আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলচিত্র পর্যালোচনাঃ সারেং বৌ

আমি আঁধারে তামাশায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙ্গলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে।


ডাউনলোড লিংকঃ সারেং বৌ
ইউ-টিউব ডাউনলোড লিংকঃ The Survivors
IMDB রেটিং – ৮.০
আমার রেটিং – ১০



...এই না পথ ধইরা, আমি কত না গেছি চইলা ...দারুন জ্বালা দিবানিশি অন্তরে অন্তরে... বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায়রে কান্দে রইয়া রইয়া... হইয়া আমি দেশান্তরী দেশ বিদেশে ভিড়াই তরীরে... নোঙর ফেলি ঘাটে ঘাটে, বন্দরে বন্দরে...

সারেং বৌ বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী জনপদের বিশ্বস্ত চিত্র। জনজীবনের সর্বস্তরে, দেশ বিদেশের নানা নগর বন্দরের নানা হিসেবের রূপক সারেং বৌ নবিতনের জীবন সংগ্রামের চরিত্রটি আমাদের আশাবাদী করে তোলে। জীবনের অন্তর্নিহিত তাগিদ, স্থবিরতা এবং অবক্ষয়ের বাঁধ ভেঙ্গে সৃষ্টির উৎসকে এখানে প্রকাশ করা হয়েছে। এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে গ্রামের এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী মানুষের নারী লোলুপতার প্রতিরোধে, তাদের ষড়যন্ত্রের ফলে সৃষ্ট আর্থিক দৈন্যের বিরুদ্ধে, তার স্বামীর প্রতি কল্পিত অবিশ্বস্ততার রটনার প্রত্যাখ্যানে।

নবিতন তার নিজের অস্তিত্ব ও সম্মানরক্ষায় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিরন্তর একজন যুদ্ধরত নারী, পরিণামে তার মুখে বিজয়ীনির গৌরব।



শহীদুল্লা কায়সার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র নিজে প্রত্যক্ষ করে তা ইতিহাসে বিধৃত করতে চেয়েছেন। কিন্তু অবশেষে তিনি নিজেই ইতিহাসে পরিণত হয়েছেন। আইয়ুব খান তাকে জেলে পাঠিয়েছিলো। তিনি তিন পর্যায়ে মোট আট বছর জেলে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন এবং জেল জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন নিবিষ্টমনে।

তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসেই লিখেছেন সারেং বৌ নামের বিখ্যাত এই উপন্যাসটি। এই উপন্যাসটির জন্য তাঁকে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়।



শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত পাঠকপ্রিয় এই উপন্যাসটি নিয়ে ১৯৭৮ সালে প্রখ্যাত চলচিত্রকার আবদুল্লাহ আল মামুন, এ বি এম প্রোডাকশনের প্রযোজনায় সারেং বৌ চলচিত্রটি নির্মাণ করেন। এই চলচিত্রটি ওই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এতে কদম সারেংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন ফারুক এবং তার স্ত্রী নবীতন চরিত্রটি রূপায়ণ করেন কবরী।

এ ছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মোড়লের ভূমিকায় ছিলেন আরিফুল হক ও মন্টু চাচা ভূমিকায় ছিলেন গোলাম মোস্তফা ।



বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্হায় নির্মিত এই চলচিত্রটিতে সংগীত রচনা করেন মুকুল চৌধুরী, আলম খানের সুর ও সংগীত পরিচালনায় আবদুল জব্বার এর কণ্ঠে গাওয়া ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া গানটি এখনো সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে। এছাড়া কবে হবে দেখা তোমার সনে এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রথিন্দ্রনাথ রায়। চিত্রগ্রাহক হিসেবে ছিলেন রফিকুল বারী চৌধুরী ও সম্পাদক হিসেবে ছিলেন আমিনুল হক মিন্টু। শ্রেষ্ঠাংশে আরও ছিলেন জহিরুল হক, বিলকিস, বুলবুল ইসলাম, ডলি চৌধুরী, আবদুল কাদের, সূজা খন্দকার, দারাশিকো, হাসান ইমাম প্রমুখ।






