সাদ আহাম্মেদ
উনিশ শতকের শেষভাগের গল্প। কানাই পন্ডিত নামে একজন গোড়া ব্রাক্ষ্মণ তার পরিবার নিয়ে অন্তরপুর নামে ছোট্ট এক গ্রামে বসতি গড়ে। কানাই পন্ডিত অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিলেন। বাংগাল বা অবিভক্ত বঙ্গের যে স্বল্পসংখ্যক পন্ডিত শুদ্ধ ভাষায় সংস্কৃত পড়তে পারতেন তার মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। কানাই পন্ডিত খেয়ালী গান গাইতেন, গানের ভাষা ছিলো মৈথিলী।
প্রায়ই গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে তার কাছে শ্রীকৃষ্ণের গল্প শুনতে চাইতো। তিনি কাউকে নিরাশ করতেন না। সুর করে, মাথা নাড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তণের বিরহখন্ড পড়ে শোনাতেন। কানাই পন্ডিতের স্ত্রী ছিলেন প্রিয়বালা। লোকমুখে শোনা যায় তিনি বাংলায় মহাভারতের প্রথম অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বরের বংশধর।
আশ্চর্যের ব্যাপার ছিলো কানাই পন্ডিতের পুরো পরিবার সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেখা চর্যাপদ পড়তে পারতেন, তার ভাষা বুঝতেন। কানাই পন্ডিত বলতো তিনি প্রাচীন কবি কাহ্ণপার বংশধর। তিনি আরো বলতেন, কাহ্ণপা এখনো বেচে আছেন, কিন্তু তিনি ছাড়া আর কেউ তাকে অনুভব করতে পারেনা। পাঠককে সেই অবিনশ্বর আত্নার গল্প আরেকদিন শোনাবো। আজ যে গল্পটা আপনাদের বলবো তা কানাই পন্ডিতের ছেলে কুমার পন্ডিতের।
সে ভালোবেসেছিলো, ভালোবাসতে পেরেছিলো। কি অদ্ভূত, কেউ তার ভালোবাসার গল্পটা কখনও শোনেনি।
উনিশ শতক শেষ হবে হবে, ঠিক তখন কুমারের জন্ম হলো। কানাই পন্ডিতের সমস্ত শরীর সেদিন লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। এমন করে কখনো তার শরীর গরম হয়ে উঠেনি।
তবুও তার সমস্ত মুখে রুপালী আলো খেলা করছে। সে তার সদ্যোজাত সন্তানের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার নাম দিলাম কুমার। রাজার কুমার না হও বাবা, আমার ভাঙ্গা ঘরের বাধ ভাঙ্গা আলোয় ভালোবাসার কুমার হয়ে থাকো”।
কুমারের মা কানাইয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে বলে, “খাইতে দিবো কি? আমরাই তো খাইতে পাইনা। ওই দেখো আমাদের মেয়েটা শুকায় কি অবস্থা।
এতারে এখন কি খাওয়াবো গো?”
কানাই তার স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ব্রক্ষ্মা দেখবে। উপরে বসে আছিন মায়ার দিল নিয়ে। উনি সবাইরে দেখেন”।
কানাই ঠিক পরের দিন ব্রক্ষ্মার বাড়ি রওনা দেয়। প্রিয়বালা আম কাঠ দিয়ে কোন রকমে তার দাহ সারে, তারপর তার ভাঙ্গা ঘরে ফিরে আসে।
দুবাহু জড়িয়ে থাকে মেয়ে জয়ন্তী আর ছেলে কুমার। পথে যেতে যেতে প্রিয়বালার বারবার মনে হচ্ছিলো এ যাত্রা বুঝি আর শেষ হবেনা। তার কন্ঠে সবসময় সুর খেলা করতো, আজ তার মনে হচ্ছে সুর যেন সব কানাই তার আত্নায় বয়ে নিয়ে গেছে। প্রিয়বালাকে কানাই আদর করে রাধা বলে ডাকতো। সখা আজ তাই আকাশ পানে মুখ চেয়ে বলে, “ব্রাক্ষ্মণের মান রেখো বিধাতা।
রাধার কৃষ্ণকে যতনে রেখো, তার সন্তানগুলোরে একবেলা হলেও খেতে দিও”।
কুমারের যখন সাত বছর বয়স তখন একদিন তার মা খেয়াল করলো কুমার সারাদিন তার মাটির ঘরের ছোট্ট উঠোনে বসে বসে গুনগুন করে। মা একদিন চুপিচুপি পাশে যেয়ে বসলো, তারপর পাঁচ বছরের কুমারকে কোলে টেনে বললো, “আমার প্রাণটা কি গায় একটু শুনি তো দেখি?”
কুমার আধো আধো বলে তাকে শুনায়, “আমার সোনার বাংলা। আমি তোমায় ভালোবাসি”।
মা তার ছেলের দিকে চেয়ে থাকে।
তার দু চোখ ভরা মায়ার জল। নয়ন ভরা ভালোবাসা নিয়ে সে তার সন্তানকে জিজ্ঞাসা করে, “এই গান কে শুনাইলো তোমারে কলিজা? বড় হৃদয়ে লাগে যে!”
