কালার বাশিঁ হলো বাম বলে শুধু রাধা নাম
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ভাষাতত্ত্বের দিক বিবেচনায়ও এ কাব্যের মূল্য অসাধারণ বলে পণ্ডিতদের অভিমত। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে প্রাচীনযুগের নিদর্শন চর্যাপদের পরে এবং মধ্যযুগের সর্বপ্রথম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আগে অর্থাৎ চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাঝামাঝি সময়ে আর কোন বাংলা কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
মধ্যযুগের প্রথম কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এবং বড়– চন্ডীদাস মধ্যযুগের আদি কবি। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের এক গৃহস্থের গোয়ালঘর থেকে ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দ) বসন্তরঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভ পুঁথি আকারে রক্ষিত এ কাব্য আবিষ্কার করে বাংলা সাহিত্যে যুক্ত করেন এক নতুন অধ্যায়।
ভাগবত প্রভৃতি পুরাণের কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত কাহিনীর অনুসরণে জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের প্রভাব স্বীকার করে এবং লোক সমাজে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণের প্রেমবিষয়ক গ্রাম্য গল্প অবলম্বন করে বড়– চন্ডীদাসের রচিত এ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি বৈষ্ণব মহান্ত শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র-বংশজাত দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অধিকারে রক্ষিত ছিল। পরে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩ সনে) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সমকালে কিংবা কিছু পরে রচিত কৃত্তিবাসের রামায়ণ, মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, বিদ্যাপতির পদাবলী ইত্যাদি কাব্যের প্রাচীন পুঁথি পাওয়া যায়নি। যুগের পরিবর্তনের হাওয়ায় এসবের ভাষা অপেক্ষাকৃত আধুনিক হয়ে পড়েছে। কিন্তু পরবর্তী বৈষ্ণব ভাবধারা ও রস পর্যায়ের সাথে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আদর্শগত কোন মিল ছিল না বরং বিরোধ চলতে থাকায় লোকসমাজে কাব্যটি তেমন প্রচলিত ছিল না।
তাই এর ভাষার কোন পরিবর্তন হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একটি বৈচিত্রপূর্ণ রচনা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথিটি আবি®কৃত হওয়ার পর থেকেই পণ্ডিত মহলে এ কাব্যের জাতি নিয়ে নানা মতপার্থক্য দেখা দেয়। কেউ একে উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ‘জাগের গান’ কেউ বঙ্গের সর্বত্র প্রচলিত ‘ঝুমুর গান’ কেউ আবার ‘ধামালি’র সঙ্গে এর আঙ্গিক সাদৃশ্য আবিষ্কার করেছেন। এ ছাড়া ‘গীতিনাট্য শ্রেণীর গীতিকাব্য’ ‘উক্তি প্রত্যুক্তিমূলক নাট্যকাব্য’ ঘটনা বিবৃতিমূলক ‘আখ্যানকাব্য’ উপন্যাসের উপাদান সমৃদ্ধ কাব্য’ ইত্যাদি নানা অভিধা এর প্রতি যুক্ত করা হয়েছে।
