মরণনেশা ইয়াবার ভয়ঙ্কর বিস্তার ঘটেছে সারা দেশে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মহামারীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে নীরব এ ঘাতক ইয়াবা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণী শুধু নয়, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীদের একটি অংশ এখন ইয়াবায় আসক্ত। হাত বাড়ালেই ইয়াবা চলে আসায় এর সেবনকারীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন নিয়ে সরকার যেমন উদ্বিগ্ন, চিন্তিত অভিভাবকমহলও।
অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে বেড়েই চলছে ইয়াবা ব্যবসা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ্বংস করে মাদক ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। দুই শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও এমপি, রাজনৈতিক নেতার সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেট ইয়াবা ব্যবসায় সক্রিয়।
ইয়াবার বিস্তারে প্রতিটি মহল যখন উদ্বিগ্ন ঠিক তখনই কঙ্বাজারের চিহ্নিত একজন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে প্রতিটি মহলেই উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
ওই ব্যবসায়ীর আগামী ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার যাওয়ার কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ইয়াবার খুচরা ব্যবসায়ীরা মাঝে-মধ্যে গ্রেফতার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে মূল হোতারা। এতে করে ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা ব্যবসা। বানের পানির মতো দেশে ঢুকছে ইয়াবার চালান। আর যারা গ্রেফতার হচ্ছে তাদেরও আটকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
আইনের ফাঁক গলে তারা বেরিয়ে আসছে কারাগার থেকে। ফিরে যাচ্ছে তাদের ইয়াবা ব্যবসায়। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে এখন বড় ভূমিকা রাখছে র্যাব। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়েছে র্যাব। প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে।
ইয়াবার বিস্তারের পেছনে প্রভাবশালীদের সক্রিয়তাকে দায়ী করে র্যাবের এ ঊধর্্বতন কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবাকে রোধ করা না গেলে দেশের কোনো পরিবার এ থেকে পরিত্রাণ পাবে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, মাদক পাচার বন্ধে ভারতের সঙ্গে চুক্তির পর ফেনসিডিল পাচার কমে গেছে। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে যে চুক্তি আছে, তা কার্যকর করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ চুক্তি কার্যকর হলে ইয়াবা পাচার কমে যাবে।
জানা যায়, মানব দেহের সবচেয়ে ক্ষতিকর নেশাদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা অন্যতম একটি।
ইয়াবা অর্থ হলো ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ওষুধ। মেথ্যাম ফিটামিন, উত্তেজক পদার্থ ক্যাফিনের সঙ্গে হেরোইন মিশিয়ে তৈরি করা হয় ইয়াবা। এ নেশাদ্রব্য হেরোইনের চেয়ে ভয়াবহ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইয়াবা সেবন করার পর সাধারণত নির্ঘুমতা, চাঞ্চ্যলতা ও শরীরে উত্তেজনা দেখা দেয়। ক্রমান্বয়ে আসক্ত হওয়ার পর এটা মানব শরীরে নানা প্রকার ক্ষতি করে থাকে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শুধু বাংলাদেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মিয়ানমারে স্থাপিত হয়েছে ৭টি ইয়াবা কারখানা। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মাদক চোরাকারবারি সিন্ডিকেট মিয়ানমারের ওয়া আর্মি নামের সংগঠনের তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে এসব ইয়াবা। প্রতিদিন এ ৭টি কারখানায় ৫ লাখেরও বেশি ইয়াবা বড়ি উৎপাদন করা হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্ত গলিয়ে চোরাইপথে এসব ইয়াবা আসছে টেকনাফে। সেখান থেকে আসছে কঙ্বাজার।