ছেলে ফিক করে হেসে উঠে বলে, “রবিঠাকুর গাইছে, আমি শুনিগো মা। দূর থেকে শুনি”।
১৯০৬ সালের গল্প বলছি। লর্ড কার্জন সাহেব তখন গোফে তা দিতে দিতে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দেন।
সেইসময় রবিঠাকুর নামে এক বিখ্যাত সাধক কবি তার প্রাসাদ প্রতিম বাড়ির উঠোনে বসে ঠিক কুমারের মত আকাশ পানে চেয়ে নানান কথা ভাবছিলেন। তার হৃদয় তখন বিভক্ত বাংলার শোরগোলে রক্তাক্ত। প্রিয় কালির কলমটা হাতে নিয়ে তিনি বাংলা ভাষায় লিখা শ্রেষ্ঠ গানটা রচনা করলেন –
“কি শোভা কি ছায়াগো, কি স্নেহ কি মায়াগো
কি আচল বিছায়েছো বটের মূলে নদীর কূলে কূলে”
প্রিয়বালা জানতোনা ১৯০৭ সালে প্রথমবার গাওয়া এই গানটা কেমন করে তার ছেলেটা হৃদয়ে পেয়ে গেলো। কুমার, ছোট্ট অন্তরপুর গ্রামের সবুজ ঘাসে খেলা করতো, বসন্ত রাঙ্গা গাছের সবুজ পল্লবে মুখ লুকিয়ে ধরনীর বিশুদ্ধ ভালোবাসা প্রাণভরে গ্রহণ করতো। আর ভালোবাসতো এই বাংলার মাটিকে।
তার যখন আট বছর বয়স তখন তার বোন জয়ন্তী তার বাবার ডাকে সাড়া দেয়। সেরাতটা ছিলো বড়ই অন্ধকার। কুমার তার বোনকে জড়িয়ে ধরে গান গেয়ে শুনাচ্ছিলো। তার গাল নয়নজলে মুছে যাওয়া কাজলের কালিতে লেপ্টে থাকে। কোনদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই।
প্রিয়বালার ভেতরে তখন লজ্জা, নিজের প্রতি ঘৃণা। সে লজ্জা অভাবের, সে ঘৃণা নিজে বেচে থাকার। নিজের একমাত্র বৈধব্যের শাড়িটা বারবার জলে ডুবিয়ে মেয়ের কপালটা মুছে দিচ্ছিলো মায়াবতী মা। চোখ ফেটে তখন জল আসতে চায়, কিন্তু আশা হারালে তো চলবেনা। একটু পর পর কুমার তার মার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “মা মা দিদির গায়ে জ্বর।
দিদিকে জাপটে ধরে থাকো তো। ঠিক হয়ে যাবে”।
বিধাতা সেদিনও তাদের দেখতে পাননি। আবারো প্রিয়বালাকে ভিক্ষা করে আম কাঠ জোগাড় করতে হয়। কুমার বোনের দাহকর্ম দেখতে দেখতে একসময় মাকে বলে, “মা দিদি বলছে কি জানো?”
প্রিয়বালা কারো দিকে তখন তাকাতে পারেনা।
ছেলের মুখ চেপে বলে, “কিছু বলিসনা বুকটা জ্বালা করে”।
কুমার মিনমিন করে বলে, “দিদি অনেক পুতুল পেয়েছে। লাল সবুজ, ভগবান ওরে অনেক দিয়েছে মা”।
১৯২০ সালের কথা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের বছর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ চালু হয়েছে।
কুমার তার ২১ বছর বয়সে সেই অনুষদের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের প্রিয় ছাত্র প্রায়ই নানান গল্প কবিতা লিখে তার শিক্ষকদের তাক লাগিয়ে দিতো। পাঠক কি জানেন প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অনুষদের একজন অধ্যাপক ছিলেন?
কুমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ব্রিটিশবিরোধী সব আন্দোলনগুলো এড়িয়ে চলতো। তার বন্ধু প্রণবকে মাঝে মাঝে বলতো, “এসবে জড়াস না। অন্তরে রক্তের দাগ লাগলে রবিবাবুর মত কবিতা লিখবি কেমন করে?আমার নিঃশ্বাসে থাকুক শুধু সবুজ বাংলার ঘ্রাণ।
ওই সাদাগুলো আর দু দশক পর এমনি সব ছেড়ে দিয়ে যাবে”।
প্রণব মাথা নেড়ে বললো, “ঠিক আছে বাপু। তুই সবুজ সবুজ কবিতা লিখ। আমি ওই ফিরিঙ্গিগুলোর বুকটা একটু চিরে দিয়ে আসি। আমাদের মত এদের ভেতর রক্তটা কি লাল নাকি তা দেখা দরকার।
কিন্তু একটা কথা বলতো, তুই কিভাবে জানলি এরা দু দশক পর ভেগে যাবে?”
কুমার মাথা নাড়ে। তারপর বলে, “আমি অনেক কিছু জানি। অনেক কিছু। তোরা এসব বুঝবিনা”।
কলকাতার বদ্ধ গলির এক বাড়িতে লজিং থাকতো কুমার।
পড়াতো পাপন ঠাকুর নামে অন্ধ এক ছেলেকে। পাপন ঠাকুরের বাবা ছিলেন সেইসময় কলকাতার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, নাম অতুলভক্তি বাড়ুজ্যে। কুমারকে সে বেশ সম্মান করতো। প্রায় সময় তার মাসোহারার সাথে কিছু অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে বলতো, “আপনি ব্রাক্ষ্মণপুত্র। ঠিকমত ভক্তি দেখাতে পারিনি, কিছু অন্তরে নেবেন না”।
পাপন ঠাকুরের একটা বোন ছিলো, পারমিতা। সেসময়ের রক্ষণশীল সমাজে মেয়েদের ঘরের বাহিরে পা দেয়া নিষেধ থাকলেও পারমিতা প্রায়ই বাড়ির সাথে লাগানো বাগানে ঘুরে বেড়াতো, ফুলের ঘ্রাণ নিতো। এক বিকেলে কুমারের সাথে তার চোখাচোখি হয়। সাথে সাথে শাড়িটা মুখের কাছে চেপে ধরে সে বাড়িমুখো হয়। কুমার দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু বলতে চায় যেন।
একসময় পারমিতার কাছে যেয়ে বললো, “আপনি প্রতিদিন কাপড় দিয়ে মুখ গুজে রাখেন। আমি শুধু আপনার চোখগুলো দেখতে পাই। খুব মায়া হয় জানেন। আপনার চোখটা আজ ঠিকমত দেখতে পাইনি, একটু দেখতে দেবেন ঠিক করে?”
পারমিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় শাড়ির আচল মুখ থেকে নামিয়ে এক দৃষ্টিতে কুমারের দিকে চেয়ে থাকে।
তার সমস্ত শরীর তখন কাপছে। পারমিতা ঠিক ভয় পাচ্ছিলোনা, তার ভেতরে তখন যে ঝড় চলছে তার উৎস কুমারের চোখ। ওই চোখে কেমন যেন একটা ভয়ংকর গভীরতা আছে। মনে হয় যেন তা সব জানে, যেন কথা বলতে জানে, যেন ভেতরের আবেগগুলো শুষে নেয়। কুমার কখনো তার মা ছাড়া কাউকে এমন করে দেখেনি।
ব্রাক্ষ্মণপুত্রের চোখ ভরা তখন সীমাহীন আবেগ, অজানা অনুভূতির খেলা। পারমিতা একসময় আস্তে আস্তে বলে, “আমি যাই, আজ যাই। কাল আপনাকে দেখবো তো?”
কুমার হাসিমুখে বললো, “দেখা হবে কাল পরশু এবং আরো হাজার বছর”।
পরদিন কুমার অতুলবাবুর হাত ধরে বলে, “আপনার মেয়েটার বয়স অনেক অল্প। বিদ্যাসাগরের আদর্শে বিশ্বাস থাকলে এভাবে মেয়েটাকে বৈধব্যের অভিশাপে আটকে রাখবেন না।
আমি তাকে বিয়ে করতে চাই”।
অতুলবাবুর মুখ হা হয়ে থাকে। আমতা আমতা করে বলে, “সমাজ কি বলবে?”
কুমার তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো, “পরকালে ঈশ্বর কি বলবে? মেয়েটাকে এমন জীবন্মৃত করার দায় এড়াতে পারবেন?”
বিয়ের রাত কুমার পারমিতার দিকে চেয়ে চেয়েই কাটালো। পারমিতা শুধু একবার জিজ্ঞেস করলো, “এমন করে কি দেখেন?”
কুমার তার মুখে হাত চেপে দিয়ে বললো, “কথা বলোনা, দেবীরে দেখি”।
পারমিতার চোখে জল খেলা করে, সে মনে প্রাণে চাইলো স্বামীর হাতটা যেন এমন করেই তার অধরকে ছুয়ে থাকে।
সেই ১১ বছর বয়সে তার প্রথম স্বামী যখন হারিয়ে যায় তখন থেকে সে ভাবতো, আর কাউকে ভালোবাসবেনা। আর কাউকে দুচোখ দিয়ে দেখবেনা। সেদিন যে দেবের দেখা হয়েছিলো তা তাকে কেমন করে যেন উল্টিয়ে পালটিয়ে দেয়। পারমিতা জানতে পারে কুমার তার বাকী জীবনের আরাধনা।
কুমার বিয়ের কিছুদিন পরই তার বাস্তুভিটায় ফিরে আসে।
সঙ্গে তার স্ত্রী পারমিতা আর তাদের ভালোবাসা। কুমার ছোট্ট একটা স্কুলে পড়াতো আর গান বাঁধতো ঠিক তার পিতা কানাইয়ের মত। পারমিতা রাত জেগে কুমারের গান শুনতো চোখের পলক না ফেলে। মাঝে মাঝে কুমারের হাত ছুয়ে বলতো, “তোমাকে পূজা করতে ইচ্ছে করে খুব। আমার দিকে এমন করে আর তাকিওনা।
ভয় হয়”।
কুমার হাসিমুখে বলতো, “যখন দেশ ডাকবে তখন হারিয়ে যাবো। একটা খুব খারাপ সময় আসবে দেখো। দুই বাংলা আবার ভাগ হয়ে যাবে, এক বাংলায় আমরা থাকবো। আরেক বাংলায় আমাদের অতৃপ্ত আত্না, না শুনতে পাওয়া সংগীত”।
১৯৩০ সালের উত্তপ্ত এক ভারতবর্ষে ফিরে যাই। চারদিকে কানাকানি, গুঞ্জন এক মহান বিদ্রোহের। কিন্তু কেউ জানেনা কি হতে যাচ্ছে। তারা ভগত সিংকে দেখেছে, মৌলানা মনিরুজ্জামানের খেলাফত আন্দোলনের ইতিবৃত্ত জেনেছে। সমগ্র ভারতবর্ষ তখন মুক্তি খুজে পেতে চাইছে।
জায়গায় জায়গায় জাগরণের ডাক, বৃদ্ধ থেকে যুবা সবার একটাই দাবীঃ স্বাধীনতার আস্বাদ। কুমার তখন প্রায়ই কলকাতা ছুটে যেত, একবার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের হাত স্পর্শ করার জন্য। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অন্যতম সদস্য চিত্তরঞ্জন দাশের আজীবন সঙ্গী ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র। সেই সুভাষচন্দ্র ছিলো কুমারের ছোটকালের বন্ধু। ১৯৩০ সালে যখন নেতাজীকে নির্বাসিত করা হয় তখন কুমার আর বসে থাকতে পারেনি।
পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গের যাতায়াত ব্যবস্থা তখন অত্যন্ত জঘণ্য ছিলো। তবুও এক রাতে কুমার কলকাতার পথে রওনা হয়। যাওয়ার আগে পারমিতাকে তার পাশে বসিয়ে বলে, “আমার চোখের দিকে তাকাতে এত ভয় পাও কেন? আমি কি তোমায় কভু বকেছি?”
পারমিতা মাথা নিচু করে বলে, “মনে হয় সব পড়ে ফেলো। আমার অন্তরটা খালি হয়ে যায়। ভয় পাইনা এখন।
কিন্তু কি যেন হয়। একটা কথা জিজ্ঞেস করি? তুমি ঠিক সাধারণ মানুষ নও আমি জানি। ঠিক করে বলো তো তুমি কে? পৃথিবীতে কেমন করে এলে?”