তবে এ কাব্যের নামকরণ সম্পর্কে পণ্ডিতদের সকলেরই অভিমত ‘যথার্থ হয়নি’ এবং রচনাকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। রীতি অনুযায়ী পুঁথির প্রথম দিকে দেবতার প্রশংসা, কবির পরিচয় ও গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হয় এবং শেষের দিকে রচনাকাল ও লিপিকাল লিখিত থাকে। কিন্তু পুঁথিটির প্রথম দিকের দু’টি পাতা, শেষের পাতাটি এবং মধ্যে মধ্যে কিছু পাতা না থাকায় গ্রন্থের নাম ও কবির বিস্তৃত পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। এর ভিতরে কবির ভণিতা থাকলেও কাব্যের নামকরণ ছিল না। কিংবদন্তি অনুসারে এবং কৃষ্ণ লীলা সম্পর্কিত বিষয়বস্তু দেখে সম্পাদক এর নামকরণ করেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’।
কিন্তু পণ্ডিতেরা এর নামকরণে ‘কীর্তন’ শব্দটি যোগ করায় আপত্তি করেছেন। তাদের মতে ‘ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের বিষয়বস্তু ভাব এবং বর্ণনা কোনটির সাথেই কীর্তন কথাটি মানানসই নয়। নাম রূপ ও গুণ সরবে উচ্চারণ করাই হচ্ছে ‘কীর্তন’। তাই ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার মন্তব্য করেছেন, ‘কীর্তন শব্দের একটি অর্থ হইতেছে কীর্তি, খ্যাতি ও যশ বিষয়ক স্তুতিগান। অনন্ত বড়– চন্ডীদাস কৃষ্ণের চরিত্র যতদূর সম্ভব মসীলিপ্ত করিয়া অঙ্কিত করিয়াছেন।
তাহার অঙ্কিত কৃষ্ণ চরিত্রের সঙ্গে প্রেমের কোন সম্বন্ধই নাই, সে শুধু আত্মতৃপ্তি চায়, সে নায়িকাকে শুধু গালাগালিই করে না, ফৌজদারি মোকদ্দমার আসামীর মত সে মায়ের বকুনি খাইয়া নায়িকার নামে দুরপনের কুৎসা ঘোষণা করে, তাহার মনে দয়া নাই, মায়া নাই, সে বহুবার নায়িকাকে উপভোগ করিয়াও তাহার দোষ ত্র“টিই শেষ পর্যন্ত মনে রাখে এবং সে জন্য তাহাকে পরিত্যাগ করে। বসন্ত রঞ্জন বাবুর আবি®কৃত খন্ডিত পুঁথির নাম রাধাকৃষ্ণের ধামালী বলিলে অধিকতর সঙ্গত হয়। ’ গোপাল হালদার বলেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণ যতই আপনার দেবত্বের বড়াই করুক সে ধূর্ত এক গ্রাম্য লম্পট ছাড়া আর কিছুই নয়। ’ কালিদাস রায় বলেছেন, ‘বল প্রয়োগ, ভয় প্রদর্শন, গ্রাম্য ভাষা প্রয়োগ, বর্বরোচিত আচরণের সমাবেশে আলঙ্কারিক বিচারে এই কাব্যে রসাভাস ঘটেছে। ’
ধামালী শব্দটির অর্থ- ‘রঙ্গরস, পরিহাস বাক্য, কৌতুক।
বড়– চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এর নিদর্শন রয়েছে। হিসেব করে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ১২টি স্থানে ধামালী শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। কৃষ্ণ বৃন্দাবনের গোপকিশোর নন্দসুত কৃষ্ণ সাগররাজার কন্যা ও আইহনের পতœী কিশোরী রাধাকে বশীভূত করার চেষ্টা করলে উভয়ের মধ্যে যে উক্তি প্রত্যুক্তি হয়, বড়– চন্ডীদাস তার বিবরণে লিখেছেন ‘রঙ্গে ধামালী বোলে দেব বনমালী। ’ এর প্রেক্ষিতে কাব্যটির নাম ‘রাধাকৃষ্ণের ধামালী’ হতে পারে বলে গবেষকগণ মনে করেন। পুঁথিতে প্রাপ্ত একটি চিরকুটে এই কাব্যের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’।
