ও পথ মাড়িও না যে পথ তুমি চেননাকো----
জনতার দরবারে বসে বুঝলেন জনতার চাপ কাকে বলে!
আম আদমির সমস্যা মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েই দিল্লির ক্ষমতা দখল করেছে তাঁর দল আম আদমি পার্টি (আপ)। কিন্তু সেই জনতা-জনার্দনের দাবি মেটাতে গিয়ে আজ কার্যত চোখে সর্ষেফুল দেখলেন দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। মানুষের ভিড়ের চোটে এক সময় জনতা দরবার কার্যত লাটে তুলে দিয়ে দিল্লি সচিবালয়ের ভিতরে ঢুকে পড়তে হল তাঁকে। পরে বেরিয়ে এসে কোনও ভাবে এ যাত্রায় মুখরক্ষা করলেন বটে, কিন্তু তাঁর দরবারি অব্যবস্থা দেখে প্রাক্তন সহযোগী কিরণ বেদী তো বটেই, মুখ টিপে হাসতে শুরু করেছে বিরোধীরাও।
রাজনীতির পরিভাষা বদলে দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
বদল আনতে চান চিরাচরিত প্রশাসনিক ব্যবস্থাতেও। সেই লক্ষ্য নিয়েই ফুটপাথে বসে জনতার সমস্যার নিদান দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন অরবিন্দ। স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় দিল্লি সচিবালয়ের সামনের রাস্তা। আজই প্রথম বার বসেছিল জনতা দরবার। নিজে ওই সভায় উপস্থিত থাকবেন বলে দু’দিন আগে ঘোষণাও করেছিলেন অরবিন্দ।
কিন্তু দিকে দিকে সেই বার্তা যে এ ভাবে রটে যাবে, তা আঁচ করতে পারেননি আপ নেতৃত্ব। সরকারের অনুমান ছিল, খুব বেশি হলে হাজারখানেক লোক আসবেন। সংখ্যাটা যে এত বেশি হবে, তা তাঁরা কল্পনাও করেননি বলে মেনে নিয়েছেন অরবিন্দ নিজেই
http://www.anandabazar.com/12desh1.jpg
কথা ছিল, সকাল সাড়ে ন’টায় দরবার শুরু হবে। ভিড় জমতে শুরু করে সকাল ছ’টা থেকে। অরবিন্দ যখন এসে পৌঁছলেন, গোটা এলাকা তখন কার্যত জনসমুদ্র।
জনতার ভিড়ে অভিযোগ গ্রহণের পাঁচটি কাউন্টারে তখন সরকারি কর্মচারীদের সসেমিরা দশা। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা থেকেও নাকি বহু লোক এসেছেন! দেড় ঘণ্টা বসে জনতার অভিযোগ শুনবেন বলে কথা দিলেও পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হন অরবিন্দ। ততক্ষণে লোহার ব্যরিকেড উপড়ে ফেলেছে জনতা। ভিড়ের চাপে মুখ্যমন্ত্রীর ছোট্ট টেবিল গুঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আরও বেশি ঝামেলার আশঙ্কায় ততক্ষণে মুখ্যমন্ত্রীকে সচিবালয়ের ভিতরে ঢুকিয়ে তালা মেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাইছে পুলিশ।
শেষে সকাল সাড়ে দশটার আগেই নিরাপত্তার কারণে সচিবালয়ে ঢুকে যেতে বাধ্য হলেন অরবিন্দ, মণীশ সিসৌদিয়া।
অরবিন্দ-মণীশ ভিতরে গেলেও বাইরের উত্তাল জনতা মুখ্যমন্ত্রীকেই স্মারকলিপি দিতে মরিয়া। সকলেই চান তাঁর কাছে নালিশ ঠুকতে। গিরিশ সোনী, সোমনাথ ভারতীর মতো আপ-এর অন্য মন্ত্রীরা চেয়ারে বসে থাকলেও নাছোড় জনতা খুঁজছে অরবিন্দকেই। ততক্ষণে সচিবালয়ের সামনের রাস্তার গোটাটাই চলে গিয়েছে জনতার দখলে।
রাস্তাতেই বসে পড়ছে অনেকে। বেশির ভাগই দিল্লি সরকারের বিভিন্ন দফতরের ঠিকা কর্মী। বিদ্যুৎ, পরিবহণ, স্বাস্থ্যের আশা-অঙ্গনওয়াড়ি, এমনকী দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকা কর্মীরাও উপস্থিত পাকা চাকরির আশায়। রয়েছে বকেয়া বেতনের দাবি কিংবা পুলিশি হেনস্থার শিকার ব্যক্তিরাও। সকলেই চান চটজলদি সমাধান।
আজই চাকরি পাকা হোক বা আজই ঠিক হয়ে যাক বিদ্যুতের মিটার! বকেয়া বেতনের চেকটা দিল্লির সচিবালয় থেকেই নিয়ে যাবেন, এমন পণও করে বসে আছেন অনেকে! প্রতিবন্ধী কোটায় চাকরি কিংবা পেনশন সমস্যা অথবা নিখোঁজের সন্ধান জনতা সব কিছুরই উত্তর চাইছিল, আজই!