কুমার পারমিতার গালে হাত দিয়ে বলে, “কেমন করে তা তো জানিনা কিন্তু তোমার জন্য এসেছি গো। তোমাকে আকাশের মত ভালোবাসতে। মা পরলোক গেলে খুব ভাবতাম মনের কথা কইবার কেউ থাকবে তো।
তোমাকে বিয়ের আগে প্রতিদিন দেখে মনে হতো, অনেক কথা জমা হয়েছে। এখন ঠিকঠাক করে তোমাকে বলতে হবে”।
পারমিতার দুচোখভরা পানি। তারপর বলে, “আমি জানি তুমি এখন চলে যাবে। কিন্তু কথা দাও ফিরে আসবে?”
কুমার পারমিতার দু চোখে হাত রাখে, তারপর বলে, “বিদায় কালে আমারে দেখো না সখী।
যখন ফিরে আসবো তখন আঁচল দিয়ে আমার ভেজা চোখ মুছিয়ে দিও। যাই তবে?”
পারমিতা চোখ বুজে থাকে, তার মনে হচ্ছে কুমার আর ফিরে আসবেনা। কখনও না। ভয়ে তার হৃদয় কেপে উঠে। এই মানুষটাকে কিছুক্ষণ না দেখলেই তার ভেতরটা অস্থির হয়ে যায়।
কুমার যখন কলকাতা পৌছায় তখন চারদিকে থমথমে পরিবেশ। শহরে কতিপয় বাঙ্গালী যুবক গোপন সমাবেশ করছে। পার্ক টাউনের দিকে একটি আধা ধসে পড়া বাড়িতে আজ সেই ঐতিহসিক সমাবেশ, সেটাই কুমারের গন্থব্য। সেথায় তার বন্ধু প্রণব বাস করে। না জীবিত প্রণব না, তার আত্না।
প্রণবকে যখন বিক্ষোভ মিছিলে গুলি করে মারা হয় তখন কুমার কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত সাহিত্য সাময়িকী পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে খুব আবেগঘন এক বক্তৃতা দিচ্ছিলো সে। হঠাৎ করে খবর পায় প্রণব গুলি খেয়েছে, সেই অবস্থাতেই ফিরিঙ্গি বাবুরা তাকে থানায় ধরে নিয়ে গেছে। প্রণবের লাশটাও দাহ করার জন্য তারা ফেরত দেয়নি। পার্ক টাউনের থানার সামনে কতিপয় তখনও বেচে থাকা বাঙ্গালী বুক ভরা আকাংক্ষা নিয়ে অপেক্ষারত ছিলো।
কুমার তাদের মধ্যে একজন ছিলো। সেদিন তাদের খুব মারা হয়েছিলো, খুব। কুমার যখন মাটিতে শুয়ে ফিরিঙ্গির লাথি খাচ্ছিলো, তখন তার চোখ ভরা ঘৃণা। ফিরিঙ্গি ক্লান্ত হয়ে যখন চিৎকার করে বলছিলো, bloody beggars তখন কুমার অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “I swear I will show you how to beg mercy for life.”
কুমার খুব ওতপ্রোতভাবে ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে গেলো। চিত্তরঞ্জন দাস অথবা নেতাজী সুভাষ সবাই তাকে খুব স্নেহ করতো।
কুমারকে বলতো, বাংলার পাখি। বিদ্রোহী পাখি। কুমার অস্ত্রচালনা শিখেছিলো, বোমা বানাতে শিখেছিলো। কিভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয় তাও শিখেছিলো। তার প্রিয় গান ছিলো, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
রবি ঠাকুরকে পাশে বসিয়ে একদিন সে গানটা গেয়ে শুনায়। রবি ঠাকুর গান শেষে বাচ্চাদের মত হাততালি দিয়ে বলেছিলো, “বাহ! বেশ গাও তো”।
সেসিন যখন পার্ক টাউনের বাড়িতে কুমার পৌছালো চারদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো। সে খেয়াল করলো, বাসার ভেতর খুব গুমোট পরিবেশ। নিখিল, আলমগীর, তপেশ সবাই খুব চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
কুমার সবার দিকে তাকিয়ে আদাব জানিয়ে বললো, “কাল থানা ঘেরাও করবো। যে আগুনটা ওই ফিরিঙ্গিদের জালিমশালায় জ্বলবে সেটা যেন হয় তোমাদের বুকের আগুন। মনে রাখবে, ওরা আমাদের কেউ না। আমরাই শুধু আমাদের। ওই থানার অফিসার বেকনের গায়ে কেউ হাত দেবেনা।
আমি তাকে চাই, আমার সামনে চাই। কোন মানুষ মারা চলবেনা। একজনও না”।
১৯৩০ সালের সেই সময় মোহনদাস গান্ধী নামের একজন দেবপুরুষ লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা সেই সময় প্রথম ভারত উপমহাদেশের মানুষকে ভয় পেতে শুরু করে।
তারা বুঝতে পারে, এরা পরাধীন থাকার মত জাতি নয়। আজ হোক, কাল হোক দেশ এদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। কুমার ঠিক সে বছরেই মাত্র ১৭ জন স্বাধীনচেতা বাঙ্গালীকে নিয়ে পার্ক টাউন থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। অফিসার বেকন যাকে সে ক্ষমা চাওয়ার দীক্ষা দেবে বলেছিলো, সেও সেই আগুনে দগ্ধ হয়েছিলো। কুমার আগুনে দগ্ধ হওয়া বেকনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছিলো, তোমাদের এদেশ ছাড়তে হবে।
এটা আমার পবিত্র ভূমি, এটা আমার সোনার বাংলা।
ওই ঘটনার তিনদিন পর পুরো কলকাতায় থমথমে পরিবেশ। ঢাকা-কলকাতার মত প্রধাণ শহরগুলোতে ইংরেজরা জোরদার পাহাড়া বসায়। কুমার আর তার সংগীরা তখন পালিয়ে পালিয়ে আছে। তাদের এরপরের লক্ষ্য শিয়ালদহ রেলস্টেশন।
দার্জিলিং মেইলট্রেনটি শিলিগুড়ি যাওয়ার পথে তারা আগুন ধরিয়ে দেবে বলে ঠিক করে। যখন কুমার ও তার দল খুব ভোরে একত্রিত হয় স্টেশনের সামনে কুমার সবার হাত ধরে বলে, “আজ আমরা মাত্র গুটিকয়েক। কিন্তু একদিন সমগ্র দেশ জাগবে। মনে রেখো আইরিশদের কথা। তাদের আন্দোলনটা শুরু হয়েছিলো কতক কৃষকদের নিয়ে।