চলচিত্রের মিষ্টি মেয়ে খ্যাত কবরীর অভিনয় এতটাই নিখুঁত ছিলো যে, মনে হয়েছে সারেং বৌ যেন স্বয়ং তিনি নিজেই। তার হাসি বা কান্না, সুখ কিংবা দুঃখ মনে রেখাপাত করতে পেরেছে। নির্মাতা চলচিত্রটিতে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে মোটেও ভুল করেননি এটা তিনি তার অভিনয় দিয়ে নিশ্চিত করতে পেরেছেন। আর তাইত সারেং বৌর নবীতন চরিত্রের জন্য ১৯৭৮ সালে কবরী পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার।



এছাড়া ফারুক ও আরিফুল হক দুর্দান্ত অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন পুরো চলচিত্রটি জুড়েই।

চিত্র গ্রহন এবং আবহ সংগীত ছিলো সেই সময়ের তুলনায় অনেক আধুনিক ও বাস্তব সম্মত। ক্লোজ শট কিংবা ডিটেইলিং নিখুঁত ভাবে করা হয়েছে যা প্রমান করে নির্মাতা আবদুল্লাহ আল মামুনের গুনী সৃষ্টিকর্মকে। তিনি তার এই চলচিত্রটিতে যেমন নিজের প্রতিভা আর শক্তির পরিচয় দিয়েছেন তেমনি নিজের অপরিমেয় ক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন তাঁর নির্দেশনায়। যে কারণে আজও সারেং বৌয়ের গ্রহণযোগ্যতা এতটুকু পরিমান ম্লান হয়ে যায়নি।



পুরো চলচিত্রটিকে মোট তিনটি অংশে ভাগ করা যাক।

প্রথম অংশে, কদম সারেং (ফারুক) জাহাজে কাজ করে অনেক দিন পর ফিরে আসে নিজ বাড়িতে, তারপর ভালোবেসে বিয়ে করে নবিতনকে (কবরী)।




সে সৎ বলে সহকর্মীদের মত বাড়ি ও দালান করতে পারেনি। স্ত্রীকে নিয়ে আর্থিক কষ্টের মধ্যেও সে সুখে থাকে। বিয়ের কিছু দিন পরে সে আবার চলে যায় জাহাজের কাজে। অপেক্ষায় দিন কাটে নবিতনের।

কদম মাঝে মাঝেই নবিতনের কাছে চিঠি ও টাকা পাঠায়। কিন্তু গ্রামের প্রভাবশালী মোড়ল (আরিফুল হক) ডাক পিয়নকে হাত করে সেইসব চিঠি ও টাকা নিয়ে নেয়, যাতে করে নবিতনের সংসারে অভাব চলে আসে। আর এই অভাবের সুযোগে প্রকৃতির বিরুদ্ধতায় সারেং যখন দীর্ঘদিন নিখোঁজ তখন যুবতী নবিতনকে লোলুপ সমাজপতি তার লালসার শিকার বানাতে চায়। গ্রামের মোড়লের ষড়যন্ত্রে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়, দূরত্ব স্থান করে নেয় ভালোবাসার জায়গায়। দাম্পত্য আদর্শনিষ্ঠ বলে নবিতন সবকিছুকে পরাজিত করতে পারে।

নবিতন নিজে গায়ে খেঁটে ঢেঁকিতে ধান বেঁনে কোন মতে সংসার চালায়।




চলচিত্রটির দ্বিতীয় অংশে দেখা যায় যে, কদমকে মন্টু চাচা (গোলাম মোস্তফা) পকেটে অবৈধ মাল পুরে দিলে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়, সাজার মেয়াদ শেষ হলে সে ফিরে আসে নিজ গ্রামে। ততক্ষনে চক্রান্তকারী মোড়ল কদমের চাচাতো ভাইয়ের সাথে নবিতনের বিয়ে ঠিক করে, কিন্তু কদম ফিরে আসাতে সব ঠান্ডা হয়ে যায়, খুশিতে বুক ভরে ওঠে নবিতনের। ফিরে আসে কদম, আবার ভালোবাসে নবিতন, ভালোবাসে কদম। কিন্তু সাগর পাড়ের জীবনে ছন্দপতন ঘটায় জলোচ্ছ্বাস, ছন্দ ফেরাতে চায় নবিতন।

