আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমেছে। মনে হচ্ছে, সমস্ত শহর বৃষ্টিতে ভেসে যাবে। আমি দাঁড়িয়ে আছি কমলাপুর রেলস্টেশনে। এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস আসতে এখনো পনের মিনিট বাকি। একটু পর পর মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, ভৈরবগামী এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস কিছুক্ষণের মধ্যেই তিন নম্বর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াবে।
স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, ট্রেন আসতে এখনো পনের বিশ মিনিট লাগবে। স্টেশন মাস্টারের কথা কেন জানি আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি যখন জিগ্যেস করলাম, ভাই ভৈরবের গাড়ি আসতে কতক্ষণ লাগবে? ভদ্রলোক আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যে, অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, পনের মিনিট লাগবে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে শুনতে পাচ্ছেন না।
আবার এখানে এসে জিগ্যেস করছেন কেন? যান, প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
ইদানীং মানুষগুলো কেমন জানি বদলে যাচ্ছে। একজন আরেকজনকে সন্দেহের চোখে দেখে। সিগারেট ধরানোর জন্যে ম্যাচ চাইলেও বিরক্ত চোখে তাকায়।
পনের মিনিট অনেক সময়।
আমি প্লাটফর্মে একটা পিলারের গোঁড়ায় যাত্রীদের জন্যে বানানো জায়গায় বসে পড়লাম। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। স্টেশনের ওয়েটিংরুমে বসতে পারলে ভাল হত। আরাম করে খাওয়া যেত।
আজকাল রেলস্টেশনে ওয়েটিংরুমে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ওয়েটিংরুম আছে, কিন্তু বসা যায় না। ছিন্নমূল মানুষেরা এসব দখল করে নিয়েছে। দখল করবে না কেন, ওদের তো যাওয়ার অন্য কোনো জায়গা নেই।
আসার সময় ব্যাগে করে পাউরুটি আর কলা নিয়ে এসেছি।
কলাগুলি ঠিক আছে কিনা কে জানে। শনির আখড়া থেকে কমলাপুর আসতে সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগেছে। মানুষের চাপে কলা থেঁতলে গেছে মনে হয়।
ব্যাগ খুলে দেখলাম, কলা পাউরুটি সব ঠিক আছে। কলা আর পাউরুটি দেখার পর কেন জানি আর খেতে ইচ্ছা করছে না।
হঠাৎ ক্ষিধা মরে গেছে।
আমি সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালাম। উসকো চেহারার একটা লোক দূরে দাঁড়িয়ে আড়চোখে আমাকে লক্ষ্য করছে। পকেটমার ধরনের কেউ হবে। স্টেশনে এখন পকেটমারের অভাব নেই।
ঈদের সময় এদের ইনকাম অনেক ভাল হয়। বছর দুই আগে এই কমলাপুরেই এক পকেটমারের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।
তখন অবশ্যি ঈদের সময় ছিল না। আমি কি একটা কাজে জামালপুর যাব। ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছি।
ট্রেন আসছে। দূর থেকে লাইটের আলোয় চোখ অন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা। বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকেছে। এমন সময় টের পেলাম, পাঞ্জাবির পকেটে কেউ হাত দিয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ধরে ফেললাম।
পকেটমার এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল, পারল না। ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মাফ কইরা দেন। ভুল হইছে।
ট্রেন আবার হুইসেল বাজিয়ে দিয়েছে। আমি তার হাত ছেড়ে দিলাম।
কিছু বললাম না।
তিনদিন পর জামালপুর থেকে ফিরে এসে আবার তার সঙ্গে দেখা হল। আমি ট্রেন থেকে নেমে হাঁটছি, পেছন থেকে একটা লোক ব্যাগ ধরে বলল, আমার কাছে দেন। পেছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। সে হেসে বলল, ভয় নাই ভাইজান।
আপনের জিনিস আমি নিমু না।
তুমি কয়েকদিন আগে আমার পকেট মারতে চেয়েছিলে না?
সে মাথা নিচু করে বলল, জে।
আজ আবার কোন মতলবে ব্যাগ টানাটানি করছ?
কোনো মতলবে না। ভাবলাম, আপনেরে একটু আগায়ে দেই।
তোমার নাম কি?
করিম।
আমি তাকে ব্যাগ দিলাম। আশ্চর্য, সে ঠিকঠাক মতো আমার ব্যাগ গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
অনেকদিন করিমের সাথে দেখা হয় না। সে কি বেঁচে আছে না মরে গেছে? এইসব মানুষ বেঁচে থাকলেও কেউ খবর নেয় না, মরে গেলেও নেয় না।
দূরে দাঁড়িয়ে যে লোকটা আমাকে লক্ষ্য করছিল, সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
আমি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে হাত ইশারা করে তাকে ডাকলাম। লোকটা যত কাছে আসছে তাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আচ্ছা, সে করিম নাতো? না করিম না। করিম এত শুকনো না। এই লোক কঙ্কালের মতো শুকনো।
লোকটি কাছে এসে আমাকে সালাম দিল। আমি তার চেহারার দিকে তাকিয়ে ধাক্কার মতো খেলাম। অবাক হয়ে বললাম, করিম তোমার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে?