আজ ওদের পুরো জাতিটা আন্দোলন করছে, ওরা শিখে গেছে নিজের মত বাঁচতে। আমরা মোহনদাস গান্ধীর নিরস্ত্র আন্দোলনকে যেমন সম্মান জানাবো, তেমন করে ভগত সিং বা রাজগুরু এর মত ইংরেজদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে প্রতিবাদ করবো। মনে রেখো, যারা আমাদের পশু মনে করে, মানুষ হিসেবে সম্মান দেয়না আমাদের কাছেও তারা শুধুই পশু। যে রক্ত আমাদের স্বজাতি গত ১৮০ বছর ধরে দিয়েছে, সেই রক্তটার দামটা আমরা ঠিকই তাদের বুঝিয়ে দেবো”।
সন্ধ্যা ছয়টায় শিয়ালদহ থানায় রক্তাক্ত কুমার আর তার অর্ধমৃত ৬ জন সঙ্গী যখন ইংরেজ পুলিশের মার খাচ্ছিলো তখন পারমিতা চোখ বুজে তার স্বামীকে কল্পনা করছিলো।
তার মনে হচ্ছিলো কি যেন হয়েছে, ঘরের প্রদীপে তেল নেই। সলতেটা অনেকদিন না জ্বলতে পেরে শুকিয়ে গেছে। রামের মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে সে হাত জোড় করে স্বামীর জন্য প্রার্থনা করে বলে, “আমার কৃষ্ণরে রক্ষা করো। আমি তার একনিষ্ঠ রাধা, তার ভালোবাসার রাধা। যদি সে না ফেরে, তবে আমায়ও না ফেরার দেশে ডাক দিও ভগবান”।
কুমাররা সেদিন একটা ব্যর্থ অপারেশন চালিয়েছিলো। ট্রেনে আগুন দেয়ার আগে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশ অতর্কিত তাদের উপর হামলা চালায়। ১০ জন সেখানেই গুলি খেয়ে মারা যায়। বাকিদের রাস্তায় হেচড়াতে হেচড়াতে থানায় নিয়ে যায় থানার ইনচার্জ রেভলন। কুমারের কাছে দাঁড়িয়ে রেভলন বলে, “how do you want to be died?”
কুমারের দুটো চোখ বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু কুমারের মনে হচ্ছিলো যেন সে দেখতে পাচ্ছিলো। আশেপাশের সব যেন দেখতে পাচ্ছে। সে আঙ্গুল তুলে পুব দিকে নির্দেশ করে বলে, “এই দিকে যে সূর্যটা ওঠে সেটা ঠিক আমাদের মত। আমার দেশের মানুষগুলোর বুকে যে আগুনটা জ্বলছে, তার উত্তাপ সূর্যের উত্তাপ থেকে একটুও কম না। আমার মত কয়জনকে মারবে”।
কুমারের মুখের দিকে রেভলন তাকিয়ে থাকে, এবং কেন যেন সে একটু একটু ভয় পেতে থাকে। কুমারের একটা কথাও সে বুঝতে পারেনি, কিন্তু সে জানে কুমার কি বলতে চায়। কুমারের মাথায় যখন সে গুলিটা করে তখন একটা খুব পরিচিত গান সে কুমারের মুখে শুনতে পায়, “মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে শুধার মত”।
পাঠককে এখন নিয়ে যাবো ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ২৫ তারিখ। শাখাওয়াত নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা পাবনা জেলার রাধানগর থানায় সরদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো।
তার নিজের বাড়িটা সুজানগর থানায়, রাধানগরের পাশে। কিন্তু সেটা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। শাখাওয়াতের পরিবারের কেউ বেঁচে ছিলোনা। শাখাওয়াত তার মা, তার বাবা অথবা তার আদরের ছোট বোনের লাশটাও কবর দিতে পারেনি। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার ছাত্র ছিলো।
তার প্রিয় বিষয় Astronomy।
শাখাওয়াত গত সপ্তাহে তার নিজ জেলায় কোম্পানী কমান্ডার সিরাজ ভাইয়ের নেতৃত্বে একটা অপারেশনে যোগ দান করে। কোন একসময় তার বাম হাতের একটা আঙ্গুল গুলিতে উড়ে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার শাখাওয়াত একবারও সেটা খেয়াল করেনি আর যখন খেয়াল করলো তখন তার বাম হাতে আরেকটা গুলি লেগেছে। তবে সেটা কিছু মাংশ খুবলে নিয়েছিলো শুধু।
পাকিস্থানী বাহিনীর একটা ৭-৮ জনের টিম তারা ৪ জন মিলে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়। অপারেশন শেষ করে তারা যখন গভীর রাতে বাড়িতে ফিরছিলো তখন শাখাওয়াত অজ্ঞানপ্রায়। সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে পাবনার বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা জহির ভাই শাখাওয়াতকে বললো, “তুমি কয়েকদিন বিশ্রাম করো। একটা আঙ্গুল তো হারাইলা”।
শাখাওয়াত হুমম জাতীয় একটা শব্দ করে বললো, “আমার নানার বাড়ি রাধানগর।
সেখানে সরদার বাড়ি বলে আমার দূর সম্পর্কের এক আত্নীয়ের বাড়ি আছে। এখান থেকে হাটা দিলে পৌছাতে খুব বেশি হলে ১ ঘন্টা লাগবে। কাল সকালে আমাকে সেখানে একটু পৌছিয়ে দেবেন? আমার হাটার সামর্থ্যও নেই”।
জহির ভাই পাশে বসে বললেন, “ভাই পৌছে দেবো। তোমার কবিতা অনেকদিন শুনিনা, একটা কবিতা বলো তো শুনি”।
শাখাওয়াত চোখ বুজে বললো, “যুদ্ধটাই এখন সবচেয়ে বড় কবিতা জহির ভাই। এক একটা মৃত্যু আমার কবিতায় সুর টেনে দেয়। এই দেখেন ভাই, আমার হাতে যে লাল রক্ত লেগে আছে, এটা দিয়েই এখন বুকের ভিতর কবিতা লিখি”।
খুব সকালে শাখাওয়াত যখন তার সেই আত্নীয়ের বাড়িতে পৌছালো, তখন সবাই খুব ভয়ার্ত চোখে শাখাওয়াতকে দেখতে লাগলো। বাড়ির সবচেয়ে বয়জেষ্ঠা মহিলা আমিনা বেগম কাপা কাপা কন্ঠে বললেন, “যুদ্ধ করি আসছোস নাকি বাপ?”