কিন্তু পণ্ডিতদের বিচার বিশ্লেষণে তাও যথার্থ বলে বিবেচিত হয়নি। তাই কাব্যটি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামেই এখন পরিচিত। তবে এর কবির নাম যে বড়– চন্ডীদাস তাতে কোন সন্দেহ নেই। কবি কাব্যের আদ্যন্ত বড়– চন্ডীদাস ভণিতা ব্যবহার করেছেন। কোথাও কোথাও চন্ডীদাস ভণিতা আছে, কাব্যটিতে সাতবার আছে অনন্ত বড়– চন্ডীদাস।
তবে সব ভণিতার সঙ্গেই বাসলী দেবীর উল্লেখ করা হয়েছে। ভণিতা থেকে অনুমান করা হয় কবি শক্তিদেবী বাসলীর সেবক দিলেন। এ কাব্যে ভাব, ভাষা, উপস্থাপনা পদ্ধতি ও রুচিবোধের যে স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হয় তা কবি বড়– চন্ডীদাসকে পদাবলীর চন্ডীদাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কবি হিসেবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নামকরণ যথাযথ না হলেও এ কাব্যে বহুবিধ বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটেছে। যে সবের আবেদন সুদূরপ্রসারী।
যে সময়ে সাহিত্যে দেব দেবীর স্তুতিগান করা ছাড়া অন্য কিছু চিন্ত করা ছিল অকল্পনীয়, সে সময়ে শ্রীকৃষ্ণকে মানবীয় গুনাবলী দিয়ে মানব প্রেমসম্পর্কিত এ কাব্য বড়– চন্ডীদাসের দূরদর্শী চিন্তার এক অনন্য ফসল এ কথা নির্দিধায় বলা যায়। নাতিদীর্ঘ এ নিবন্ধে কাব্যের বিষয়বস্তুর সবদিকের বিবরণ দেয়ার সুযোগ না থাকায় আমি তার একটি বিষয়েই আলোকপাত করছি। লেখার শুরু থেকেই যার ইঙ্গিত প্রদর্শন করা হয়েছে। তা হলো ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ অর্থাৎ কাব্যটিতে বহুবিধ উল্লেখযোগ্য দিক থাকলেও ‘কীর্তন’ নেই। আছে শুধু কৃষ্ণ।
এ কৃষ্ণ মানবরূপী এক লম্পট কৃষ্ণ। অন্যভাবে বলা যায় এ কাব্যে আধ্যাত্মিকতার লেশমাত্র নেই। এটি নিছক একটি মানবীয় প্রেম কাহিনী।
মধ্যযুগীয় কাব্য সাহিত্য দেবনির্ভর। দেব মাহাত্ম্য কীর্তন বা ধর্মীয় তত্ত্ব ব্যাখ্যাই এ যুগের সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়।
মঙ্গলকাব্যের যুগপর্যন্ত আমরা সাহিত্যের এধারাই লক্ষ্য করি। দেব চরিত্র চিত্রন বা রূপায়নের ক্ষেত্রে কোন কোন যায়গায় হয়ত বা কোন মানব বা মানবী চরিত্র বিকশিত হয়ে উঠেছে কিন্তু সেখানে দেবতাই মুখ্য মানব গৌণ। সাহিত্য ক্ষেত্রে মানবীয় গুণ আরোপ বা মানবিক আবেদন সৃষ্টিতে মঙ্গল কাব্যের যুগে কবি কঙ্কন মুকুন্দরামই সর্বাধিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার ফুল্লরা ও ভাঁড়–দত্ত তাই সমস্ত চন্ডী মাহাত্ম্যকে ম্লান করে আজও সগৌরবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন তারও পূর্ববর্তী কাব্য।
