আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছুঁয়ে কান্নার রং, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া...

আমি আঁধারে তামাশায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙ্গলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে।




হাকিম মাস্টার স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে বসলেন একটি ছোট্ট বইয়ের স্টল নিয়ে। শিক্ষক হিসেবে তিনি পুরোপুরি সার্থক দেখেই লোকে তাকে হাকিম মাস্টার বলে ডাকে। যদিও তার আসল নাম হাকিম জোয়ারদার। ছোট বেলা থেকেই বইয়ের প্রতি অসম্ভব নেশা ছিলো তার।

এটাকে আসলে দোকান বলা যাবেনা। নীলক্ষেতের ফুটপাতে যেমন বই বিক্রেতারা বসে থাকেন, সেরকম দুই ফিট বাই আড়াই ফিট একটি স্টল নিয়ে বসলেন হাকিম মাস্টার। কিন্তু নিজের সব শ্রম তিনি ঢেলে দিচ্ছেন তার বইয়ের দোকানের জন্য। প্রত্যেক লোকের জীবনেই হয়ত এমন একজন নারী আসে, যাকে দেখেই মনে হয়, হ্যাঁ, এই হলো আমার যোগ্য সঙ্গিনী, এর সাথেই আমার জীবন কাটাতে হবে। হাকিম মাস্টারের জীবনে সেই নারী হলো মিথিলা।

মিথিলাও স্কুলে শিক্ষকতা করে কিন্তু তার সবচেয়ে বড় গুন হলো খুব ভালো ছবি আঁকে মেয়েটি। কিন্তু সেসব ছবি শুধুই নিজের মনের তাগিদে আঁকা কখনও তার মাঝে ছবি আঁকা নিয়ে পেশাদারিত্ব মনোভাব দেখা যায়নি। মিথিলা কেবল সুন্দরীই না, খুবই জ্ঞানপিপাসু। হাকিম মাস্টারের জন্য যাকে আদর্শ বললেও কম বলা হবে।

দুপুর বেলাটা মিথিলা ঘরে একাই থাকে।

মিথিলা জানালার পাশে বসে থাকে বিকেলের অপেক্ষায়। আকাশে উড়ে চলা পাখিগুলো সবটাই তার চেনা হয়ে গেছে। ঐযে সাদা রঙের যে পাখিটা উড়ে গিয়ে নিরুদ্দেশ হলো ওটার নাম স্বপ্ন। আর ওইতো কালো রঙের যে পাখিটা উড়ে আসছে ওটার নাম মিথিলা রেখেছে শূন্য। কিন্তু অনেক দিন ধরে দেখেও মেঘগুলোকে আজও তার চেনা হলোনা।

মেঘের মতোই যদি মিথিলার জীবনটা রূপ বদলাত তাহলে কতইনা রঙিন হতো তার জীবন। ভাবতে ভাবতে উদাস দৃষ্টি নিয়ে ফুটপাথে জমে ওঠা হকারদের দিকে তাকায় সে। কত দিন ভেবেছে মাঝের যে বুড়ো মতো লোকটা টি-শার্ট নিয়ে বসেছে তার কাছ থেকে ওই বাদামী রঙের শার্টটা কিনে আনবে। এমন একটি টি-শার্ট শফিকের পরার খুব শখ ছিলো। মোবাইলে রিং বাজছে।

কিন্তু উঠে গিয়ে ফোন কল রিসিভ করতে ইচ্ছে করছেনা। ফোন রিসিভ করলেই হয়ত তার স্কুলের কোন ছাত্র বলবে আচ্ছা ম্যাডাম সোনার তরী কবিতায় কবি যেন কী বোঝাতে চেয়েছেন বলেছিলেন ?