করিম হেসে বলল, ভাইজান আপনের শইলডা ভাল?
আমি ভাল আছি। তুমি মনে হয় খুব অসুস্থ। কি হয়েছে?
কিছু হয় নাই।
কিছু না হলে এমন শুকিয়ে গেছ কেন?
করিম এতক্ষণ তার দুই হাত পেছনে রেখেছিল। ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিল। আমি চমকে তাকালাম। তার হাত কবজি পর্যন্ত কাটা।
পাপের শাস্তি পাইলাম ভাইজান।
মানে?
এই হাত দিয়া কত মাইনষের জিনিস চুরি করছি। আল্লাহপাক শাস্তি হিসাবে কবজি আলাদা করে দিয়েছেন।
এটা কিভাবে হল?
ভাইজান, আমি যে এখনো বাইচা আছি এইটাই আল্লাহপাকের কারিশমা।
ঘটনাটা কি?
রাইতের বেলায় ইঞ্জিন ঘুরাইতেছিল, আমি ঘুম থেইক্যা উইঠা পেসাব করতে যাইতেছিলাম। আচানক উষ্ঠা খায়া লাইনের উপর পড়ে গেছি।
আমার জানটাই চলে যেত। আল্লাহপাকের অসীম দয়ায় শুধু ডাইন হাতের কবজি গেছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বল কি!
জে ভাইজান।
এখন কি কর?
একটা হাত তো আছে। এই হাতেই কাজকাম করি।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, এখনো চুরি কর?
করিম জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, কি যে কন ভাইজান। চুরি করমু কেন। আল্লাহপাক কবজি আলাদা কইরা সাবধান করছেন। এখন কি আর চুরি করন যায়?
তাহলে কি কর?
কুলির কাম করি। আমি এখন এই ইস্টিশনের নম্বরি কুলি।
ও আচ্ছা।
ভাইজান ট্রেন আইস্যা পড়ছে। চলেন আফনেরে আগায়া দেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি কোন ট্রেনে উঠবো এটা তুমি জান?
করিম লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে বলল, জে।
তুমি জানলে কি করে?
আফনে মাস্টারের লগে কথা বলতেছিলেন তখন শুনেছি।
মাস্টার লোকটা ভালা না।
কেন?
বড়ই বজ্জাত। মানুষরে মানুষ মনে করে না। এই যে আফনে তারে ট্রেনের টাইম জিগাইছেন, এইজন্যে আফনারে সে গালি দিছে।
আমি চুপ করে রইলাম।
গালি দিলে দিতেও পারে। পৃথিবীটা খুব বিচিত্র। একেকজন মানুষ এখানে একেক রকম। আবার একজন মানুষ সকালে এক রকম, বিকালে এক রকম। আবার সন্ধ্যায় আরেক রকম।
সকালের মানুষটার সঙ্গে বিকালের মানুষটার মিল অনেক কম। প্রতিদিনই মানুষ কিছুটা বদলায়। এভাবেই একজন যুবক একদিন হঠাৎ লক্ষ্য করে তার চুল পেকে গেছে। তার নাম উঠে গেছে বুড়োদের খাতায়।
ভাইজান, উঠেন।
আমি ট্রেনে উঠলাম। আমার কপাল ভাল, জানালার পাশে সিট পেয়েছি। ছেলেবেলায় যখনি ট্রেনে কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত হতো আমি ভাবতাম, জানালার পাশে বসতে পারব?
হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি করিম দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। সেই সঙ্গে চারদিকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছেলেবেলায় একবার বিকেলের ট্রেনে করে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম, আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, অনেকটা জায়গা নিয়ে আকাশে গোল হয়ে মেঘ জমেছে।
আচ্ছা, মেঘ কি সব সময় গোল হয়ে জমে?
ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি মাঝে মাঝে খুব বেশি মনে পড়ে। কৈশোরের সময়টাই তো এমন, যা কিছু ঘটে তা সারাজীবন মনে থাকে। একবার ঢাকায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে হাঁটছি হঠাৎ বিস্মিত হয়ে দেখলাম, মাঠের দুর্বা ঘাসের উপর থেকে খুব দ্রুত মেঘের ছায়া সরে যাচ্ছে। অদ্ভুত দৃশ্য।
ভাইজান কি ভৈরব যাবেন?
আমি চমকে তাকালাম।
সামনে বসা ভদ্রলোক কথা বলছেন। ভদ্রলোকের বয়স খুব বেশি মনে হয় না।
জি।
আমিও যাচ্ছি।
ও আচ্ছা।
ভৈরবে কোথায় যাচ্ছেন?