সুতরাং সেখানে যে দেবতা সমস্তটুকু সৃষ্টি প্রয়াসকে অধিকার করে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। এ কাব্যে বর্ণিত হয়েছে কৃষ্ণলীলা মাহাত্ম্য। রাধিকা ও শ্রীকৃষ্ণ লক্ষ্মী ও নারায়ণ। কংস বধের জন্যে দেবতাদের প্রার্থনায় তারা পর জন্ম লাভ করেন। কিন্তু জন্ম লগ্নে কৃষ্ণ তার বিগত জীবন স্মরণ রাখলেও রাধিকা বিস্মৃত হলেন তার সর্ব মাহাত্ম্য ও ঐশ্বর্য।
কৃষ্ণ যশোদা নন্দন হয়েও সপ্তলাখের বাঁশির অধিকারী, কিন্তু শ্রীমতি সাগর গোয়ালার কন্যা, আইহনের পতœী হয়ে সর্বপ্রকার কুলাচারে বন্দিনী।
কৃষ্ণ প্রেম নিবেদন করলেন শ্রীমতির কাছে বড়ায়ির মাধ্যমে। বড়ায়ি জানালেন এ প্রেম বা প্রণয় যে রমণী গ্রহণ করবে তার বিষ্ণুপুরে স্থিতি হবে। কিন্তু রাধিকা একথা মানতে রাজি না। পতি থাকতে যে নারী অন্য পুরুষের ভজন করে সে নারীর জীবন ধিক।
ভুলে গেছেন তিনি বিষ্ণু প্রিয়া লক্ষ্মী নারায়ণের বংশে তার জন্ম, তিনিই হলাদিনী শক্তি, বিস্ময় শক্তির খন্ড অংশ মাত্র।
রাধিকার এই বিস্মৃতিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যকে এক অপরূপ মানবিক রসে সিঞ্চিত করেছে। অন্যদিকে বলা যায়, মধ্যযুগীয় দেবনির্ভর সাহিত্যের মধ্যেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কবি বড়– চন্ডীদাসের ভাবাকাশ সম্পূর্ণ মানবিক। রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের উপজীব্য হলেও এই প্রেম সবদিক থেকেই অলৌকিক অথবা অতিপ্রাকৃত জগতের স্পর্শ থেকে মুক্ত। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা এবং কৃষ্ণ বাস্তব সমাজ পরিবেশের মধ্যে সংস্থাপিত হয়েছে।
সমাজ সীমার অন্তর্গত দুইজন স্ত্রী পুরুষের মতই তাঁদের প্রেম বিহ্বল চিত্ত বিকাশলাভ করেছে। সুতরাং সমাজের অঙ্গ হিসেবে তারা উভয়েই সমাজের প্রচলিত বিধি নিষেধ এবং সামাজিক সম্পর্ক সম্পর্কে সচেতন। অবশ্য এই চেতনা কবির নিজেরই তার মানস প্রকরণই এই চেতনাকে কাব্যের চরিত্রের উপর প্রয়োগ করেছে। কবির নিজস্ব উক্তি ও ভনিতা, বর্ণনা ও চিত্রের মধ্যেও দেখতে পাই কবি গম্ভীর ও সুতীক্ষ্মভাবে তার পারিপার্শ্বিক বস্তু জগতকে অবলোকন করেছেন। সমাজের গতিধারা লক্ষ্য করেছেন।
প্রকৃতির লীলা বৈচিত্র মানুষের চিত্তে কিভাবে রেখাপাত করে তাও কবি অন্তরঙ্গ ভাবে অনুভব করেছেন। তার এই অনুভূতির রূপ রস থেকে সৃষ্ট মানস পটের বর্ণনাচ্ছটায় তিনি সৃষ্টি করেছেন এই প্রেম কাহিনী, কল্পনায় ভাবে, ঐশ্বর্য ও অভিব্যক্তিতে। এই কাহিনী সে জন্যেই মানবিক রসে সিঞ্চিত।
এই মানবিকতা নানা দিক থেকে আস্বাদন করা যেতে পারে। প্রথমত কবির বস্তুনিষ্ট কল্পনা ও মনন।
রাধার রূপ বর্ণনা করেছেন তিনি একান্ত পার্থিব ভোগের দৃষ্টি দিয়ে। অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্য দিয়ে রাধার অঙ্গ না গড়ে পূর্ণ বিকশিত নারীদেহ যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে পুরুষের কামনায় আঘাত করে, সেই ভাবেই বলিষ্ঠ ও নিপুণভাবে কবি রাধাকে এঁকেছেন। যথা-