অথচ ক্লাসে কতবার মিথিলা পড়িয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সোনার তরী কবিতায় নিঃসঙ্গ কৃষকের ট্র্যাজেডি বর্ণনার অন্তরালে নিজের সৃষ্টিশীল সত্তার ট্র্যাজেডিকেই ব্যক্ত করেছেন। কৃষক হচ্ছে কবি নিজে অথবা সমগ্র মানব, সোনার ধান হচ্ছে কর্ম ফসল আর সোনার তরী হচ্ছে মহাকাল। কৃষক যেমন তার সব সোনার ধান নিয়ে সোনার তরীতে উঠে বসতে চায় তেমনি সব মানুষই চায় তার সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে সঙ্গে যেন সেও সবার মনে বেঁচে থাকে। কিন্তু নিষ্ঠুর মহাকাল মানুষের সৃষ্টিকর্মকে এক যুগ থেকে আরেক যুগে বহন করে নিয়ে গেলেও ব্যক্তিসত্তাকে ফেলে যায়।

একলা মানুষ শূন্য নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকে মহাকালের গর্ভে বিলীন হওয়ার জন্য। অথচ এই সহজ কথাগুলো ছাত্ররা বুঝতে পারেনা হাজার বার বোঝালেও। তারপর ফোন করে বিরক্ত করে মিথিলাকে আরেকবার বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। সেও ধৈর্য নিয়ে ফোনে বুঝিয়ে দেয় কখনও শিপ্লুকে, কখনও হারুনকে, কখনও বুঝিয়ে দিতে হয় মহসিনকে। কে জানে এখন আবার কাকে বুঝিয়ে দিতে হবে ! ফোন রিসিভ করতেই ভারী কণ্ঠের আওয়াজ।



-মিথিলা বলছেন?
-জী বলছি।
-স্লামুয়ালাইকুম ম্যাডাম, আমি থানা থেকে ওসি সোবহান বলছি। আপনাকে কষ্ট করে একটু থানায় একবার আসতে হবে।
-কেন বলুনতো হঠাত করে আমাকে থানায় প্রয়োজন হলো ?
-জী ম্যাডাম, আমরা আসলে একটি মানিব্যাগ আর সানগ্লাস পেয়েছি। আপনি আসুন এলেই জানতে পারবেন।


-মানিব্যাগ আর সানগ্লাস পাওয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক আমিত কিছুই বুঝতে পারছিনা।
-আপনারা বছর খানেক আগে শফিক নামের এক ব্যাক্তির নিখোঁজ হওয়ার জন্য থানায় একটি রিপোর্ট লিখিয়েছিলেন, মনে পরেছে?
-হ্যাঁ হ্যাঁ মিথিলার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা; আমি আসছি এখনই, আপনারা আমার শফিককে খুঁজে পেয়েছেন ?

ফোন কেটে দিয়ে মিথিলা থানার পথে রওনা হয়। পথে নেমে এসে একটি রিক্সা ঠিক করে তাতে উঠে বসে। একটা সময় কত স্বপ্ন যে সে দেখেছে। রিক্সায় শফিক পাশে বসে থাকবে তার হাত ধরে।

তারপর দুজনে মিলে রোদের মধ্যে ঘুরবে। বিকেল হলে কোথাও বসে দুজনে মিলে ফুচকা আর রং চা খাবে। শফিকের রং চা খুব পছন্দ আর সাথে যদি আদা, লংকা আর লেবু পাতা থাকে তাহলেত কথাই নেই। মিথিলার স্কুলের সামনে একটি দোকানে এমন রং চা পাওয়া যায়। কতবার ভেবেছে শফিক এলে এখানে ওকে নিয়ে এসে দুজনে মিলে প্রতিদিন চা খাবে !

শফিকের সাথে মিথিলার পরিচয় হয় ওর এক চাচাত বোনের বিয়েতে।

সেই থেকে প্রেমের সূচনা। শফিক ঢাকায় থাকে। একটি ছোট খাটো বায়িং হাউস আছে তার। মিথিলা সিরাজগঞ্জে থাকে। এখানে একটি স্কুলে টিচার হিসেবে আছে।

