বাংলা আমার দেশ
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদলের নেতা-নেত্রীদের মুখে শুনে এসেছি যে, পচাত্তরে আওয়ামী লীগ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে এদেশে একদলীয় ‘বাকশালী’ শাসনব্যবস্থা কায়েম করে দেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে, যে কারণে বাংলাদেশ ‘কিসিঞ্জারের’ মতে, ‘তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছিল’ ইত্যাদি। যদিও বাংলাদেশ এখন আর একটি ‘তলাহীর ঝুড়ি’ নয় কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্বেও, আসলে সত্যিই কি বিশ্বে সে তার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে কখনো?
লন্ডনে চলমান অলিস্পিক গেইমসের প্রাত্যহিক ফলাফল দেখে বার বার একটি প্রশ্ন বার বার খেঁাচা দিচ্ছে মনকে, আসলেই কি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা খারাপ? যদি খারাপ হয়েই থেকে, তবে চমৎকার ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করে চীনের খেলোয়াররা প্রত্যহ কিভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রঞ্জ পদকগুলো ছিনিয়ে নিয়ে নিচ্ছে আমেরিকার কোটি কোটি ডলারে কেনা খেলোয়ারদেরকেও পেছনে ফেলে? চীন যে কোন বিচারে একটি একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দেশ (আমাদের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হত্যকারী)। কিন্তু চীনের দিকে তাকালে আমরা কি দেখি? শুধু কি খেলাধুলায়? কোথায় পিছিয়ে আছে তারা? বিশ্বের রপ্তানী বাজার এখন বলতে গেলে পুরোটা চীনের দখলে! তাদের এমন কোন পণ্য নেই, যে বিশ্বের সকল দেশ ব্যবহার না করে! তারা তাদের নদী-সমুদ্রে বিশ্বের বৃহত্তর ব্রিজ বানাতে কি বিশ্বব্যাংক বা আইডিবি, জাইকার দারস্থ হয়? তারা কি আদম রপ্তানী করে মধ্যপ্রাচ্যে লেবার-সুইপার হিসেবে? তারা কি বছরের অধিকাংশ কর্মদিবস হরতাল ও যানজটে কাটায়? কোটি কোটি জনসংখ্যাকে চীন কি তার দেশে পুর্নবাসিত করছে না? চীনের রাস্তায় কি ভিক্ষুক বিরক্ত করে মানুষকে প্রতিনিয়ত কিংবা পতিতারা দাঁড়িয়ে থাকে ওভারব্রিজে খন্দেরের আশায়? তারা কি চাল-ডাল, তেল-নুনসহ আমদানী করে ভোগ্যপণ্য তাদের সাধারণ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে? সামরিক শক্তিতে চীন কি খাটো? প্রশ্নগুলোর জবাব হচ্ছে, যে কোন বিচারে চীন এখন পৃথিবীর উন্নততর একটি দেশ, যদিও দেশটি একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে অনেকদিন থেকে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মতে, চীনে মানুষের মানবাধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই!
আর আমরা? বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছি ঘুষ নির্ভর সেকেলে আমলাতন্ত্র, মারাত্মক অপচয়মূলক সরকারী কর্মকান্ড, হরতাল, লুটপাট, ভাংচুর, ভেজাল, দুর্নীতি, যানজট, মূলবোধহীন ভোগবাদী মানসিকতা, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ আরো কত কি প্রতিনিয়ত। হরতাল না করতে চাইলে তাকে আগুণে পুরিয়ে দেয়ার ঘটনাও এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে মানুষ দেখতে পায়, মানে গণতন্ত্রের নামে হরতাল ডেকে জনগণকে তা পালনে বাধ্য করা হয়, যদি তা জনগণ পছন্দ না করে তবুও।
বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র প্রচলিত, তা অনেকটা স্বার্থবাদী ও ধনীক শ্রেণীর মানে ‘শোষকের গণতন্ত্র’। এখানের গরিব অসচেতন জনগণ কেবল নির্বাচনের দিন ‘একটি ভোট প্রদানের গণতান্ত্রিক অধিকার’ ভোগ করে এবং কখনো কখনো তা-ও ছিনতাই হয়ে যায় (অতীতে তা অনেকবার এদেশের মানুষ দেখেছে)। এদেশে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাও অনেকটা ধনীক শ্রেণীর জন্য। এখানের একজন অর্থবান ব্যক্তি অর্থ দিয়ে তার পক্ষে বড়, বিখ্যাত, কুটতর্কে পারদর্শী ‘বিলাত-ফেরত’ আইনজীবীদের নিয়োগ করতে পারলেও, একজন ভূমিহীন কৃষক তা পারেনা, যে কারণে অর্থবানের পক্ষে রায় চয়ে যায় যৌক্তিক কারণেই। এদেশের গণতান্ত্রিক আইনে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার করে ফাঁসি কার্যকর করতেও ৩০/৩৫ বছর চলে যায়।