আর জনতার এই আচরণে অবাক হচ্ছেন না কেউই। অনেকেরই বক্তব্য, নির্বাচনী প্রচারে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনতার মন জিতেছিলেন অরবিন্দ। তার পরে গদিতে বসেই জল এবং বিদ্যুৎ নিয়ে দ্রুত প্রতিশ্রুতি রক্ষার বার্তা দিয়ে জনমানসে কার্যত ‘কল্পতরু’ হয়ে উঠেছেন তিনি। ফলে তাঁর প্রতি প্রত্যাশার পারদটাও আকাশ ছুঁয়েছে। এই অবস্থায় জনতা দরবারে জনতা যে তাঁর কাছেই নালিশ ঠুকতে চাইবে, অভিযোগের চটজলদি সমাধান প্রত্যাশা করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর তার বাস্তবায়নের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ফারাক, তা প্রথম থেকেই বলে আসছে কংগ্রেস-বিজেপি। আজ অরবিন্দের হেনস্থায় দৃশ্যতই উল্লসিত তারা। বিজেপি নেতা বিজয় গোয়েল বলেন, “নিজের ফাঁদেই পড়েছে কেজরিওয়াল সরকার। এই বিশৃঙ্খলায় সমস্যার সমাধান হয় না। আজ যা হয়েছে, তা গিমিক!” যদিও দিল্লির শ্রমমন্ত্রী গিরিশ সোনীর বক্তব্য, “ভিড়ই বুঝিয়ে দিচ্ছে আগের সরকার কতটা ব্যর্থ।
তাই এত মানুষ এসেছেন। ” আর কাদায় পড়া অরবিন্দের অবস্থা দেখে উল্লসিত কংগ্রেস নেতা শাকিল আহমেদের তির্যক মন্তব্য, “এত মানুষ আসবেন, তা সরকারের আগে থেকেই জানা উচিত ছিল। ”
বিরোধীদের বক্তব্য পরোক্ষে মেনেও নিয়েছেন আপ নেতৃত্ব। নিজে ভিতরে চলে গেলেও পরিস্থিতি যে ক্রমশ হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, তা সচিবালয়ে বসে টিভির পর্দায় চোখ রেখেই বুঝতে পারছিলেন অরবিন্দ। জনতা দরবার শেষ হওয়ার কথা এগারোটায়।
কিন্তু সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জনতা ঠায় দাঁড়িয়ে, যাঁদের ধৈর্য দ্রুত কমছে। পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত পজিশন নেয় পুলিশ। তাঁদের ওয়াকিটকি তখন ঘনঘন বার্তা পাঠাচ্ছে, ‘টেক পজিশন-গেট নম্বর ৫, ৬-এ আরও লোক পাঠাও। ’
এই পরিস্থিতির মধ্যেই বাইরে এলেন অরবিন্দ। প্রথমে পাঁচ নম্বর গেটের সামনে।
সঙ্গে মণীশ সিসৌদিয়া। মাইকে জনতাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। ফের ভিতরে ঢুকে গেলেন এবং বেরিয়েও এলেন। এ বার লক্ষ্য গেট নম্বর ছয়। জনতার ঢলও তখন ছয়ের দিকেই।
তবে আর গেট নয়। এ বার সোজা ছাদে উঠে এলেন অরবিন্দরা। হাতে মাইক। হারতে বসা ম্যাচের স্লগ ওভারে ব্যাট করতে নামা প্লেয়ারের ঢঙে শুরু থেকেই চালাতে শুরু করলেন অরবিন্দ। প্রথমেই বললেন, “আমায় ক্ষমা করবেন।