নীল জলদ সম কুন্তল ভারা;
বেকত বিজুলী শোভে চম্পক মালা॥
শিশত শোভ এ তোর কাম সিন্দুর।
প্রভাত সমএ যেন উয়িগেল মূর॥
ললাটে তিলক যেহ্ন নব শশিকলা।
কুন্ডল মন্ডিত চারু শ্রবণ মুগলা॥
ক্ষাসা তিলফুল তোর অতী আনুপামা।
গন্ডস্থল শোভিত কমলদল সমা। ইত্যাদি (দান-৭)
এই চিত্র নিঃসন্দেহে পার্থিব কামনার রঙে রঞ্জিত। আর এই পার্থিব সৌন্দর্যের শ্রেষ্টতা উপলব্ধি করেই চাঁদ দুই লাখ যোজন দূরে পালিয়ে যায়। কবির বস্তু চেতনা কত গভীর ও ব্যাপক এই চিত্রটি তারই পরিচায়ক।
কবি শুধু ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য রূপবর্ণনা এবং রাধাকৃষ্ণকে মানবিক গুণে সমন্বিত করেই ক্ষান্ত হননি।
তাদের কামনাকেও মানবিক সম্পদে পরিনত করেছেন, তাদের কামনায় কোনরূপ অলৌকিক সুখানুভতির আনন্দ- সংকেত দেননি। সবই এখানে জৈব দৈহিক ব্যাপার। রাধার একটি স্বপনে-
তিঅজ পহর নিশী
মোঁঞ কাহ্নাঞ্শিুর কৌলে বসী
নেহা নিলো তাহার বদনে।
ঈসত বদন করী মন মোর নিল হরী
বে আকুলী ভয়িলোঁ মদনে ॥
চউঠ পহরে কাহ্ন
করিল আধর পান
মোর ভৈল রতিরস আশে।
দারুন কোকিল নাদে
ভাঁগিল আহ্মার নিন্দে
গাইল বড়– চন্ডীদাসে ॥ (রাধা বিরহ-২)
এখানে স্বর্গীয় প্রেমের চিহ্ন অনুপস্থিত সুতীব্র কাম চেতনায় আহত একজন মানবী তারই মত বিহ্বল একজন পুরুষের প্রহর গুনছে।
ধাতুর আগমন নির্গমন এবং মানব মনে তার প্রভাব সম্পর্কেও চন্ডীদাস সচেতন। এ ও তার বস্তু চেতনার আর এক দিক। বসন্ত কাল এসেছে চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। প্রিয়তমের স্পর্শে বসন্তের পত্রগুচ্ছের ন্যায় ফুটে উঠবার জন্য মন ব্যাকুল ঃ-
মুকুলিল কুঞ্জ নেআলী। আগ বড়ায়ি।
আনি আর বনমালী॥
দক্ষিণ মলয়া বা অ বহে।
না জান মো কেহ্ন করে গাত্র ॥
ঝাঁট করি, কাহ্নাঞি আনাও।
রতী সুখে রজনী পোহাও ॥- (রাধা বিরহ-৩)
কিন্তু কৃষ্ণের কোন খোঁজ নেই। কৃষ্ণ বসন্তকে বিস্মৃত হলেও রাধা পারছে না। আশায় আশায় বসন্ত যাবে, তারপর গ্রীষ্মপার হয়ে বর্ষা আসবে।
তখন রাধার আর্তনাদ ঃ-
কেমনে বাঞ্চি বোঁ রে বরিষা চারি মাষ।
এভর যৌবন কাহ্ন করিলে নিরাস ॥ (রাধা বিরহ-৬৪)
ভাবের দিক থেকে এই চিত্র অপরূপ। প্রকৃতিলীলা এবং ঋতুর আসা যাওয়ার সঙ্গে কবির সম্পর্ক কত নিবিড়। তার এই সরস বাস্তব কবি মানসই তার রাধা কৃষ্ণকে সমসাময়িক সমাজ জীবনের মধ্যে টেনে এনেছে এবং সর্ববিধ মানবিক গুণে গুণান্বিত করেছে।
কবির ভাষা সম্পদেও আমরা বাস্তবতা খুঁজে পাই।
যে সময়ে ন্যায় ও ব্যাকরণের আলোচনায় ও বিতর্কে সংস্কৃতের আসর মুখর ছিল। সে সময়ে চন্ডীদাস একান্ত লৌকিক ভাষায় কাব্য রচনা করে মানুষের মন জয় করেছেন। এখানে পান্ডিত্যের কচকচি নেই কিন্তু তা হৃদয়ে দাগ কাটে। কেননা এ সহজ মানুষেরই প্রাণের কথা, সরস, সরল ও প্রত্যক্ষ এবং অলংকার বর্জিত। রাধা কৃষ্ণ প্রেমে আকৃষ্ট হওয়ার পূর্বে রাধা কৃষ্ণের মধ্যে যে কথা কাটাকাটি ও বিদ্রুপ বিনিময় হয়েছে, তা সর্বোত্ত ভাবে এই মাটিরই মানুষ রূপে পরস্পরকে সৃষ্টি করেছে।