অনেক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরা বর্ণিত বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করে, তাদের প্রদত্ত শাস্তি উচ্চ আদালতে রহিত করতে সমর্থ হন (নিকট অতীতে যা আমরা দেখেছি), ‘দুদক’ ব্যর্থ আস্ফালন করে করে ক্লান্ত হয় কিন্তু দুর্নীতি সংক্রামক রোগের মত মহামারী আকার ধারণ করে। বহুদলীয় অবাধ গণতন্ত্রের জন্যেই এদেশে হু-হু করে জনসংখ্যা বেড়ে গিয়ে দেশকে ‘কার্যত অচল’ করে দিলেও, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়না ‘জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারে’র কারণে, আবার সাংবিধানিকভাবে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হলেও, ধর্মীয় কারণে অনেক নারী সম্পদে অর্ধেক অধিকার, আবার অন্য ধর্মাবলম্বী নারীরা সম্পদে ভাগ পায় পুরুষের তুলনায় ০% ভাগ। কিন্তু একদলীয় শাসনে শাসিত চীনে এ সমস্যা নেই বরং সর্বত্র নারী পুরুষের অধিকার সমান। চীনের মানুষকে ‘রুট-রুটির’ জন্যে ‘পতিতাবৃত্তি’ বা ‘ভিক্ষাবৃত্তির’ মত পেশা গ্রহণ করতে হয় না, যা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রায় সকল দেশে বিদ্যমান। তাই সেখানের নারীরা (এবং পুরুষেরাও) আমাদের বহুদলীয় গণতন্ত্রের চেয়ে স্বাধীন নয় কি? কারণ স্বাধীনতা মানে হচ্ছে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান, একটি সুন্দর ভবিষ্যত, যা বঙ্গবন্ধুর ‘কুখ্যাত বাকশাল’হীন ৪০-বছরের শাসনে থেকেও এদেশের কোটি কোটি মানুষ এখনো পায়নি, পক্ষান্তরে চীনের মানুষ পেয়েছে ‘একদলীয়’ অনেকটা বাকশালী কায়দার শাসনে।
এ দেশের অধিকাংশ মানুষই এখন হারে হারে টের পাচ্ছে যে, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ (বাংলাদেশ স্টাইল) কাকে বলে এবং সাধারণ মানুষের প্রাপ্তি এ গণতন্ত্রে আসলে কি?
এক্ষেত্রে এটি বলা যাবে না, যে একদলীয় হলেই শাসন ব্যবস্থা ‘খারাপ’ হবে এবং বহুদলীয় হলেই ‘ভাল’ হবে। আসলে আধুনিক বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্যে অনকুল দেশগুলো হচ্ছে ইউরোপ, কানাডা, নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মত শিক্ষেত, সচেতন, উন্নত এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলো। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ৮০% মানুষ গ্রামে বাস করে, গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী ৮০% মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের জন্যে উন্নয়ন কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি হওয়ার কথা গ্রাম কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে? আমাদের উন্নয়ন মূলত শহর কেন্দ্রিক। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ‘সংখ্যাধিক্যের গণতন্ত্রের’ নামে এদেশে ধনতান্ত্রিক সুবিধাবাদীর গণতন্ত্রই চলছে। আমাদের দেশেও বহুদলীয় গণতন্ত্র কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, যখন আমরা বর্ণিত দেশগুলোর মত শিক্ষেত-সচেতন-উন্নত হব, গণতন্ত্রকে ভালভাবে বুঝতে পারবো।
বর্তমান বাংলাদেশের মত নানাবিধ সমস্যায় আকীর্ণ দেশের জন্যে আপাতত ‘সীমিত গণতন্ত্র’ই দেশের জন্যে কল্যাণকর হতে পারে। আমরা এখন অক্টোপাসের মত নানাবিধ সমস্যা তথা জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, বিদ্যুৎ, পানি, দুর্নীতি, ঘুষ, যৌতুক ইত্যাদি বহুপদী সমস্যায় আক্রান্ত, তা থেকে প্রচলিত গণতন্ত্র আমাদের উদ্ধার করতে পারছে না। এ থেকে উদ্ধারের জন্যে দেশে দরকার প্রচলিত ‘রিল্যাক্স’ আইনের পরিবর্তে ‘কঠোর আইন’ যা একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় মূলত থাকে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশকে বাঁচানোর জন্যে কঠোর আইনের বিকল্প নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়. পরীক্ষা হলে একজন পরিদর্শকের হাতে থাকে ‘অসীম ক্ষমতা’।