যত স্বপ্ন, ভালোবাসার যত কথা তার সবটাই হতো ফোনে ফোনে। মাসে হয়ত একবার শফিক ছুটি নিয়ে একদিনের জন্য সিরাজগঞ্জ আসত মিথিলার সাথে দেখা করতে। কিন্তু খুব বেশি সময় নিয়ে তারা দেখা করতে পারতনা। পাছে কেউ দেখে ফেললে মিথিলার জন্য ব্যাপারটা খারাপ কিছু হতে পারে ভেবেই লুকিয়ে লুকিয়ে দুজনকে ঘুরতে হতো। কিন্তু ছোট শহরে এভাবে লুকিয়ে ঘুরাটা খুব একটা সম্ভব হতোনা।

অবশেষে তাদের বিয়ে ঠিক হয় পারিবারিক ভাবেই।

-মিথিলা তুমি কিন্তু মোটেও হাতে মেহেদী আঁকবেনা। আমি ওগুলো একদম পছন্দ করিনা।
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। কিন্তু বিয়েতে এটাই নিয়ম মেয়েরা হাতে মেহেদী আঁকে।

মেয়েদের জীবনে এই একটি সময়ইত আসে। তুমি কি চাওনা তোমার মিথিলা তোমার ঘরে সুন্দর করে বউ সেজে আসুক ?
-তা কেন চাইব না।
-তাহলে লক্ষ্মী ছেলের মত এখন শান্ত হও। আর শোন এখন অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পর। কাল কিন্তু অনেক ভোরে রওনা হয়ে যাবে তোমরা।

না হলে দেরী হয়ে যাবে এত দূরের পথ আসতে।
-আরেকটু কথা বলি ?
-না, মোটেই না। এখন আমি ঘুমাবো। কাল অনেক ধকল পোহাতে হবে। এই একটি দিনের জন্য কত অপেক্ষা করে থেকেছি।

কাল থেকে দেখব কত কথা তুমি আমাকে বলতে পার। ঘরে এলে দেখবে আমাকে ভুলেই গেছো। তখন আর আমাকে ভালো লাগবেনা তোমার। আমার সাথে হয়ত কথা বলার ব্যাকুলতাও তোমার এমন থাকবেনা।
-মোটেও না।

আমার ভালোবাসা দিন দিন শুধু বাড়বে। তুমি দেখো, আমি তোমাকে অনেক আদর করব।
-আচ্ছা ! দেখা যাবে ? এখন আমাকে ঘুমাতে দাও প্লীজ লক্ষী!
-হুম ঘুমাও তাহলে !

সকাল থেকেই বাড়িতে আনন্দের ধুম পরেছে। উঠোনে প্যান্ডেল টাঙ্গানো হয়েছে। বাবুর্চিরা রান্না করতে ব্যাস্ত।

পার্লার থেকে মিথিলা বউ সেজে এসেছে। গোলাপি বেনারশি শাড়িতে মিথিলাকে মনে হচ্ছে যেন সদ্য ফোঁটা একটি তাজা গোলাপ ফুল। ধীরে ধীরে মেহমানরা আসতে শুরু করেছে। একদল এসে খেয়েও ফেলেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু বর যাত্রী আসার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা। কয়েকবার ফোন করাও হয়ে গেছে এর মধ্যে। প্রতিবারই শফিকদের বাসা থেকে বলা হচ্ছে এইত চলে আসবে তারা। হ্যাঁ শফিকদের বাড়ি থেকে কয়েকজন এসেছিলেন। তাও গভীর রাতে।

যখন মিথিলাদের পুরো বাড়িতে চলছে শোকের মাতম যেন কিছুক্ষণ আগেই মারাত্মক কোন ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সব কিছু।

শফিক রাতে বাড়িতে ঝগড়া করে বের হয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে কোথাও খোঁজ করে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছেনা। একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। দুই পরিবার থেকেই থানায় ডায়েরী করা হয়েছে। পত্রিকায় ছবি সহ হারানো বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে।

কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ নেই শফিকের। একটি জলজ্যান্ত মানুষের এভাবে বিয়ের দিন হঠাত করে উধাও হয়ে পরাটা কেউ স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেনি। তার উপর প্রেমের বিয়ে। এমন নয় যে ছেলের অমতে বিয়ে দেয়া হচ্ছিল। বরং শফিকের চাপেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিলো।