সদরে।
ও আচ্ছা। আমার নাম আজহার উদ্দিন। ঢাকায় একটা বীমা কোম্পানিতে চাকরি করি।
আমি নিজের নাম বললাম না।
কেন জানি বলতে ইচ্ছা হল না। ভদ্রলোকের মনে হয় বেশি কথা বলার অভ্যাস আছে। এই ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কোনো মানে হয় না। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
আজহার সাহেব একটু পর পর আমাকে ডাকছেন, ভাইজান কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? আমি জবাব দিচ্ছি না।
একবার জবাব দিলে পুরো ট্রেনযাত্রা জবাবের উপর থাকতে হবে।
ঘুম আসছে না। একবার ভাবলাম, মুখের উপর থেকে রুমাল সরিয়ে সোজা হয়ে বসব কিনা? ইচ্ছা হল না। চোখ বন্ধ করে রাখতে ভাল লাগছে। আমি মজার কোনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলাম।
আমার জীবনের সবচে মজার স্মৃতি কি? এই মুহূর্তে কোনো স্মৃতি মনে পড়ছে না। একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। অনেকদিন আগের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সেদিনও বৃষ্টি ছিল। শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যা।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। বাতাসের ঝপটায় বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে আমার গায়। আমাদের বাসা তখন আবাসিক এলাকায় ছিল। রাস্তায় কোনো রিক্সা গাড়ি নেই। পথের দুই পাশে বড় বড় গাছ।
একটা কদম গাছে কদম ফুল ধরেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে গাছভর্তি কদমফুল দেখছি। হঠাৎ দেখলাম, একটা কিশোরী খোলা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে দৌড়ে কদম গাছের নিচ দিয়ে চলে গেল। এই দৃশ্যটা এখনো আমার চোখে লেগে আছে। মনে আছে, সেদিন বিষণ্ণ মনে অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
একটা কথা বারবার মনে হচ্ছিল, আহ্ আমি যদি চিত্রকর হতাম।
আজহার সাহেব আমার কল্পনায় বাধা দিলেন। এতক্ষণ তিনি ‘ভাইজান কি ঘুমাচ্ছেন’ বলে চেঁচাচ্ছিলেন। এখন রীতিমতো ‘শুয়োরের বাচ্চা আমারে চিনস’ বলে চিৎকার করছেন। আমি তাড়াতাড়ি মুখের উপর থেকে রুমাল সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
না, তিনি আমাকে গালি দিচ্ছেন না। চানাচুরওয়ালার সাথে তার ঝগড়া বেধে গেছে। বেচারা চানাচুরওয়ালা পাঁচ টাকার চানাচুর এত কম দিয়েছে কেন এই নিয়ে ঝগড়া।
আজহার সাহেবের ঝগড়া শুনে আমি একটা ব্যাপার আবিষ্কার করলাম। এই ভদ্রলোক প্রতিদিন সকালের ট্রেনে ঢাকায় এসে অফিস করেন এবং অফিস শেষ হলে বিকালের ট্রেনে ভৈরবে ফিরে যান।
এটাও কি সম্ভব?
ঝগড়া শেষ করে আজহার সাহেব তার সিটে এসে বসেছেন। আমি হেসে বললাম, নাক ভেঙ্গেছে কার?
আজহার সাহেব হকচকিয়ে গিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভারী গলায় বললাম, এতক্ষণ আপনারা যে ঝগড়া করেছেন এটা কোনো ঝগড়াই হয়নি। ঝগড়া শুরু করতে হয় নাক ফাটাফাটি দিয়ে। আপনাদের কারোই নাক ফাটেনি।
কাজেই আপনারা ঝগড়া শুরুই করতে পারেন নি।
আজহার সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন।
আপনি কি প্রতিদিন ভৈরব থেকে এসে অফিস করেন নাকি?
আজহার সাহেব গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন, জি। নয় বছর ধরে ভৈরব থেকে এসে অফিস করছি। তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তিনি আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কারের মতো কোনো মহাকর্ম করছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মিথ্যে কথা বলছেন নাতো?
না ভাই। মিথ্যা কথা বলব কেন। এই একটা জিনিস আমার ধাতে নেই।
আমি মনে মনে বললাম, যে লোক প্রতিদিন ভৈরব থেকে এসে অফিস করতে পারে তার ধাতে মিথ্যে বলার অভ্যাস না থাকারই কথা।
আজহার সাহেব সিগারেট ধরালেন।
একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নেন ভাই সিগারেট নেন। ঈদের সময় চলে আসলে ট্রেনে বসে সিগারেট ধরাতে পারব না। তাই প্রতিদিন ট্রেনে উঠে আপনার মতো একজনকে সিগারেট খাওয়াই এবং আমি নিজেও একটা খাই।
আমি উত্তর না দিয়ে সিগারেট নিলাম। ট্রেনে বসে সিগারেট ধরিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকার আলাদা আনন্দ আছে।
আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তাই অপেক্ষা করে বসে ছিলাম কখন জাগবেন।
কেন?
আজহার সাহেব হেসে বললেন, সিগারেট খাওয়ার জন্যে।
ও আচ্ছা।
মাঝে মাঝে আপনার মতো বিচিত্র কিছু লোকের সঙ্গে আমার ট্রেনে দেখা হয়?
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, আমার মতো বিচিত্র মানে?
হ্যাঁ, আপনি যেমন আমার সঙ্গে কথা না বলার জন্যে মুখের উপর রুমাল দিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিলেন এরকম অনেকেই করে।
তাই নাকি?
একদিন এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন।
কেন?
আমি তাকে সিগারেট দিয়েছিলাম। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, আপনি আমাকে চেনেন?
আমি বললাম, না।
ভদ্রলোক রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, তাহলে সিগারেট দিলেন কোন আক্কেলে? আমি লজ্জায় জমে গেছি। সেইসঙ্গে ভদ্রলোককে মুগ্ধ করার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত কি করলেন?