এভাবে নানা ঘটনায় অতিবাহিত হতে থাকে কিছুদিন।




চলচিত্রটির শেষ পর্যায়ে এসে, হঠাৎ একদিন তীব্র বাতাস গণগণে শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পরে উপকূলীয় অঞ্চলের সব মানুষ। ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছাসে শুরু হয় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের তড়িগড়ি। দীর্ঘ ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছাসের পর সব কিছু থমেথমে অবস্হা, চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ মানুষ, পশু, পাখি কাররই রক্ষা হয়নি এই দুর্যোগে দুর্ভোগে। কদম সারেংয়ের শরীরের বেশির ভাগই কাদামাটি ও বালির ভিতরে আটকে গেছে আর পানি পানি করে কাতরাচ্ছে, এদিকে নবিতনও একই অবস্হা থেকে উঠে খুঁজছে আপনজনদের।

হঠাৎ শুনতে পেলো কেউ পানি খেতে চাইছে, কাছে গিয়ে দেখলো তার স্বামী। সাগরের বুকে কদম তখন চরম মাত্রায় তৃষ্ণার্ত। হাতে করে পানি এনে খাওয়ানোর চেষ্টা করে না পেরে, কদমকেই টেনে নিয়ে গেল পানির কাছে, পানি মুখেদিতেই মুখ থেকে বের করে দিচ্ছে কদম, কারন খুঁজতে নবিতন নিজেই একটু পানি মুখে দিয়ে দেখলো এতো নোনাপানি। স্বামীকে বাচানোর কোন উপায় না দেখে মাতৃত্বকে জাগিয়ে স্বামীকে দুধের শিশুর মতো বুকে জড়িয়ে নবিতন নিজ স্তনদয় থেকে দুধ পান করায়। স্বামী কদম চোখ মেলে দেখে চমকে উঠে বলে, “নবিতন তুই আমারে পর কইরা দিলি”, নবিতন তখন জবাবে বলে, “না, জীবন বাচানো ফরজ”।

এ অবস্থায় ধর্মীয় বিধি লংঘন করে স্বামীকে বাঁচাতে নবিতনের নতুন স্নেহময়ী রূপ কদমকে বাঁচিয়ে তোলে। এখানে সব সংস্কার তুচ্ছ করে মানুষকে জয়ী দেখানো হয়েছে।



আবহমান বাংলাদেশের একান্ত আপনজন তার কাহিনী, আমার, আপনার, সবার... এই কাহিনীর এখানেই শুরু, চলো আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করি।









ওরে নীল দরিয়া
আমায় দেরে দে ছাড়িয়া।
বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া।


কাছের মানুষ দুরে থুইয়া,
মরি আমি ধড়-ফড়াইয়া,রে।
দারুন জ্বালা দিবানিশি। ।
অন্তরে অন্তরে।
আমার এত সাধের মন বধূয়া
হায়রে কি জানি কি করে।


ওরে সাম্পানের নাইয়া,
আমায় দেরে দে ভিড়াইয়া।
বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া।
ওরে সাম্পানের নাইয়া।
হইয়া আমি দেশান্তরী
দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী,রে।
নোঙর ফেলি ঘাটে ঘাটে।


বন্দরে বন্দরে।
আমার মনের নোঙর পইড়া আছে হায়রে
সারেঙ বাড়ির ঘরে।
এই না পথ ধইরা
আমি কত না গেছি চইলা।
একলা ঘরে মন মন বধূয়া
আমার রইছে পন্থ চাইয়া।




 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.