শাখাওয়াত হাসিমুখে বললো, “রক্ত দিয়া আসছি।
রক্ত নিয়া আসছি। এখন আমারে কিছু খাওন দিবানি দাদী নাকি ফিরত যামু?”
দাদী তার ফোকলা দাঁত বের করে হাসে। আস্তে আস্তে বাড়ির অন্য মেয়েরা এসে শাখাওয়াতকে দেখে যায়, কেউ কেউ তার সংকীর্ণ অবস্থা দেখে হা হুতাশ করে। শাখাওয়াতের মার খালাতো বোনের শ্বশুর বাড়ি এটা। পাঠককে এখন এপ্রিলের ২৭ তারিখের এক জোসনা ভরা রাতের নিষ্ঠুর গল্প বলবো।
শাখাওয়াত সেই রাতে বিশ্ববিদ্যালয় হল ছেড়ে দিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে রাধানগর চলে আসে। তার মা ও বাবা রাধানগর চলে এসেছিলো পাশের থানা সুজানগর ছেড়ে। শাখাওয়াতের বাবা একজন সামান্য কৃষক, সাথে মাঝে মাঝে চলন বিল থেকে মাছ তুলে গঞ্জে বিক্রি করে সংসার চালায়। শাখাওয়াতের নানুরা সেই তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলো। ৭১ এর যুদ্ধে চারদিকে যখন ভাতের মাড়ের হাহাকার শোনা যেতো তখন শাখাওয়াতের বাবা অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজের ১১ বছরের মেয়ে সফুরা ও তার মাকে নিয়ে শাখাওয়াতের নানু বাড়িতে ওঠে।
শাখাওয়াতের নানা মসজিদে নামাজ পড়াতেন। এপ্রিলের ২৭ তারিখ রাতে তিনি যখন এশার নামায পড়িয়ে বাসায় ফিরছিলেন তখন খেয়াল করেন খুব বলশালী কিছু পাকিস্থানী জোয়ান তার বাড়ির ভেতর ঢুকে আছে। শাখাওয়াতের গলায় পাড়া দিয়ে একজন সোলজার ধোয়া খাচ্ছে। শাখাওয়াতের কান্নার শব্দ শুনে তার নানার বুক ফেটে যায়। এই নাতিকে জন্মের পর থেকে নিজের হাতে খাইয়ে দাইয়ে মানুষ করেছেন।
তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় নিজে ঢাকা গিয়ে চারদিন হোটেলে থেকে নাতিকে হলে ঢুকিয়ে তারপর এসেছেন। নাতি তার আদরের সন্তান থেকে কম না। তিনি হাত জোড় করে পাক সেনাদের অফিসার টাইপ একজনের কাছে যেয়ে বললেন, “ইসলামে বলা আছে আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা না ঠেকাইতে। তবুও জান বাচানো ফরজ বই যদি বলেন আপনার কাছে হাত জোড় করি। আমার নাতিটারে ছাড়ি দেন।
সে শহরে পড়াশোনা করে, কালকে মাত্র ঢাকা থেকে আসছে”।
অফিসারের নাম ছিলো বেলাল। অফিসার বেলাল তার সৈন্যকে নির্দেশ দিলেন শাখাওয়াতকে ছেড়ে দিতে। সে তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বিখ্যাত মতি রাজাকারকে উর্দু ভাষায় কি যেন বললেন। মতি রাজাকার তার চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে শাখাওয়াতের নানা আব্দুল আনোয়ার হাফেজকে বললেন, “আপনি ঈমাম সাহেব, মসজিদে নামায পড়ান।
তাই মেজর সাহেব আপনার প্রতি খুশ আছেন। সমস্যা হইলো, আপনার দুই ছেলে যুদ্ধ করে। তাদেরকে আমি বহুবার বুঝাইছি আমার শান্তি কমিটিতে যোগ দিতে, অফিসারদের সেবা করতে। কেন তারা বিপথে গেলো মেজর সাহেব তা জানতে চান”।
হাফেজ সাহেব অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আল্লাহ বলেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে।
আপনারা দেশ রক্ষার নামে মানুষ হত্যা করতেছেন, নারীদের অপমান করতেছেন। আমার ছেলেদের আমি মাথায় দোয়া পড়ে যুদ্ধে যাইতে বলছি। আমি কি সাচ্চা মুসলমানের কাজ করি নাই?”
মেজর বেলাল বেশ ভালোই বাংলা বুঝেন, তিনি হাফেয সাহেবের কথা বেশ ভালো ভাবে বুঝতে পারলেন। তার বুকের ডান পাশের পকেট থেকে সিগারেট বের করে আস্তে আস্তে ইংরেজীতে বললেন, “Time will say.”
