আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইয়াবার আগ্রাসনে তারুণ্য

বারিধারা এলাকার অভিজাত এক স্কুলছাত্রীর আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন অভিভাবকরা। খোঁজ নিয়ে তারা যা জানতে পারেন, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। মেয়ে মরণনেশা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। একইভাবে বনানীতে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থীকে নিয়ে বিব্রত বাবা উচ্চপদস্থ আমলা। গভীর রাতে থানা থেকে ফোন যায় তার কাছে।

নেশার টাকার জন্য ছিনতাই করতে গিয়ে ছেলে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। এর পরই টনক নড়ে বাবা-মার। ধানমন্ডির বাসিন্দা প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ীর আদরের ছেলের নেশার হাতেখড়ি কলেজ-জীবনে। নেশার টাকার জন্য একপর্যায়ে ছিনতাই থেকে শুরু নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সে। এখন অবশ্য সে কারওয়ান বাজারের ফুটপাতের হকার।

সর্বশেষ সর্বনাশা মাদক পুরো জীবনটাই এলোমেলো করে দিয়েছে অঙ্ফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের 'ও' লেভেলের ছাত্রী ঐশী রহমানের। নেশার টাকার জন্য বন্ধুদের নিয়ে ঐশী নৃশংসভাবে হত্যা করল নিজেরই মা-বাবাকে।

ইয়াবা, ফেনসিডিল, হোরোইন- সর্বনাশা ভয়ঙ্কর সব মাদকের থাবায় এভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে এমন অসংখ্য অভিজাত পরিবারের সন্তানদের জীবন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদকের ছোবল আগামী প্রজন্মকে দাঁড় করিয়েছে ধ্বংসের মুখোমুখি। এতে করে ভবিষ্যতে দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মাদকের ভয়াবহ এই আগ্রাসন নিয়ে সরকার যেমন উদ্বিগ্ন, চিন্তিত অভিভাবক মহলও। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে বাড়ছে মাদক ব্যবসা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ্বংস করে মাদক ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাদকের ধরন ও চাহিদার পরিবর্তন ঘটছে। আশির দশকের শুরুতে দেশে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় হেরোইনের।

পরে ভয়াবহভাবে বিস্তার ঘটে এর। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ে মাদকরাজ্যে। নব্বইয়ের দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি তখন। এখন সেই ইয়াবা বড়িতে ভাসছে গোটা দেশ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই এখন ইয়াবায় আসক্ত।

মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতেও এখন সবচেয়ে বেশি রোগী ইয়াবাসেবী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইয়াবার প্রথম প্রবেশ নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। এটি আলোচনায় আসে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার বিত্তভিত্তিক নেটওয়ার্ক শুরু হয় নগরীর গুলশান-বারিধারা থেকে। পরে বনানী, নিকেতন ও উত্তরায় ছড়িয়ে পড়ে তা।

এসব নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা। অভিজাত এলাকাগুলোর ক্লাব, রেস্তোরাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজ টার্গেট করে বিস্তারকারীরা। সে সময় নেটওয়ার্কের অনেককেই গ্রেফতার করে র্যাব। তারা ছাড়া পাওয়ার পর ফের সম্পৃক্ত হয় ইয়াবা ব্যবসায়। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বখে যাওয়া ধনীর সন্তানেরা গড়ে তুলেছে 'ইয়াবা ক্লাব'।

সেখানে দিনে বা রাতে তরুণ-তরুণীরা মত্ত হয় ইয়াবার নেশায়। নানা অপকর্মের সঙ্গে নিজেদের করে সম্পৃক্ত। পড়াশোনার নাম করে ক্লাবে জমে ওঠে ইয়াবার আড্ডা। কালের পরিক্রমায় সেই ইয়াবা এখন ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর অলিগলিতে। বিক্রি হচ্ছে হরদম।

এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে পাওয়া যাচ্ছে না ইয়াবা। শহর ছাড়িয়ে এ নেশা প্রবেশ করেছে অজপাড়াগায়।

ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক বলেন, মস্তিষ্ককে চরমভাবে উদ্দীপ্ত করে ইয়াবা। এটি সেবন করলে তাৎক্ষণিকভাবে হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ ও শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে মস্তিষ্কের কিছু কোষের।

ইয়াবা সেবন করামাত্র হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে হৃদ-দুর্বল ব্যক্তিদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এটি সেবনে উচ্চরক্ত চাপ ও হৃদরোগ বৃদ্ধি, হজমশক্তি নষ্ট হওয়া ও শরীর দুর্বল হয়ে পড়া, পিঠে ব্যথা, ফুসফুস ও কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উদ্ভব হতে পারে হতাশা, বিষাদ, ভয়, অনিশ্চয়তার। এ ছাড়া এটি সহিংস করে তুলতে পারে আচরণগতভাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সালমা আকতার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ার পেছনে দায়ী করলেন সামাজিক পরিস্থিতিকে।

তিনি বলেন, সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে কি না এ বিষয়ে খোঁজখবর বাড়াতে হবে বাবা-মাকে। শিক্ষকদেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আগে শিক্ষকরা শ্রেণীর বাইরে গিয়েও অনেক দায়িত্ব পালন করতেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ভালো শিক্ষাটাই দিতেন শিক্ষার্থীদের। এখন আর তা লক্ষ্য করা যায় না।

তিনি বলেন, এ সমস্যা থেকে উত্তরণে দরকার পারিবারিক বন্ধন আরও জোরদার করা। সন্তানরা যদি বাবা-মার কাছে কোনো কিছু শেয়ার করতে না পারে, তাহলে তারা ঝুঁকে পড়ে বাইরের দিকে।

শুধু রাজধানীতেই ১৫ হাজার

চার গ্রেডের মিলে শুধু রাজধানীতেই ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১৫ হাজার। বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি ওয়ার্ডে রয়েছে দুই শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। জানা যায়, হাত খরচের টাকা বেশি পাওয়া ছেলেমেয়েরাই এখন ইয়াবার নেশায় আসক্ত।

এমনকি চিকিৎসক, প্রকৌশলী, তরুণ ব্যাংকারদের কাছেও ইয়াবা ভীষণ প্রিয়। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিপণিবিতান, মার্কেট, জমজমাট এলাকাসহ বিভিন্ন রেস্তোরাঁকে কেন্দ্র করে মাদক ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। আকারে ছোট এসব বড়ি লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখা যায় বলে সম্ভব হচ্ছে না বিস্তার রোধ করা।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.