বুঝতে পারিনি, এ ভাবে ভিড় হবে। তাই পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই। আগামী জনতা দরবারে এই সমস্যা থাকবে না। একটু সময় দিন আমাদের। ” শুধু বলার অপেক্ষা।
যে ভিড় এতক্ষণ তাঁর মুন্ডুপাত করছিল, মুর্দাবাদ ধ্বনি তুলছিল, এক কথাতেই তারা শান্ত! ফের আওয়াজ উঠল কেজরিওয়াল জিন্দাবাদ! যা শুনে দিল্লি পরিবহণের ঠিকা কর্মী রাহুল বললেন, “ক’জন রাজনীতিক এ ভাবে প্রকাশ্যে ক্ষমা চান বলুন তো? আর যাই হোক লোকটা তো চেষ্টা করছে। ” ছাদে দাঁড়িয়ে জনতার মুখোমুখি হয়ে এ যাত্রায় বড় কোনও ঝামেলা এড়াতে পারলেও প্রাক্তন সহযোদ্ধা কিরণ বেদীর কটাক্ষ শুনতে হল অরবিন্দকে। যিনি বললেন, “ভগবানের দোহাই অরবিন্দ, সচিবালয়ের ছাদ থেকে সরকার চলে না!”
ঘণ্টাখানেক জনতার সঙ্গে কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে এ দিন অরবিন্দ বুঝে গিয়েছেন, উপস্থিত ভিড়ের নব্বই শতাংশই হলেন ঠিকা কর্মী। তাঁদের একটাই দাবি, চাকরি পাকা করা হোক। জনতাকে শান্ত করতে কেজরিওয়াল আজ বললেন, “প্রতিটি দফতরে চিঠি লিখে জানতে চাইব কত ঠিকা কর্মী রয়েছে এবং তাঁদের কেন পাকা করা সম্ভব নয়।
আগামী এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে সরকার। ”
অরবিন্দকে যে আজ না হোক কাল, এই পরীক্ষার সামনে পড়তে হতো, তা জানা ছিল সব পক্ষেরই। অরবিন্দ নিজেও তা জানেন। তা ছাড়া আপ নেতৃত্ব এটাও ভালই জানেন যে, আগামী ছ’মাসে আপ-সরকার যা কাজ করবে, তার উপরে দলের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করছে। কিন্তু ঠিকা কর্মীদের পাকা চাকরি দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তগুলির সঙ্গে যে আইনি জটিলতা জুড়ে রয়েছে, সেগুলি অরবিন্দ কী ভাবে দ্রুত সামলান, সেটাই এখন দেখার।
কেন না ওই বিষয়গুলির সমাধান যত বিলম্বিত হবে, তত সুযোগ পেয়ে যাবেন বিরোধীরা। যা কিছুটা শুরু হয়ে গিয়েছে আজই। কেজরিওয়ালের আজকের জনতা দরবারকে ‘ফ্লপ শো’ অ্যাখ্যা দিয়ে এক বিজেপি নেতার বক্তব্য, “অপেক্ষা করুন। জনতার আজ এক দফা মোহভঙ্গ হয়ছে। যত দিন যাবে কেজরিওয়ালের ফ্লপ শো তত বেশি মানুষের চোখ খুলে দেবে!”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।