সে যে কোন পরীক্ষার্থীকে নকল করা, কথা বলা বা দেখাদেখি, এমনকি পরিদর্শকের সঙ্গে অসদাচরণের জন্যে তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার, পরীক্ষা বাতিল বা পুলিশের কাছে সোপর্দ করতে পারে, এ জন্যে তাকে বা অন্য কাউকে দিয়ে তদন্ত, অভিযোগ গঠন, আলামত, স্বাক্ষী ইত্যাদি জোগারের প্রয়োজন হয়না। যে কারণে পাবলিক পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোও অত্যন্ত শৃঙখলার সঙ্গে কক্ষ পরিদর্শকগণ পরিচালনা করতে পারেন এবং তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাউকে অন্যায়ভাবে বর্ণিত শাস্তি প্রদান করেছেন বলে শোনা যায়নি। অপর পক্ষে ‘গণতান্ত্রিক ট্রাফিক আইন’ হচ্ছে, গাড়ির একজন চালক বাম লেন ইচ্ছাকৃত বন্ধ করে ‘হাজারো’ মানুষকে কষ্ট দিলেও, পুলিশ কেবল তার নামে একটি সাধারণ ‘মামলা’ দিতে পারে, যে মামলাটি আদালতে স্বাক্ষী-প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করা খুব একটা সম্ভব হয়না বলে, চালকরা প্রতিনিয়ত পুলিশের চোখের সামনেই একই অপরাধ বার বার করে যাচ্ছে। যে কারণে সিঙ্গাপুরের মত আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশেও ‘বেত-মারার’ মধ্যযুগীয় আইন বহাল করা হয়েছে বৃহত্তর জনস্বার্থে।
প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনায় থাকলেও এ দেশে ‘বাকশাল’ বা ‘বাকশালী শাসন ব্যবস্থা’ কখনো কায়েম বা বাস্তবায়িত হয়নি, এমনকি ‘পরীক্ষামূলকও’ নয়।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে পচাত্তরের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ‘গণতন্ত্র’ মানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই ছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নানা ছদ্মাবরণে শাসরিক শাসন এবং পরবর্তীতে কথিত ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ প্রবর্তিত হয়ে অদ্যাবধি এদেশে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ই প্রচলিত আছে। অর্থাৎ দীর্ঘ প্রায় ৪১-বছর আমরা অনেকটা ‘গণতন্ত্রে’র মধ্যে বসবাস করেও, একদলীয় বাকশাল-কে গালি দেয়া ছাড়া, জনভারাক্রান্ত এ দেশের উন্নয়নে আর চোখে পড়ার মত কি কি অর্জন করেছি, তা রীতিমত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ‘গবেষণার বিষয়’। আসলে তথাকথিত ‘বহুদলীয়’ গণতন্ত্র নামক ‘দুষ্টচক্রে’ আমরা কেবল ঘুরপাক খাচ্ছি, দেশের কোন উন্নতি করতে পারছি না।
আসলে আমাদের উন্নয়নের জন্যে, ১৬-কোটি মানুষকে বিশ্বে মানুষের মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে হলে চীনের নীতি অনুসরণ করা যেতে পারে ‘বাংলাদেশ স্টাইলে’।
কারণ জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত চীনের সমস্যা অনেকটা আমাদের মত। যেখানে সব আইন কানুন হচ্ছে দেশের বৃহত্তর কল্যাণে, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে নয়। আমরা উন্নয়নের স্বার্থে হরতাল, ধর্মঘট, গোষ্ঠী স্বার্থের নামে ট্রেড ইউনিয়ন (বাংলাদেশ সংস্করণ), ছাত্র রাজনীতি ইত্যাদি বন্ধ করতে পারলে অবশ্যই দেশের উন্নয়ন ঘটবে। আর বর্ণিত উন্নয়ন ঘটলে, আমাদের সামান্য একটি পদ্মা ব্রিজ বানাতে বিশ্বের ‘গণতান্ত্রিক’ শক্তির কাছে কাকুতি-মিনতি করতে হবেনা, যেমনটা করেনা চীনারা। এ বোধোদয় আমাদের যত তাড়াতাড়ি ঘটবে, ততই আমাদের জন্য কল্যাণকর।
অন্যথায় ৪০-বছর পেছনের মত, আগামী ৮০-বছরও ‘বহুদলীয়’ ওয়েস্ট মিনিস্টার নামক চমকপ্রদ বুলির গণতান্ত্রিক ‘দুষ্টচক্রে’ ঘুরপাক খেলেও, নিজের শিরদঁাড়ায় ভর করে কবে দাঁড়াবে এ জাতি, মনে হয় বর্তমান বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ভবিষ্যত দ্রষ্টা’ও তা বলতে পারবেন না, নিজের ‘ভবিষ্যত গোণা’র সকল যন্ত্রপাতি ব্যয় করেও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।