রাধা একস্থানে কৃষ্ণের প্রেম প্রত্যাখান করে বলেছেনঃ-
বড়ার বহুআরী আহ্মে বড়ার ঝী।
মোর রূপ যৌবনে তোহ্মাতে কী ॥
দেখিল পাকিল বেল গাছের উপরে
আর তিল কাক তাক ভখিতে না পারে॥ (দান-৩)
এখানে লৌকিক ভাবে বক্তব্যটি প্রকাশ পেয়ে কাব্যটিতে অনেক বাস্তবতার মর্যাদা দিয়েছে। প্রত্যাহিক জীবনের এমনি কথোপকথনের অজস্র দৃষ্টান্ত গ্রন্থের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। বিরহ খন্ডে কৃষ্ণ রাধার সমর্পিত যৌবন প্রত্যাখান করে বলেছেনঃ-
এবে কেহ্নে গোয়ালিনী পোড়ে তোর মন।
পোটলী বন্ধিঞা রাখ নহুলী যৌবন ॥ (রাধা বিরহ-২৭)
এটি একটি অত্যন্ত মোটা কথা অথচ কত গভীর অনুভূতি।
কবি চারিপাশের প্রবাহমান জীবন সম্পর্কে কতখানি সতর্ক ছিলেন তা এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কবির মানবিকতার আর একটি দিক রাধা চরিত্র নির্মাণ। রাধা চরিত্র নির্মাণেই কবির বাস্তবতা বোধ সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে।
রাধা সাধারণ গ্রাম্য বালিকা। তার আবাল্য সংস্কার সতীধর্ম।
সে জানে সতী নারীর পতি ভিন্ন গতি নেই। তাই আইহন তার কাছে বীর, সুপুরুষ। কাব্যের প্রথমদিকে তাম্বুল খন্ডেই রাধা ঘৃণা ভরে কৃষ্ণের প্রেম প্রত্যাখান করে বলেছেনঃ-
ঘরের স্বামী মোর সর্বাঙ্গে সুন্দর
আছে সুলক্ষণ দেহা।
নান্দের ঘরের গরু রাখো আল
তা সনে কি মোর নেহা ॥- (তাম্বুল)
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের দুনির্বার আকর্ষণের জয় হল। ধীরে ধীরে রাধা চরিত্রের মনস্তাত্বিক বিকাশ ঘটেছে।
বানখন্ডে কৃষ্ণের বলপূর্বক দৈহিক মিলনের মাধ্যমে একদিকে রাধার কুল চেতনা, সতীত্ব সংস্কার, অন্যদিকে রাধার যৌবন চেতনাও ক্রিয়াশীল। এভাবে দ্বান্দ্বিক উপায়ে রাধা চরিত্রের বিকাশ ঘটেই বিরহ খন্ডে বিরহ জর্জরিত হয়ে রাধা বলেছে-
এ ধন যৌবন বড়ায়ি সবঈ আমার।
ছিন্ডিআঁ পেলাইবো সজ মুকুতার হার ॥
মুছিআ পেলায়িবো মোয়ে সিথের সিন্দুর।
বস্থা বলয়া মো করিবো শংখচুর ॥- (বিরহ-৫)
রাধা চরিত্র বিকাশের এই মানবিক অনুভূতি, তার কুল চেতনা, সতীত্বের সংস্কার, বাস্তব সংস্কার জ্ঞান ও কাব্যকে মানবিক রসে সিঞ্চিত করে হৃদয়স্পর্শী করে তুলেছে। তাই পদাবলীর রাধাকে দূর থেকে শ্রদ্ধা জানাই কিন্তু হাত দিয়ে স্পর্শ করতে সাহস হয় না।
ভরসা পাই না। মনে হয় এ রাধিকা স্বর্গ বৃন্দাবনের অধিবাসী। ইনি আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা চন্দ্রাবলী আমাদেরই একজন। আমাদের মতো কামনা বাসনা তার আছে।
কিন্তু কুল হারাবার ভয়ও কম নেই। তার ভয়, লজ্জা ক্ষোভ, অসহায় অবস্থা তাকে অধিকতর মানবিক গুণে ভূষিত করেছে।