কি আর করবো? ভদ্রলোকের সঙ্গে কিছুক্ষণ রাগারাগি করে চুপ করে গেলাম।
তারপর কি হয়েছে?
ঘন্টাখানিক পরে তিনি নিজেই আমাকে বললেন, ভাইজান আপনার কাছে কি সিগারেট আছে?
আমি সিগারেট দিলাম। ভদ্রলোক নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে লাগলেন।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। আজহার সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসে বললেন, ওই ভদ্রলোকের স্মৃতশক্তি খুব দুর্বল ছিল।
আপনি কিভাবে বুঝলেন উনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল ছিল?
সিগারেট শেষ করে ভদ্রলোক আমাকে জিগ্যেস করেছিলেন, ভাইজান আপনার নাম কি? দেখেন, এতক্ষণ আপনার সাথে বসে আছি আর আপনার নাম জিগ্যেস করা হয় নি।
শুধু এইটুকু আচরণ থেকে আপনার ধারণা হল, ভদ্রলোকের স্মৃতিশক্তি অনেক কম ছিল?
হ্যাঁ।
উনি তো ইচ্ছা করেও এমন আচরণ করতে পারেন।
আজহার সাহেব চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন, স্মৃতিশতি কম না হলে উনি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবেন কেন?
এটা আমি কিভাবে বলব। হতে পারে কিছুক্ষণ আগের ঝগড়ার কথা ভুলে আপনার সঙ্গে সহজ হওয়ার জন্যে উনি এটা করেছেন।
আজহার সাহেব কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমারও তাই মনে হচ্ছে। আচ্ছা ভাই, জগতটা এত বিচিত্র কেন?
আমি উদাস গলায় বললাম, জানি না।
জগতটা কেন এত বিচিত্র এটা আমারও প্রশ্ন। প্রকৃতি নিজে বিচিত্র বলেই হয়তো জগত বিচিত্র। এই বিচিত্র জগতে প্রতিদিন অসংখ্য বিচিত্র ঘটনা ঘটছে অথচ আমরা তার খুব কম ঘটনাই দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের ক্ষমতা এখনো পৃথিবী এবং চাঁদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। চাঁদ এবং পৃথিবী ছাড়াও তো অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্র আছে। সেখানে কি হচ্ছে আমরা জানি না।
মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত বিচিত্র। জন্ম এবং মৃত্যু কি কম বিচিত্র? একটা শিশু জন্ম নেয়ার পর শিশুর পরিবার আনন্দে ভাসতে থাকে।
কিন্তু শিশুটি যখন ধীরে ধীরে বড় হয় এবং এক সময় তার মৃত্যু হয় তখন সেই পরিবার মাত্র কিছুদিন শোক বহন করে। আশ্চর্য, এক বছর পর সেই বাসায় গেলে বোঝা যায় না, এখানে একটি মানুষ কিছুদিন আগে জীবিত ছিলেন—এখন নেই। ভদ্রঘরের কোনো শিশু যদি রাস্তা থেকে কোনো জিনিস কুড়িয়ে নিয়ে আসে তার মা বাবা ভীষণ চিন্তিত বোধ করেন। অথচ এই মা বাবা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখেন অসংখ্য শিশু রাস্তায় ঘুমিয়ে আছে। তখন তারা চিন্তিত বোধ করেন না।
আমার কাছে অবাক লাগে, পৃথিবীতে যত মানুষ বেঁচে আছে তারচেয়ে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তারা মাটির নিচে কবরে শুয়ে আছে। এই সত্য আমাদের জীবনযত্রায় কোনো ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না।
আজহার সাহেব আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, কি ভাবছেন?
কিছু না।
মনে হয় কিছু ভাবছেন।
আপনার যা ইচ্ছা মনে করতে থাকুন আমি ঘুমাই।
পকেট থেকে রুমাল বের করে আমি মুখের উপর রাখতে যাচ্ছি, আজহার সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, ঘুমাবেন না ভাই। আপনার সাথে কথা আছে।
আমি সোজা হয়ে বসতে বসতে বললাম, কি কথা বলুন।
গল্প শুনবেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম, গল্প?
হ্যাঁ।
কিসের গল্প?
রাজা-রানির গল্প। এক দেশে ছিল এক রাজা...
আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন?
আজহার সাহেব হেসে বললেন, রসিকতা করছিলাম। আমি একটা সিরিয়াস গল্প জানি। শুনবেন?