এরপর একটা অস্থির নীরবতা পার হলে বেলাল তার অফিসারদের নিয়ে বের হয়ে গেলো। রাজাকার মতি তার পাতলা দাড়ি ভরা গালে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে এক সৈন্যকে শাখাওয়াতের ১১ বছরের বোনটার দিকে নির্দেশ করলো।
শাখাওয়াতের বোনকে যখন চুল ধরে টেনে হিচড়ে নেয়া হচ্ছিলো তখন শাখাওয়াতের ভীত সন্ত্রস্ত পিতা বাধা দিতে যেয়ে বেয়নেটের খোচায় রক্তাক্ত হলো। এক সৈন্য ঠিক তার ডান চোখে বেয়নেটের পুরোটা ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, “সালে ইস্লামকি বাত ফারমাতিহে, গাদ্দারীভি কারতিহে”।
শাখাওয়াতের মা সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন। হাফেয সাহেব চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে অফিসারের সামনে হুমড়িয়ে পড়ে বললেন, “এইভাবে ইসলামকে অপমান কইরেন না। আমার নাতনীর বয়স মাত্র ১০-১১ বছর, তারে অপমান কইরেন না।
আল্লাহ অত্যাচারীর কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র কোরানে লিখছেন। আপনি কি কুরআন শরীফ পড়েন না”।
বেলাল চোখ বড় বড় করে চিৎকার করে বললেন, “I read it daily, one hour at a time. I have not captured her. This is war, I cannot command my soldier to give away all his desires. You all are traitor of Pakistan, Muslim. We have every right to treat you this way”.
মতি রাজাকার যখন বাংলায় মৃদু হেসে হাফেয সাহেবকে মেজর বেলালের কথা বুঝিয়ে বলছিলো তখন জীবনে প্রথমবারের মত সৌম্যতা, শিষ্টতা বজায় রাখা ঈমাম সাহেব চোখ বড় বড় করে বেলালের কলার চেপে ধরে বললেন, “ইসলামের ইতিহাস জানা নাই? বদর যুদ্ধে, উহুদ যুদ্ধের যুদ্ধবন্দীদের সাথে আমার নবীজী কি উপায় করেছিলো তুমি কি জানো?হোনায়েদের যুদ্ধে ছয় হাজার যুদ্ধবন্দীকে বিনা শর্তে একটা চাদর উপহার সহ মুক্তি দেয়া হয়েছিলো এটা কি জানো?শান্তির ধর্ম ইসলামে কোন অমুসলিম নারী, শিশুর গায়ে হাত দেয়াও যে নিষিদ্ধ এটা কি জানো? তোমরা যে যুদ্ধ করতেছো সেটা নিজেদের খায়েশ মেটানোর জন্য। এই যুদ্ধ শুধু আমাদের সাথে করতেছোনা, এই যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে, এই যুদ্ধ মানুষ জাতির বিরুদ্ধে। আল্লাহ তা’লা তোমাদের জন্য কঠিন শাস্তি রাখবেন, মনে রাখিও”।
বেলাল নিজের ছোট রাইফেলটা বের করে নিজ হাতে হাফেয সাহেবকে হত্যা করেন। শাখাওয়াত তখন নানার পাশে হাটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে নানার প্রাণ ভিক্ষা যাচ্ছিলো। অফিসার সাহেব মাঠার টুপিটা ঠিক করে তার সৈন্যদেরকে বললেন, “সাব জায়েজ হ্যায়। ইস্লামকে লিয়ে সাব জায়েজ হ্যায়। চালো”।
শাখাওয়াতের সারা মুখে তার নানার শরীরে রক্ত। সে বুঝতে পারছেনা কেন তাকে কেউ হত্যা করছেনা। তার চোখের সামনে যখন তার নানা বাড়িটা পুড়িয়ে দেয়া হলো তখন সে আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে তার মা কে অনেক বাচানোর চেষ্টা করলো। আশাপাশের লোকজন তাকে আগুন থেকে টেনে হিচড়ে সরালো। এরপর অনেকদিন তার হুশ ছিলোনা।
যেদিন হুশ ফিরলো সেদিন সে প্রথম যে কথাটা বললো তা ছিলো, “সাব জায়েজ হ্যায়”।
শাখাওয়াত রাতে খাওয়ার শেষে আমিনা বেগমকে বললো, “দাদী রোকেয়া কোথায়? ও একবারও আমার সামনে আসলোনা যে”।
দাদী ভয় পেয়ে শাখাওয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো, “এইটা নিয়া পরে কথা কমু। এখন যা ঘুমা”।
শাখাওয়াত মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে দাদীর দিকে।
যুদ্ধ তার ভেতরটাকে জন্তুর মত নিরাবেগ করে তুলেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ আরেকটা ঝড় তার ভেতরটাকে উল্টিয়ে দিলো। রোকেয়া তার তার খালার ননদের মেয়ে। খুব ছোটকালে যখন তার একসাথে বিলের পাশের করিমুন্নেছা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে সুর করে পড়তো ঠিক সেই সময় থেকে শাখাওয়াত রোকেয়াকে কানে কানে বললো, “আমারে বিয়া করিস কিন্তু”।
রোকেয়া বড় হয়, স্কুল একসময় সে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েটির মনটা পড়ে থাকতো কলেজ যাওয়া ছন্নছাড়া ছেলেটার জন্য। প্রতিদিন যখন শাখাওয়াত বিলের পাশের রাস্তাটা দিয়ে হেটে হেটে এডওয়ার্ড কলেজে পড়তে যেতো তখন মেয়েটা চুপি চুপি তাকে দেখতো। তার মনে হতো এই ছেলেটার সাথেই তার বিয়ে হবে। সাথে সাথে আবার তওবা করতো। নামাজে হাত তুলে আল্লাহকে বলতো, “আল্লাহ আমার মনকে পবিত্র করো।
ওর কথা আমারে আর ভাবাইয়োনা, কিন্তু ওর জন্য আমার সব দোয়া বখশাইও। দেখে রাখিও”।