আর এসব চালান সংগ্রহ করছে কঙ্বাজারের টেকনাফ ও উখিয়াসহ পাশের এলাকার কিছু প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী। তারাই রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে পেঁৗছে দিচ্ছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ১০৩ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯০ জন দেশি এবং ১৩ জন মিয়ানমারের অধিবাসী। তবে অন্য সূত্রগুলো বলছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র্যাবের তৎপরতার বাইরে বড় মাপের আরও দুই শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী সক্রিয় রয়েছে।
অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের এমপিসহ তার তিন ভাইয়ের নাম রয়েছে। তিনজনই শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত। ক্ষমতার দাপটে এ পরিবারের সদস্যদের মতোই আরও অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী তালিকাভুক্ত হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর তথ্যমতে, ৯০ শতাংশ ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রেফতার এড়িয়ে চলছে। ১০ শতাংশ গ্রেফতার হলেও তাদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ ও র্যাব সূত্র জানায়, আশি দশকের শুরুতে 'ইউনাইটেড ওয়া স্টেইট আর্মি' নামের একটি সংগঠন কারাখানা স্থাপন করে ইয়াবা তৈরি শুরু করে। ওই সময় বাংলাদেশে ইয়াবার তেমন পরিচিতি ছিল না। কিন্তু ৯০ দশকে মাদকদ্রব্যটি বাংলাদেশের এক শ্রেণীর উচ্চাভিলাষী সেবনকারীদের প্রিয় হয়ে ওঠে। যার সূত্র ধরে টেকনাফের হাজী বশরের ছেলে বহুল আলোচিত একটেল রমজান ও বার্মাইয়া শুক্কুর নামের ২ জন হুন্ডি ব্যবসায়ী ২০০০ সালের শুরুতে বাংলাদেশে ইয়াবা আনতে শুরু করে। তাদের হাত ধরে সম্প্রসারিত হয় বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার।
হালে মাদক সাম্রাজ্য শাসন করছে এ ইয়াবা। ইয়াবার ব্যাপক চাহিদার কথা বিবেচনা করে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডু শহর ও তার আশপাশে ৭টি কারখানায় তৈরি হচ্ছে ইয়াবা। সূত্র জানায়, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারের মংডু শহরের এসব কারখানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কারখানায় ৫ প্রকারের ইয়াবা বর্তমানে তৈরি হচ্ছে। এগুলো এস ওয়াই, জিপি, এন ওয়াই, ডবি্লউ ওয়াই ও গোল্ডেন নামে পরিচিত।
প্রতিদিন গড়ে ৫ লাখের বেশি ইয়াবা আসছে বাংলাদেশে।
২০ লক্ষাধিক পিস উদ্ধার
গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ২০ লাখ পিসেরও বেশি ইয়াবা উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট থেকে উদ্ধার করেছে ১০ লাখ ৮২ হাজার পিস ইয়াবা। র্যাব একই সময়ে উদ্ধার করেছে ৫ লাখ ১১ হাজার ১৮ পিস। বাকিগুলো উদ্ধার করে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
হাত বাড়ালেই ইয়াবা
অনুসন্ধানে জানা গেছে, 'ক্রেজি ড্রাগ' খ্যাত এ বড়িটি পেতে এখন আর নির্দিষ্ট এলাকা বা গণ্ডিতে যেতে হয় না। হাত বাড়ালেই এখন রাজধানীর যে কোনো পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতেই পাওয়া যাচ্ছে হরেক রংয়ের নেশার এ বড়িটি। শুধু তাই নয়, রাজধানী ও বড় বড় শহর ছাড়িয়ে ইয়াবা পেঁৗছে গেছে গ্রাম-গঞ্জের অজোপাড়াগাঁয়ে। মাদক ব্যবসায়ীদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শক্তিশালী জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সারা দেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাদকের ধরন ও চাহিদার পরিবর্তন ঘটছে।
গত আশির দশকের শুরুতে দেশে হেরোইনের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পরে ভয়াবহভাবে হেরোইনের বিস্তার ঘটে। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ে মাদক রাজ্যে। নব্বই দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও তখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখন সেই ইয়াবায় ভাসছে গোটা দেশ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।