প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেক নজরে থাকায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত পাঁচ বছর বেশ দাপটেই কাটিয়েছেন। বাঘা বাঘা অভিজ্ঞ নেতাদের পেছনে ফেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় শক্ত আসন গড়তে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রভাব ছড়িয়েছিলেন নিজ মন্ত্রনালয়ের বাইরেও। মন্ত্রী-নেতাদের মাঝে পরিচিতি পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ‘ব্লু আই’ হিসেবে। উড়ে বেড়িয়েছেন বিশ্বময়।
সেই দীপু মনি ছিটকে পড়েছেন মন্ত্রিপরিষদ থেকে। লবিং করেও রক্ষা হয়নি মন্ত্রিত্ব। এই ঘটনা দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর কারন খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে নানা কারণ।
জানা গেছে, দীপু মনির মন্ত্রিসভা থেকে ঝরে যাওয়ার অন্যতম কারণ তার মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে ক্রমাগত অবনতি।
এমনকি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে তার কর্মকান্ডেও খুশি ছিল না নয়াদিল্লি ও ঢাকার বড় একটি অংশ। জার্মানি, চীনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোন ভূমিকা রাখতে পারেননি দীপু মনি। সর্বশেষ বড় কারণ হয়ে দাড়ায় গত তিন মাসের কূটনৈতিক অদক্ষতা। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে পড়ে। বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সম্পর্কে অবনতির কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এবার বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যায়নি বিদেশি কূটনীতিকরা। এই পরিস্থিতিতে দীপু মনি সরকারের সঙ্গে বিদেশিদের সম্পর্কোন্নয়নে কোন ভূমিকাই রাখতে পারেননি।
এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র খাতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার পারিবারিক বিরোধের প্রভাব ফেলা নিয়েও আছে জোর সমালোচনা। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মতে, ড. ইউনূসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক দীপু মনির পারিবারিক বিরোধের কারনেই সৃষ্টি হয়েছে। অত্যন্ত সুচিন্তিত ভাবে এই বিরোধ সৃষ্টি করেছেন তিনি।
যার কারনে আওয়ামী লীগকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পস্তাতে হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে দীপু মনির স্বামী আইনজীবি তৌফিক নেওয়াজের সঙ্গে ড. ইউনূসের সম্পর্ক খারাপ থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে ক্ষেপিয়ে তোলেন দীপু মনি। একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে তৌফিক নেওয়াজকে পরিচয় করিয়ে না দেওয়াই ছিল বিরোধের সূত্রপাত। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, পারিবারিক কারনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে সরকার ও দলগতভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে দীপু মনি। এ বিষয়টি তার মন্ত্রিপরিষদ থেকে ছিটকে পড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি কারণ।
এদিকে দীপু মনির বিদেশ সফর নিয়ে সরকারের ভেতরেও ছিল অসন্তোস। ঘন ঘন বিদেশ সফরের কারণে তার সাক্ষাত পেতেন না ঢাকা সফরে আসা বিদেশিরা। বিশ্ব কূটনীতির সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের ঢাকা সফরকালে একটি মধ্যাহ্নভোজের মাঝামাঝি বিদায় নিয়ে ঢাকা ছাড়েন দীপু মনি। এ ঘটনা ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে। এছাড়া জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের পর ঢাকাস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূতকে মন্ত্রণালয়ে তলব করে যেভাবে প্রক্রিয়া জানান তা শোভন লাগেনি ইউরোপের এই দেশটির কাছে।
এসব কারণে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন কমে আসছিল ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের মাঝে। শেষের দিকে তার ব্রিফিং-এ প্রশ্ন করার আগ্রহ ছিল না বিদেশি কূটনীতিকদের। কারন তারা রাজনৈতিক বক্তব্যের বাইরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে কোন কূটনৈতিক বার্তাই পাচ্ছিল না। সবমিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির মতো দেশের কূটনীতিকদের দীপু মনির ব্যাপারে জোরালো আপত্তি ছিল। এমনকি ভারতের রাজনৈতিক মহলেও তাঁর ব্যাপারে অসন্তুষ্টি ছিল প্রকটভাবে যা ভারতের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়।
প্রায় পাঁচ বছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে দীপু মনি আগাগোড়াই ছিলেন বিতর্কিত। শুরুর দিকে দীপু মনি ছিলেন অনেকটা নামকাওয়াস্তে মন্ত্রী। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দেখভাল করা হতো উপদেষ্টার পক্ষ থেকে। এ সময় প্রশ্ন ওঠে কে চালান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে পররাষ্ট্রের প্রায় সকল বিষয় হাতে নেন দীপু মনি।
তখন থেকেই সবকিছুতেই তালগোল শুরু হয়। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কে ভাটা লাগতে শুরু করে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, কূটনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে পাঁচ বছরেও ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত চুক্তি চুক্তি সম্পন্ন করতে পারেননি দীপু মনি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য দীপু মনি কলকাতায় গিয়ে মহাকরণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তিনি বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন।
অনেকের ধারণা, এই ঘটনার পর থেকেই তিস্তা চুক্তি ও স্থলসীমা চুক্তি নিয়ে বেঁকে বসেন মমতা। এসব কারণকেই পাঁচ বছর প্রভাবশালী অবস্থানে থাকা দীপু মনিকে দশম সংসদের মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ দেওয়া হয়।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।