রোকেয়ার একদিন খুব জ্বর হয়। সবাই ভেবেছিলো মেয়েটাকে বুঝি আর বাঁচানো যাবেনা। সারা গায়ে তার কালো কালো ছোপ।
হঠাৎ একদিন হন্ত দন্ত হয়ে শাখাওয়াত ওর ঘরে ঢুকে পড়ে হাপাতে হাপাতে বলে, “তুই আমারে এখন দেখতে যাস না কেন? আমি না বলছি তোকে বিয়া করবো”।
রোকেয়া কোনরকমে মাথায় কাপড় দিয়ে বলে, “অসুখ হইছে একদিনও তো দেখাতে আসলেন না। আপনারে দেখতে ঠেকা পড়ছে”।
সেইসময় সেই কক্ষে রোকেয়ার মা শুধু ছিলো। তিনি মুখ হা করে দুজনের অভিমান শুনছিলেন।
সেই দিনই তিনি শাখাওয়াতের মার সাথে কথা বলে দুজনের বিয়ের কথা ঠিকঠাক করেন।
যেদিন শাখাওয়াতের পুরো পরিবারকে পাকিস্তানী সৈন্যরা হত্যা করে, সেদিন এবং তারপর আরো অনেকদিন রোকেয়া খুব দেখে শুনে রাখতো তাকে। চোখ ছাড়া করতোনা। যেদিন শাখাওয়াত যুদ্ধে যায়, সেদিন রোকেয়া খুব কাদে। সেই কান্না শাখাওয়াতকে সে দেখায়না।
শুধু যাওয়ার আগে হাত ধরে বলে, “তুমি আমার দিকে একটু তাকায় থাকো তো। আমি তোমারে আরেকটু ভালো ভাবে দেখে লই”।
শাখাওয়াত রোকেয়ার হাত ধরে বলে, “আমি আসবো আবার। বুকের আগুনটা একটু থামুক”।
আজ শাখাওয়াতের সেই আকুলতা ভরা চোখের কথা খুব মনে পড়লো, যেই ভালোবাসা রোকেয়া তাকে দেখিয়েছে তার প্রতিদান সে এই সারা জীবনেও কি দিতে পারবে? দাদীর হাত ধরে সে বললো, “বেচে আছে? কোথায়, কবে ধরে নিয়ে গেছে?”
রাতের বেলা সব জড়তা ছেড়ে শাখাওয়াত হাটা দেয়।
তাকে প্রথমে দেখা করতে হবে জহির ভাইয়ের সাথে। পাবনায় সবচেয়ে বড় পাক ক্যাম্প ছিলো সাথিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে। অক্টোবরের ২৭ তারিখ এক রাতে হাতে একটা রাইফেল এবং বুক ভরা আগুন নিয়ে শাখাওয়াত সাথিয়া ক্যাম্পের ভেতর ঢুকে পড়ে। মেজর বেলাল সে সময় চা খাচ্ছিলেন। সৈন্যদের বেশিরভাগ পাশের নারী বন্দীদের নিয়ে উন্নাসিকতায় মত্ত।
বাকিরা প্রস্তুতি নিচ্ছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশের গ্রামটা জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য। শাখাওয়াতের সাথে তখন আরো দশজন মুক্তিকামী বাংগালী। এরা হাতে অস্ত্র ধরেছিলো, এরা জানতো এখন রক্ত দেয়ার সময়। জানতো দেশটাকে সত্যি কেমন করে ভালোবাসতে হয়। মেজর বেলাল কিছু বুঝার আগেই প্রচন্ড গোলাগুলির আওয়াজ পেলো।
তার নিজের হাতে বুকে এবং পিঠেও প্রচন্ড যন্ত্রণা হতে থাকলো। গুলি খাওয়ার অনুভূতিটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো। সে খেয়াল করেনি আজ থেকে ছয়মাস আগে চশমা পড়া যে অসহায় বাংগালীকে তার পায়ের কাছে হাত জোড় করা অবস্থায় রেখে এসেছিলো সে আজ তার সামনে স্টানগান উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাখাওয়াত মেজর বেলালের পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে বেলালের ঠোটেই তা গুজে দেয়। তার খুব ঠান্ডা লাগছিলো কেন জানো।
বেলালের দিকে আস্তে আস্তে তাকিয়ে তাকিয়ে বললো, “আমাকে চেনা যায়?”
বেলাল মাথা নাড়ে। তার মুখে গোঙ্গানীর আওয়াজ আর কিছু উর্দু ভাষার কথোপকথন মিলেমিশ একাকার হয়ে যায়। শাখাওয়াত আস্তে আস্তে বলে, “তোমার একটা নাম আছে। কিন্তু আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকবোনা। তোমাকে নতুন নাম দেবো শূকর।
কারণ তুমি শূকরের মতই নোংরা। ভেতরে ও বাহিরে। আমি তোমার সাথে যা করবো তা মন দিয়ে শুনবে। প্রথমে আমি তোমার চোখ দুটো গালবো। তারপর তোমাকে খাসী বানাবো।
কুরবানী দেয়ার আগে হালাল করে নিতে হয় তাই না? সাব জায়েজ হ্যায়, ঠিক?”
বেলাল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শাখাওয়াতের চোখের দিকে। কোকড়া চুলের প্রায় তার সমান লম্বা শ্যামবর্ণের ছেলেটাকে তার খুব ভয় হতে থাকে। সে জানে, আজ তার শেষ দিন। আর একটু পর তার শেষ নিঃশ্বাস। বেলাল চোখ বন্ধ করে তার মায়ের কথা বাবার কথা ভাবতে থাকে।
মনে মনে বলে, “Am I getting the justice?”
শাখাওয়াত তার কাজ শেষ করে যেখানে নারীদের আটকে রাখা হয়েছিলো সেখানে যায়। তার মনে হচ্ছে রোকেয়া এখনও বেচে আছে। রোকেয়ার আশেপাশে গেলে শাখাওয়াত সবসময় একটা আতরের গন্ধ পেতো। আজও সে সেই আতরের গন্ধটাই পাচ্ছে। বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে সে বললো, “সবাই যার যার জামাগুলো খুলে দেন।
আশেপাশে যেই নারীরেই পান, একজনকে নিয়ে আসেন। এই জামাগুলো নিয়ে ভেতরে যাইতে বলেন তাকে। ভেতরে কোন পাকি হারামী নাই। আমি ফায়ারিং এর সময় সবগু।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।