শ্রীকৃষ্ণ নররূপে নারায়ণ কিন্তু তার স্বর্গীয় ক্ষমতার অলৌকিক ব্যবহার এ কাব্যে আমরা কোথাও দেখতে পাই না। দেবাদিদেব ইচ্ছা করলেই তার সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ করতে পারেন তবু তাকে দেখি সামান্য ভিখারীর ন্যায় চন্দ্রাবলীর দ্বারে প্রার্থী হতে। প্রেমার্থী কৃষ্ণ রাধার ভার বয়েছেন, মাথায় ছাতি ধরেছেন, নৌকায় তাকে পার করেছেন তার জন্য কালি নাগকে প্রাণ তুচ্ছ করে দমন করেছেন।
এমনকি সব রকমে ব্যর্থ হয়ে মুর্খ গ্রাম্য যুবকের মতো রাধিকাকে বশ করবার জন্য তাকে বান মেরেছেন। কৃষ্ণ চরিত্রের এ অক্ষমতা, দুর্বলতা তাকে দেবমাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত করেছে সত্য কিন্তু সাহিত্যে তাকে মানবিক অনুভূতিতে চির ভাস্বর করে রেখেছে।
অনেক সমালোচক তাই শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের নামকরণ নিয়ে বলেছেন, এই কাব্যে কৃষ্ণ আছে সত্য কিন্তু কীর্তন নেই। কাব্যের সুদক্ষ রূপকার বড়– চন্ডীদাস এখানে মানব হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি দিয়ে কৃষ্ণ চরিত্রকে অঙ্কিত করেছেন। প্রেমের জন্য কৃষ্ণ সবত্যাগ, সব দুঃখ স্বীকার করতে প্রস্তুত, দুঃখ ও ক্লেশের ভিতর দিয়ে তার প্রেমের সাধানায় তিনি সিদ্ধি লাভ করেছেন।
তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, কীর্তন না থাকলেও কৃষ্ণ চরিত্র মানবিক রসে সিঞ্চিত হয়ে আমাদের নৈকট্য লাভ করেছে। রাধা ও কৃষ্ণ চরিত্রের মতো বড়ায়ি চরিত্রটিও মানবিক মহিমা লাভ করেছে। বড়ায়ি আমাদের সংসার জীবনের সুন্দর একটি রসময় চরিত্র।
পরিশেষে একথাই বলতে পারি যে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ধর্মীয় কাহিনী ও তার অন্তরালে অবস্থিত ভক্তের মনোজগতের ইস্পিত ভাব অপেক্ষা এর লৌকিক জগৎ ও মানবিক রূপ পরিবেশই এ কাব্যকে অধিকতর হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে।
সাধারণ পাঠক শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কীর্তন নেই বলে আর্তনাদ করে না।
উপরন্ত কৃষ্ণের মাধ্যমে নারী প্রেম লোভী সাধারণ মানবকে দেখে তার প্রতি অধিকতর আকর্ষণ অনুভব করে। রাধাকৃষ্ণের রূপকের মাধ্যমে বড়– চন্ডীদাস তার সমসাময়িক সমাজ জীবনকেই বিধৃত করেছেন। এ পাশবিক আকর্ষণের হাত থেকে যৌবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞা বালিকা মুক্তি কামনায় আর্তনাদ করেছে। তারপর বালিকা যখন যুবতী হল, প্রেম ও দেহ সম্ভোগ সম্পর্কে তার চেতনা জাগলো মনের মানুষ তখন অনেক দূরে। পুরুষের ভ্রমর বৃত্তি তৎকালীন সমাজে নারী জীবনকে কিভাবে লাঞ্চিত করতো কবির অলক্ষ্যে রাধিকার মাধ্যমে সেই লাঞ্চিতা অবহেলিত বাস্তব রমনীই রূপায়িত হয়েছে।
সুতরাং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কীর্তন না থাকলেও, শাশ্বত নর-নারীর জীবনের বেদনার গান এ কাব্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে একে সর্বকালের সাহিত্যের দরবারে স্থায়ী আসন দান করেছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।