আমার গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে না। আজহার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, গল্প বলার জন্যে তিনি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
তার এই উৎসাহ নষ্ট করতে ইচ্ছে হল না। নিরস গলায় বললাম, বলুন আপনার গল্প।
আজহার সাহেব গল্প বলতে শুরু করলেন—
আমি তখন চাকরির খোঁজে নানান জায়গায় ঘুরছি। পেটে ভাত নাই। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে।
পুরান ঢাকার নবাবপুরে একটা মেস ভাড়া করে থাকছি। মাস শেষ হলে মেসের ম্যানেজার আবদুল মিয়া ভাড়া নিতে আসে। আমি মুখ অন্ধকার করে বলি, ভাই কিছু মনে করবেন না, এই মাসের ভাড়া আগামী মাসে ক্লিয়ার করে দিব। এভাবে দিনে দিনে তিন মাসের ভাড়া বাকি পড়ে গেল। আমি তখন আবদুল মিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে বিকেলে মেসে যেতাম না।
একদিন কি মনে করে যেন বিকেলে মেসে গেলাম। কাউন্টারে আবদুল মিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাল আছেন? বলেই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করলাম। আবদুল মিয়া পিছন থেকে ডেকে বলল, আজহার ভাই একটু দাঁড়ান, কথা আছে। আমি শুনেও না শোনার ভান করে ঘরে চলে এলাম এবং ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর আবদুল মিয়া নিজেই উপরে উঠে এল। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল, আজহার ভাই দরজা খুলেন। কথা আছে।
আমি দরজা খুললাম। আবদুল মিয়া ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আপনার সাথে কিছু প্রাইভেট কথা আছে।
আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। বারবার মনে হচ্ছিল, আবদুল মিয়া তিন মাসের বকেয়া ভাড়া চাইবে। সে জানে আমি ভাড়া দিতে পারব না। কাজেই ভাড়া দিতে না পারার অপরাধে সবার সামনে অপমান করে মেস থেকে বের করে দিবে।
সে রকম কিছু হল না।
আবদুল মিয়া সহজ গলায় বলল, আপনি চাকরি পাচ্ছেন না ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।
আমি চুপ করে রইলাম।
চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে একটা কাজ দিতে পারি।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, কি কাজ।
কাউকে বলতে পারবেন না।
বলব না।
আবদুল মিয়া কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সরাসরি বলল, নারী পাচারের ব্যবসা। করবেন? কাঁচা পয়সার কারবার।
আমি চোখ কপালে তুলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আবদুল মিয়া দেখতে খুবই সাধারণ।
তার চেহারা দেখে বোঝা যায় না সে কত বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত।
আবদুল মিয়া আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, আপনি চিন্তা করে দেখেন। আমাকে আস্তে ধীরে জানালেই চলবে।
আমি হা করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আবদুল মিয়া আরেকবার ঝুঁকে পড়ে বলল, কেউ যেন না জানে।
বলেই সামান্য হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আব্দুল মিয়া চলে যাওয়ার পর আমি দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম। একবার ভাবলাম সব কথা পুলিশকে জানাই। পুলিশকে জানালে তারা কিছু করবে এর নিশ্চয়তা নাই। কাজেই মন সায় দিল না।
এই ব্যবসায় ঢুকার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। তখন আমি খুব নীতিবান মানুষ ছিলাম।
আজহার সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, শেষ পর্যন্ত আপনি কি এই ব্যবসায় ঢুকেছিলেন?
আজহার সাহেব হেসে বললেন, ধৈর্য ধরুন। গল্প তো এখনো শুরু হয় নাই। গল্প শুরু হলে সবই জানতে পারবেন।
ভাইজান, চা খাবেন?
আগে গল্প শুরু হোক।
গল্প শুরু হতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে।
আমি রেগে গিয়ে বললাম, আপনি বেশি কথা বলেন। কথা একটু কম বলার চেষ্টা করবেন।
আজহার সাহেব কপাল চুলকাতে চুলকাতে বললেন, আচ্ছা।
গল্প বলুন।
আবদুল মিয়া এর পরে আরো দুইদিন আমার কাছে এসেছিল। কিছু ঠিক করেছি কিনা জিজ্ঞেস করেছে। আমি বলেছি, এসব অন্যায় কাজ আমি কখনো করব না।
আবদুল মিয়া হেসে বলেছে, আগে পেটের চিন্তা করেন।
পেটে ভাত না থাকলে ন্যায় অন্যায়ের কথা মাথায় থাকে না। এই ব্যবসায় ভাল টাকা আসবে। কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে পরে না হয় অন্য কিছু করবেন।
আমি কঠিন গলায় বলেছি, এসব আমি করতে পারব না।
আবদুল মিয়া হতাশ হয়ে চলে গেছে।
এরপর আরো তিন মাস কেটে গেল। মেসে ছয় মাসের ভাড়া বাকি পড়ে গেল। আমি পাগলের মতো চাকরি খুঁজছি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুই টাকা দিয়ে একটা পত্রিকা কিনে আনি। চাকরির পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি।
ভাল কোনো চাকরির বিজ্ঞাপন পেলে কোনো কিছু না ভেবে ইন্টারভিউ দিতে যাই। চাকরি হয় না।
একদিন পত্রিকায় দেখলাম, সিটি কর্পোরেশন থেকে পঞ্চাশজন মেথর চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। আমি সেখানেও ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। ঘুস দিতে না পারায় চাকরি হল না।
সেদিন প্রথম জানলাম, ঘুস ছাড়া কোনো সরকারি চাকরি হয় না। আমার কথা কি আপনার কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে?
আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম, না।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে আবদুল মিয়ার সঙ্গে আবার দেখা হল। আমার মেসঘরে এসে সরাসরি ছয় মাসের বকেয়া ভাড়া চাইল। আমি আগের মতই মুখ অন্ধকার করে বললাম, সামনের মাসে ক্লিয়ার করে দিব।
আবদুল মিয়া এইবার আমার কথায় টলল না। চোখমুখ শক্ত করে বলল, এক সপ্তাহের মধ্যে ভাড়া ক্লিয়ার করে বিদায় হবেন।
আমি অসহায় চোখে তার দিকে তাকালাম।
আবদুল মিয়া ঝাড়া গলায় বলল, কি বলছি বুঝতে পারছেন?
আমি মৃদু গলায় বললাম, হ্যাঁ।
আবদুল মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ওই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ঠিক করেছেন?
মেস ছেড়ে দেয়ার কথা শুনে এমনিতেই আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল।
আমি কঠিন গলায় বললাম, হ্যাঁ।
আবদুল মিয়া অবাক হয়ে বলল, কি ঠিক করলেন?
আমি আগের চেয়েও কঠিন গলায় বললাম, ঠিক করেছি সব কথা পুলিশকে জানাব।
আবদুল মিয়া হো হো করে হেসে উঠল।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হাসছেন কেন? আমি ফাজলামি করছি না। সত্যি সত্যি আমি পুলিশকে জানাব।
পুলিশকে জনিয়ে কোনো লাভ হবে না। যে টাকা আমাদের ইনকাম হয় পুলিশের বড় কর্তাদের অনেকেই তার ভাগ পায়।
আমি চুপ করে রইলাম।
আবদুল মিয়া ট্যারা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা উপায় আছে। কেস করে আমাকে ঝামেলায় ফেলতে পারেন।
অবশ্যি তাতে যে টাকা খরচ হবে তা দেয়ার সাধ্য আপনার নাই। এইসব জেনেই বিষয়টা নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলেছি। আবদুল মিয়া এত বোকা না।
আবদুল মিয়া আসলেই বোকা না। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে সে আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়ে ফেলল।
বিনা পুঁজিতে আমি নারী পাচারের ব্যবসায় ঢুকলাম। আমার কাজ ছিল নানান জায়গা থেকে সংগ্রহ করে আনা মেয়েদের চালানের জন্য তৈরি করা। চালানের একদিন আগে তাদের একটা ইনজেকশন দেয়া হতো। এই ইনজেকশনে তাদের মধ্যে একটা ঘোর তৈরি হতো। তারা বাস্তব এবং কল্পনার মাঝামাঝি একটা জগতে চলে যেত।
প্রথমবারে ষোলজন মেয়েকে আমরা মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করলাম। এদের মধ্য থেকে আবার নয়জনকে আরবে পাচার করা হবে। আরব দেশগুলিতে বাঙালি মেয়েদের মার্কেট ভাল।
আজহার সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে আমি জিগ্যেস করলাম, আপনি কতদিন এই ব্যবসা করেছেন?
আজহার সাহেব আমার কথার জবাব দিলেন না। রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন।
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ধরালাম। আজহার সাহেব আমার সামনে বসে কথা বলছেন এটা আমার কাছে বিশ্বাস হচ্ছে না। মানুষ এত জঘন্য কাজ করে কিভাবে? এবং এত জঘন্য কাজ করার পর এমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কেউ কি কথা বলতে পারে?
আজহার সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি ভাবছেন আমি তা বুঝতে পারছি। গল্প শেষ করার পর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।
প্রথম মাসে ষোলজন মেয়ে পাচার করার পর দ্বিতীয় মাসে আমরা সাতজন মেয়ে জোগাড় করলাম।
তখন স্বাতী নামের একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হল। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে দিনাজপুর থেকে। খুবই সরল টাইপের মেয়ে। এই কিডন্যাপটি করার সময় আবদুল মিয়া নিজে গাড়িতে বসে ছিল। তার কাছেই শুনেছি, কি একটা কাজে মাইক্রোবাস নিয়ে তারা দিনাজপুর গিয়েছিল।
ফেরার পথে মেয়েটিকে কিডন্যাপ করে। মেয়েটি সকালে স্কুলে যাচ্ছিল, নির্জন রাস্তা। পেছন থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে এসে মেয়েটিকে তারা উঠিয়ে নেয়।
স্বাতীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের ঘটনা খুব অদ্ভুত। নানান জায়গা থেকে ধরে আনা মেয়েদের তখন রিয়াজবাগে ঘুপচির মতো একটা জায়গায় রাখা হয়েছে।
আবদুল মিয়া প্রতিদিন সকালে এবং রাতে একবার করে গোনে যায় কতজন মেয়ে আছে—কেউ পালিয়ে গেল কিনা। দরজায় কঠিন পাহারা বসানো। ষণ্ডামার্কা দুইজন লোক সব সময় লাঠি হাতে নিয়ে বসে থাকে। তাদের কোমরে পিস্তলও থাকে। এরা আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে।
তারপরেও এদের চেহারা দেখলে আমার কেমন জানি গা ছমছম করে। প্রায় রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখি, কালো চেহারার বিশালদেহী একটা মানুষ আমাকে দৌড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি, কিন্তু গতি বাড়াতে পারছি না। পিছনের মানুষটার বিশাল ছায়া ক্রমেই আমার গায়ের উপর দিয়ে এসে সামনে পড়েছে। এবং ধীরে ধীরে সেই ছায়া আমাকে ছাড়িয়ে আরো সামনে চলে যাচ্ছে।
মানুষটা বারবার হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করছে।
এইসব দুঃস্বপ্ন দেখে প্রায় রাতেই আমি জেগে বসে থাকি। তখন একদিন আবদুল মিয়া আরো কয়েকজন মেয়ে সংগ্রহের জন্যে বিভিন্ন জেলায় ঘুরতে বের হল। এবং যাওয়ার আগে তার সমস্ত কিছুর দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। বলে গেল, যে কয়টা মেয়ে সম্পর্কে তার কাছে ইনফর্মেশন আছে তাদের তুলে আনতে পারলে এই মাসে দেড় কোটি টাকার ব্যবসা হবে।
কারণ এবারের টার্গেটের মেয়েগুলি দেখতে শুনতে অনেক ভাল। আরব কান্ট্রিতে চড়া দামে এদের বিক্রি করা যাবে।
আমি তখন আবদুল মিয়ার মতো প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় মেয়েদের গুনতে যেতাম। প্রথম দিন যখন গুনতে যাই, একটি মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে?