সেই দিন থেকে আজ প্রায় বছর কেটে গেলো কিন্তু শফিকের আজও কোন সন্ধান নেই। সে আর ফিরে আসেনি। একটা সময় সবাই ধরেই নিলো হয়ত সে আর বেঁচে নেই অথবা বেঁচে থাকলেও আর কোন দিন হয়ত ফিরে আসবেনা। আর ফিরে এলেও এমন একটি ছেলের সাথে মিথিলার কোন সম্পর্ক আর হতে পারেনা।

কিন্তু জীবন থেমে থাকতে পারেনা।

অন্তত সমাজে চলতে হলে বুকের ভেতর অনেক কিছু চাঁপা দিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার নামইত জীবন। জীবনের যাপিত ব্যাঞ্জনা। তারপর মিথিলাকে মানসিক ভাবে ভেঙে পরার হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন হাকিম মাস্টার। মিথিলা নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তবু বুকের ভেতর কোথায় যেন শফিকের প্রতি একটু খানি ভালোবাসা রয়েই যায়।

ভালোবাসার মৃত্যু নেই। হয়ত লুকিয়ে রাখা যায় কাউকে খুশি করতে; কান্না চেপে রাখার মাঝেই সত্যিকারের কল্যান নিহিত থাকে বলেই। মিথিলাও তার পরিবারের দিকটা ভেবেই বিয়ে করে সংসার নামক ব্যাঞ্জনাকে গ্রহন করে। কিন্তু সে ভুল করেনি। স্বামীর কাছ থেকে যা পেয়েছে বরং বিনিময়ে সে তার কিছুই দিতে পারেনি।



থানায় বসে ওসি সোবহান খুব আয়েশ করে সিগারেট টানছে। লোকটার ভেতর সামান্য সৌজন্যতা বোধটুকু নেই। মিথিলাকে সে একবারের জন্যও বসতে বলার প্রয়োজন মনে করলনা। নিজের মনে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। যেন মিথিলাকে সে ডেকেই এনেছে তার সিগারেট টানার এই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখাবে বলেই।



-স্লমুয়ালাইকুম ভাই। আপনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন।
-ও হ্যাঁ ! আপনি মিসেস মিথিলা ?
-জী।
-এই দেখুনত মানিব্যাগ আর সানগ্লাসটি চেনেন কিনা ?

মিথিলা মানিব্যাগটি হাতে নিয়ে খুলে দেখে শফিকের কিছু ভিজিটিং কার্ড রয়েছে তাতে। ভিজিটিং কার্ডে শফিকের ছবি রয়েছে।

মানিব্যাগে রাখা নিজের ছবি দেখতে পেয়ে দুচোখের কোনে অশ্রু নেমে আসে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে মিথিলা জানতে চায় শফিক কোথায়?

ওসি সোবহান তাকে জানায় যে তারা কিছুদিন ধরে হায়দার নামের এক সন্ত্রাসীর খোঁজ করে আসছিলো। অসংখ্য খুনের মামলা রয়েছে তার নামে। শেষটায় চাঁদাবাজি করতে যেয়ে খুন করে বসে আশরাফ নামের এক বিশিষ্ট শিল্পপতীকে। সেই খুনের তদন্ত করতে যেয়ে হায়দারের বাসা থেকে এই মানিব্যাগ আর সানগ্লাসটি তারা উদ্ধার করে।

কিন্তু হায়দারকে ধরা সম্ভব হয়নি। সে তাদের আসার খবর পেয়ে আগেই পালিয়ে যায়। মিথিলা শফিকের মানিব্যাগটি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। থানার ভেতর চার দেয়ালে সেই কান্নার শব্দ প্রতিদ্ধনি হয়ে ফিরে আসছে। সেই শব্দ এতটাই হৃদয় গ্রাহী যে ওসি সোবহানও তার ভেতর কান্না অনুভব করল।

সেই কান্না সৌজন্যতা মূলক নয়। দুই আঙ্গুলের ভাঁজে রাখা সিগারেট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কিন্তু ধোঁয়াগুলো যেন শূন্যতায় কান্নার রং ছুঁয়ে ভালোবাসা পূর্ণ জোছনার ছবি আঁকছে।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।