প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে ইয়াবার আগ্রাসন। মিয়ানমার থেকে জন্ম নেওয়া এ ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকছে টেকনাফ হয়ে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচকানাচে। কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না ইয়াবা পাচার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনসচেতনতা এখন আর কাজে আসবে না।
প্রয়োজন প্রশাসনের কঠোর নজরদারি এবং ইয়াবা পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রথম ইয়াবা আমদানি হয় একজন সংসদ সদস্যের মাধ্যমে তিনি বিদেশ ভ্রমণকালে। তখন বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে সেবন করানো হতো বলে এর প্রসার ছিল সীমিত। সে সময় একটি ট্যাবলেটের দাম ছিল আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। ফলে হাতেগোনা কয়েকজন উচ্চবিত্তশালী এটি সেবন করতেন।
প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ইয়াবা আমদানি করে গুলশান নিকেতনের জুয়েল। সে ধরা পড়েছিল ২০০২ সালে। ইয়াবা এনেছিল বিমানপথে থাইল্যান্ড থেকে। তখন এর বাজারমূল্য ছিল প্রতি পিস দুই হাজার টাকা। ইয়াবা-সম্রাট আমিন হুদাও প্রথম থাইল্যান্ড থেকে বিমানপথে, পরে নিজেই রাসায়নিক উপাদান এনে গুনশানে রীতিমতো ইয়াবার কারখানা খুলে বসেছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশে ইয়াবা একটি মারাত্দক সমস্যা ও ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভৌগোলিক কারণে মিয়ানমার বাংলাদেশের পাশাপাশি (২০৮ কিমি স্থল, ৬৩ কিমি জল সীমান্ত) হওয়ায় জল ও স্থলপথে সহজেই ইয়াবা পাচার হয়ে আসছে। এমনকি আকাশপথেও ইয়াবা আসছে বলে জানা যায়। ৪০-৪৫ বছর ধরে থাইল্যান্ডে ইয়াবার উৎপাদন ও ব্যবহার হলেও পরবর্তী সময়ে এটি সীমান্ত হয়ে মিয়ানমারে পাচার হতে থাকে। একটি সময় থাইল্যান্ডের বিভিন্ন তেলস্টেশনে এই ইয়াবা বিক্রি হতো।
তখন মূলত ট্রাকচালকরা এটি সেবন করে দীর্ঘপথ না ঘুমিয়ে গাড়ি চালাত। কিন্তু দেখা গেছে, সে সময় রাস্তায় অনেক দুর্ঘটনা ঘটত। ফলে ১৯৭০ সালে থাইল্যান্ডে সরকারিভাবে ইয়াবা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বিগত বছরগুলোতে দেখা যায়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পাচার করা ইয়াবা বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার লোকজন মিলে বাংলাদেশে প্রবেশে সহযোগিতা করছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের সহায়তায় জানা যায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কিছু লোক ইয়াবা উৎপাদন করে দালালদের মাধ্যমে সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাচার করে থাকে। বর্তমানে একটি বড়ির দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। সময়ের সঙ্গে অন্য সব কিছুর দাম বাড়লেও ইয়াবা ব্যতিক্রম। ২০০২ সালে সীমিত আকারে টেকনাফ এলাকার নাফ নদের সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ইয়াবা আনা শুরু হয়েছিল। ২০০৩ সাল থেকে ইয়াবা ডিলারদের জন্য ওই রুটটি হয়ে যায় সবচেয়ে নিরাপদ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানান, অতিসম্প্রতি টেকনাফ এলাকায় তারা নজর দিলে ডিলাররা অন্য নতুন দুটি রুট বেছে নিয়েছে। তা হলো বান্দরবানের গহিন অরণ্যের চাকঢালা সীমান্ত ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্ট মার্টিনের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার। ওই দুটি রুট দিয়ে কিছু ইয়াবা মিয়ানমার থেকে সেন্ট মার্টিন আসার পর তা কঙ্বাজার হয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় স্পট বা রুট টেকনাফের নাফ নদী।
এ ছাড়া সীমিত আকারে নাফ নদে চলাচলকারী ট্রানজিট নৌকার মাধ্যমে ও স্থলবন্দর দিয়ে কিছু ইয়াবার আমদানি চলে। আবার ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে ইয়াবার ডিলারও পরিবর্তন হয়ে যায়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন যুবদল ও ছাত্রদল নেতারা, আর এখন তা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের দখলে। মূলত তাদের মাধ্যমেই দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ইয়াবা ব্যবসা ও সেবনের প্রসার ঘটে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ইয়াবার প্রতি ঝুঁকে পড়ছে বেশি।
এ ছাড়া গুলশানসহ ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকার অনেক ফ্ল্যাটে রাতে ইয়াবার আসর বসে বলে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমগুলোর খবর প্রকাশ। সূত্র জানায়, আসক্তদের মতে অন্যান্য মাদকের তুলনায় ইয়াবা অধিকতর বেশি কার্যকর ও উত্তেজক হওয়ায় এর ব্যবহার, চাহিদা দুটোই বেশি। এমনকি হেরোইনের চেয়েও। উদ্বেগের বিষয় হলো, ইয়াবা ব্যবহার বাংলাদেশের শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণী থেকেই শুরু হয়েছে এবং এখনো চলছে। শুরুর দিকে এ দেশের অভিজাত এলাকার বিভিন্ন নাইট ক্লাবসহ আবাসিক হোটেলগুলোতে ইয়াবার ব্যবহার হলেও বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নশ্রেণীর দিনমজুর পর্যন্ত ইয়াবায় আসক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্কুলের ছোট ছোট ছাত্রদের কাছে ইয়াবা বিক্রি করা হয় বলে পত্রপত্রিকায় এসেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ঢাকা নগরীতেই প্রতিদিন রয়েছে ১৪ লাখ ইয়াবার চাহিদা।
কক্সবাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হারুন রশিদ জানান, ইয়াবা দুদিকেই কাটছে। এটি যুবসমাজ ও অর্থনীতিকেও শেষ করে দিচ্ছে । কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, ইয়াবার ছোবলে এ দেশের যুবসমাজ ধ্বংসের মুখে।
ইয়াবার অভিশাপ চিরতরে দূর করতে সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
জেলার মাদক নির্মূল কমিটির সভাপতি আবদুর রহমান জানান, মাদক ব্যবসার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ যুবলীগ-যুবদল, ছাত্রলীগ-ছাত্রদল, আওয়ামী লীগ-বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে অপরাধের ডালপালা বিস্তার লাভ করে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, থাইল্যান্ডে ইয়াবার আগ্রাসন রোধ করতে তিন হাজার ব্যবসায়ীকে ক্রসফায়ারে দিয়েছিল দেশটির সরকার। মিয়ানমার সীমান্তে তো মাত্র দুইশ' ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছে।
তাদের রোধ করতে পারলেই প্রাথমিকভাবে ইয়াবার প্রবেশ বন্ধ হবে। অন্য এক প্রতিবেদনে জানা যায়, টেকনাফে চিহ্নিত ২০টি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের তিন শতাধিক সদস্য দেশের সর্বত্র পেঁৗছে দিচ্ছে ইয়াবা। তালিকাভুক্ত ৯৭ জন গদফাদার নিয়ন্ত্রণ করছে এই সিন্ডিকেট। তারাই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বা ম্যানেজ করে নিয়ে আসছে ইয়াবার চালান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।