তার প্রশ্ন শুনে অনেকক্ষণ আমি স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার এই তাকিয়ে থাকার প্রথম কারণ, মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী।
চ্যানেল আইয়ের লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যোগ দিলে অবশ্যই সে ফার্স্ট হবে বলে আমার ধারণা। দ্বিতীয় কারণ, তার প্রশ্ন শুনে আমার ভিতরে মনুষ্যত্ববোধ জেগে উঠেছিল মনে হয়। আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে? কোনো জবাব পাইনি। একটা কথা বারবার আমার মাথায় ঘুরছিল, এদেরও তো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই মেয়েগুলোও তো ছোট্ট একটা সুখী সংসারের স্বপ্ন দেখে।
যেখানে তার স্বামী আছে, ছেলেমেয়ে আছে, সংসার নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব আছে, ভবিষ্যত নিয়ে আশা এবং দুশ্চিন্তা দুই-ই আছে। অজানা অনেক আনন্দ-বেদনা আছে এবং সর্বোপরি ভালবাসার বিশাল একটা সমুদ্র আছে।
আমি মেয়েটিকে জিগ্যেস করলাম, তোমার নাম কি?
মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না। ভয়ে কেমন যেন চুপসে গেল। মনে হল, কেউ এলেই এই মেয়ে জিগ্যেস করে আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে?
মেয়েটি কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি নরম গলায় বললাম, ভয়ের কিছু নেই। তোমার নাম কি বল।
মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, স্বাতী।
তোমার বাড়ি কোথায়?
দিনাজপুর।
প্রথম দিন তার সঙ্গে আমার এইটুকু কথাই হয়েছে।
সেদিন আমি তাদের না গুনেই চলে গেলাম। মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে অনেক বড় পাপী বলে মনে হচ্ছিল।
দ্বিতীয় দিন যখন গেলাম মেয়েটি নিজেই আমার সঙ্গে কথা বলল। সহজ ভঙ্গিতে জিগ্যেস করল, আমরা কোথায় আছি?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ঢাকায়।
স্বাতী চোখ কপালে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর জিগ্যেস করল, আমাদের কি করা হবে?
আমি কঠিন গলায় বললাম, বিদেশে পাচার করা হবে।
স্বাতী আমার কথা বিশ্বাস করতে পারল না। কেন পারল না—কে জানে।
এভাবে পনের দিন কেটে গেল।
প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় আমি তাদের গুনে আসি। সবার সঙ্গেই টুকটাক কথা হয়। স্বাতীর সঙ্গে একটু বেশি হয়। খুব সহজ ভঙ্গিতে সে আমার সঙ্গে কথা বলে। একদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, মেয়েদের ভেতরে ভয় কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে একটা স্বাভাবিকতার ভাব ফিরে আসছে।
আগে তারা খুব কান্নাকাটি করতো। এখন আর কেউ কাঁদে না। সবাই মিলে টুকটাক গল্প করে।
স্বাতী মাঝে মাঝে আমাকে তার জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্প শোনাত। তার বয়স ষোল সতের বছর।
কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে আমি খুব অবাক হলাম, এত কম বয়সেও অন্যদের চেয়ে সে অনেক ভাল বোঝে। এদের সঙ্গে একটা মেয়ে ছিল—স্নিগ্ধা নাম। এই মেয়েটা এতই সরল যে কেউ যদি তার সামনে এক গ্লাস কেরোসিন তেল দিয়ে বলে, পানিটা এক চুমুকে শেষ করো। স্নিগ্ধা অনায়াসে গ্লাসে চুমুক দিবে। চুমুক দেয়ার পরে বুঝবে গ্লাসে কেরোসিন তেল।
এই মেয়েটিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে বগুড়া থেকে। আবদুল মিয়ার এক অনুচর তাকে চকলেট কিনে দেয়ার কথা বলে মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় নিয়ে আসে। আশ্চর্য, সারাটা পথ মেয়েটি চুপচাপ গাড়িতে বসে ছিল। অনেকক্ষণ পরপর নাকি জিজ্ঞেস করতো, চাচা চকলেটের দোকান আর কত দূর? আবদুল মিয়ার অনুচর হেসে বলতো, এই তো এসে পড়েছি।
হায়, আজ সেই স্নিগ্ধা এমন এক জগতের দিকে যাত্রা করেছে, যেখানে সারাজীবন তার মনে একটা কথাই ঘুরবে, সুখের জীবন আর কত দূর? এই কাজের জন্যেই কি আমি জন্মেছিলাম?
