিকলি। কামরুলের কানে তার বিবাহিত সখারা একটু পরপরই কিসব যেন বলতে লাগল। কামরুল সেসব নিষিদ্ধ কথাবার্তা শুনে বারবার পাকা টমেটো হয়ে যেতে লাগল।

বাসর রাত এল।

কামরুলের বুকে শঙ্কা। ভয়। আনন্দ। আতঙ্ক। কি হবে? কি হবে?

স্ত্রী এল।

কামরুল থরথর করে কাঁপতে লাগল। স্ত্রী আলতো করে কামরুলের ঘোমটা তুলে ধরল। কামরুল লজ্জায় আবার পাকা টমেটো হয়ে গেল।

অতঃপর কামরুলের প্রথম এবং স্ত্রীর দ্বিতীয় বাসর খুব আনন্দ ফুর্তিতে কেটে গেল। কামরুলের মনে হতে লাগল, বিয়ে জিনিসটা তো ভালোই।

খারাপ না।

আস্তে আস্তে সংসারে অভ্যস্ত হয়ে গেল কামরুল। কামরুলের শ্বশুর তাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, এই আমার আরেকটা ছেলে। নিজের হাতে কামরুলকে সব কাজ শেখাতে লাগলেন তিনি। লক্ষ্মী কামরুলও খুব শীঘ্রই ঘরের কাজকর্ম শিখে গৃহকর্মে সুনিপুণ হয়ে উঠল।



ঘরের কাজ করতে গেলে পড়ালেখা করা যায় না। তাছাড়া ঘরের বর পাড়ার মেয়েদের চোখ জুড়িয়ে কলেজ ফলেজে যাবে এটাও শ্বশুরের পছন্দ ছিল না। তাই তিনি বললেন, “পুরুষ মাইনষের এত পড়ালেখা কইরা কাম নাই। পুরুষ মানুষ ঘরের সৌন্দর্য। পুরুষ মানুষ থাকব ঘরে।

ঘরের কামকাজ জানলেই চলব, এত বইপত্র পড়ন লাগব না”।

বলা বাহুল্য, বিবাহিত জীবনের গোপন রহস্য নিজের কাছেই উন্মোচিত হয়ে গেছে বলে কামরুলও আর তার সখাদের কাছ থেকে নতুন কিছু জানার আগ্রহ পেল না। ধেত, ওদের স্ত্রীগুলোর চেয়ে তার স্ত্রীকে অনেক বেশি সুন্দরী। সুতরাং, কলেজে যাওয়া বন্ধ। দরকার কি?

কামরুল এখন বেশ সুখে আছে।

প্রতিদিন সকালে উঠে সে স্ত্রীর জন্য পরোটা ভাজে। তার স্ত্রী তেল দিয়ে ভাজা পরোটা খেতে খুব পছন্দ করে। কামরুলও মনের সুখে গোল গোল পরোটা বানায় স্ত্রীর জন্য।

পরোটা ভাজা শেষে সে স্ত্রীকে আলতো করে ডাক দিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গায়। গোসলের পানি গরম করে দেয়।

খাওয়ার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। স্ত্রীর খাওয়ার সময়েই চা বানাতে শুরু করে কামরুল। স্ত্রীর খাওয়া শেষ হতে না হতেই চা চলে আসে।

কামরুলের স্ত্রী রেডি হয়ে নিজের অফিসে চলে যায়। সে অনেক ব্যস্ত মানুষ।

তার বাসায় দেয়ার মত এত সময় নেই। কামরুল স্ত্রীর কাপড় ঠিক করে দেয়। কোট পরিয়ে দেয় টাই বেঁধে দেয়। । স্ত্রী চলে গেলে বেশ কিছুক্ষণ তার চলার পথের দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকে।

তারপর শুরু করে ঘর ঝাড়পোঁছ করার কর্মসূচি। সেই সাথে শুরু হয় দুপুরের খাবার রান্না করার প্রস্তুতি।

কামরুল গোসল করে দেড়টার দিকে। গোসল করে টিভিতে স্টার জলসা খুলে “শ্বশুর, জামাই আর কুত্তী” সিরিয়াল দেখা শুরু করে। একটু পরেই নায়কের বাপের চাচার খালুর ফুপার মামার বোনের ছেলের ভাতিজার মেয়েকে রাস্তার জনৈক গুন্ডার চোখ টিপি দেয়ার দৃশ্য চল্লিশ মিনিট ধরে দেখে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি দেয় সে।