স্বাতী একদিন আমাকে বলল, খুব ছোটবেলায় মা ছেলে ধরার গল্প বলে আমাদের ঘুম পাড়াতেন।
জানেন আমি কত বোকা, তখন বুঝতে পারিনি সত্যি সত্যি একদিন আমাকে ছেলেধরা নিয়ে যাবে।
স্বাতীর সঙ্গে দেখা হলে আমি অসহায় বোধ করতাম। এতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করার জন্যে নিজেকে মহা অপরাধী বলে মনে হতে লাগল।
আমি অবাক হয়ে আজহার সাহেবের গল্প শুনছিলাম। গল্প শুনতে শুনতে মনে খুব সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছিলাম।
আজহার সাহেব কিন্তু হাসিমুখে গল্প বলছেন। এজন্যে ভদ্রলোকের উপর আমার খুব রাগ হচ্ছিল।
আজহার সাহেব আমার দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নেন ভাই, সিগারেট ধরান। আমার গল্প আপনার কেমন লাগছে?
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, অদ্ভুত।
গল্পের শেষটা কিন্তু আরো অদ্ভুত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মনোযোগ দিয়ে শুনলে গল্পের শেষে বড় ধরনের একটা চমক খাবেন।
আমি অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকালাম।
আজহার সাহেব হেসে বললেন, চা খাবেন?
এখন চা পাব কোথায়? চা খেতে হলে ক্যান্টিনে যেতে হবে।
চলুন ক্যান্টিনে গিয়ে চা খেয়ে আসি।
আমার ক্যান্টিনে যেতে ইচ্ছে করছে না।
চলুন না।
না থাক।
অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। একটু হাঁটলে ভাল লাগবে।
আপনি বরং গল্পটা শেষ করুন। গল্প শেষ হলে চা খেয়ে আসব।
আজহার সাহেব পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন।
আমরা দুজন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ক্যান্টিনে বসলাম। এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস কতটা পথ এগিয়েছে জানি না।
বাইরে সবকিছু অন্ধকার। ক্যান্টিনের মানুষগুলো বসে বসে ঝিমুচ্ছে। ট্রেনের একটানা খটাখট খটাখট শব্দের মাঝেও কেমন জানি একটা নেশার ভাব আছে। এই নেশার কারণেই মনে হয়, এত বিকট শব্দের মাঝেও মানুষ নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারে।
আজহার সাহেব এক হাতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আরেক হাতে সিগারেট টানছেন।
আমি বিষণ্ণ মনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। এই প্রগাঢ় অন্ধকারে কিছু একটা যেন দেখতে পাচ্ছি। বিশজন মেয়ের আতঙ্কিত চেহারা বারবার আমার চোখে ভেসে উঠছে।
আজহার সাহেব।
বলুন।
বাইরে কেমন অন্ধকার দেখেছেন?
হুঁ। বৃষ্টি হবে।
বৃষ্টি হবে আপনি কি করে বুঝলেন?
বাতাস কেমন স্যাঁতস্যাঁতে মনে হচ্ছে।
ও আচ্ছা।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, চা শেষ হলে চলুন কামরায় গিয়ে বসি।
গল্পের শেষটা শোনার জন্যে আপনি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন মনে হচ্ছে।
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ।
চলুন।
আমরা কামরায় ফিরে এলাম। সবকিছু ঠিক আছে।
তবু কেন জানি আমার মন খচখচ করতে লাগল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমার ব্যাগটা নেই। আজহার সাহেব আমার অসহায় চেহারা দেখে বললেন, ক্রসিংয়ের জন্যে গাড়ির গতি কমে গিয়েছিল। তখন সম্ভবত কেউ ব্যাগটা নিয়ে গেছে। ব্যাগে কি দামি কিছু ছিল?
না।
অনেক দরকারি জিনিসপত্র ছিল।
কি ছিল?
জামা কাপড় ছিল। কি মনে করে যেন টাকাগুলো প্যান্টের পকেটে রেখেছি। বাঁচা গেছে।
আজহার সাহেব আবার গল্প শুরু করলেন—
স্বাতীর সঙ্গে অল্প কদিনেই আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
সে তার জীবনের নানা গল্প আমাকে শোনাত। একদিন বলল, খুব ছোটবেলায় তারা মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। আষাঢ় মাসের সন্ধ্যা। দুপুরের পর থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। তার দুই মামা পাশাপাশি বাড়িতে থাকে।
সেদিন সন্ধ্যায় সে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাচ্ছিল, গাছের উপর থেকে হঠাৎ কে যেন তার চুল ধরে টান দিল। ভয়ে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
তার এই গল্প শুনে আমি বুঝেছিলাম, এ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।