এই পর্বে দেখিয়েছে চোখ টিপ দেয়া, আগের পর্বে দেখিয়েছ গুণ্ডার মুখ, তার আগের পর্বে দেখিয়েছে চোখ টিপ দেবার আগে গুণ্ডার মুখে মৃদু হাসি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, এই সিরিয়ালের পাঁচ বিলিয়ন পঞ্চাশ মিলিয়ন দুই হাজার তিনশ একত্রিশতম পর্ব সম্প্রচারিত হয়েছে, অথচ ঘরে ঘরে বাবা ছেলেরা গভীর অভিমানে ছলছল চোখে এবং ঈষৎ অভিমানে মুখ বেঁকিয়ে বলছেন, কাহিনী নাকি এখনও শুরুই হয় নি।

সিরিয়াল দেখে মুখস্থ করে কামরুল তার স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করে। তার স্ত্রী আসে তিনটার দিকে। কামরুল নিজ হাতে স্ত্রীকে খাবার তুলে দেয়, আগ্রহ নিয়ে স্ত্রীর খাওয়া দেখে।

স্ত্রী খেয়েদেয়ে ঘুম দেয়, একটু পরে স্ত্রীর নাক ডাকার বজ্রনিনাদে পারিপার্শ্বিক পৃথিবী প্রকম্পিত হয়। কামরুল একটু হতাশ হয়। ধেত। দুপুরে কি মানুষ একটু রোমান্টিক হতে পারে না? ধেত! লাইফ সাক্স!

স্ত্রী ঘুম থেকে ওঠে সন্ধ্যার সময়। তারপর কিছুক্ষণ হিসাব কিতাবে মত্ত থাকে মেয়েটা।

তখন কামরুল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গভীর আনন্দে স্ত্রীকে লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ্য করে। স্ত্রী কোনদিন এইসব দিকে খেয়াল করে না। সে ব্যস্ত মানুষ। এইসব ছোটখাট দিকে খেয়াল করার সময় তার নেই।

কিন্তু একদিন করে।

স্ত্রী বলে ওঠে, “কি চাও?”

কামরুল বলে ওঠে, “একটা কথা বলতাম”।

“কি কথা?”

কামরুল লজ্জার মাথা খেয়ে বলে, “আচ্ছা আপনার কি মা হতে ইচ্ছা করে না?”

“ধুর। পোলাপান মানেই পেইন। আমার এখন পোলাপানের ঘ্যানঘ্যান সহ্য করার টাইম নাই। এইসব চিন্তা এখন বাদ দাও তো বর।

ইট ক্যান ওয়েট”।

কামরুল হতাশ হয়। রাতে স্ত্রী নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। কামরুল গভীর আগ্রহে সাদা ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশ, যদি এখনই একটাবারের মত স্ত্রীর ঘুম ভাঙত! একটাবারের মত যদি স্ত্রী বলত, “বর, আসো তো তোমাকে একটু আদর করি!” এই কথা বললে কামরুল নিশ্চিত তার সর্বস্ব দিয়ে দিত।

সর্বস্ব। সবকিছু। জীবন যৌবন সব। শরীর মন সব। নিশ্চিত।

নিশ্চিত।

ইশ, কি হত যদি ভুল করে হলেও তার স্ত্রীর হাত তার শরীরে পড়ত?

ইশ, কি হত যদি ভুল করেও স্ত্রীর ঠোঁট তার শরীরে লেগে যেত?

কি হত? কি হত?

কামরুল হতাশ হয়ে উঠে বসে। লাইফ সাক্স। সাক্স। সাক্স।

সাক্স।

কামরুল ঘরের বাইরে বের হয়ে আসে। কেউ তাকে গম্ভীর গলায় বলে, “পারসো? হইসে কিসু?"

কামরুল চমকে ওঠে। বলে, “না ভাইজান”।

“পারবা না।

ঐটা হইল একটা...” অকথ্য গালি ভেসে আসে ওপাশ থেকে।

কামরুল বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কামরুলের ঘাড়ে হাত রাখে কামরুলের চেয়ে আট বছরের বড় একজন মানুষ। একজন পুরুষ। কামরুলের স্ত্রীর প্রথম স্বামী।

পুং-সতীনের রাখা হাত জড়িয়ে ধরে কামরুল। দুজন অতৃপ্ত পুরুষ চেয়ে থাকে অসীম আকাশের দিকে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.