আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলোচনাঃ নিক্কর ৮৫ মিমি এফ ২ এআই, ১৯৭৮


নাইকনের অনবদ্য, অসাধারণ ৮৫ মিমি এফ ২ এআই লেন্স।

মানুষের মুখমণ্ডলের ছবি দেখতে আমাদের কারই বা ভালো না লাগে। সেই মানুষ যদি কাছের মানুষ হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। মানুষের মুখটুকু বিশিষ্ট এবং তীক্ষ্ণ রেখে পেছনের জায়গাগুলি অদৃশ্য করার বিষয়টি পছন্দ করেন না এমন কাউকে দেখা যায় কি? শুধু ক্যামেরা কিন্তু এই কাজ করেনা, লেন্সের ভুমিকাই এখানে মুখ্য। ঠিক কোন ধরনের লেন্সে এই কাজটি সবচাইতে ভাল হয়? অনেককে বলতে শুনি, ৮৫ মিমি লেন্স যে পার্স্পেক্টিভ আনে তাতে এই দূরত্বে তোলা মানুষের মুখমণ্ডল চমৎকার ইমেজের জন্ম দেয়।

আমি নিজে ৮৫ মিমি ব্যাবহার করে বলতে পারি যে শুধু মানুষের মুখই নয়, আমি এই লেন্স দিয়ে যে জগত দেখি তেমন দেখার শান্তি আর কোন লেন্সে পাইনা। বিশেষ করে আমার ম্যানুয়াল এফই ক্যামেরায় এটা একবার মাউন্ট করে আমি আর খুলতে পারিনা। মনে হয়, আরে এমন জগত-ই তো আমি দেখতে চেয়েছি সবসময়! কিন্তু ৮৫ মিমিই বা আমাদের দেখার জগতে এত স্বতন্ত্র হতে যাবে কেন! এই প্রশ্নের উত্তর আসলে স্বতন্ত্র আলোকচিত্রগ্রাহকরাই দিতে পারবেন ভাল। আগেই বলেছি, এক এক ধরনের ফোকাল লেন্থের লেন্স এক এক ধরণের পার্স্পেক্টিভের সন্ধান দেয়। আমার ভাল লাগে ৮৫ মিমি।

তাই বলে সকলের যে এটাই ভাল লাগবে এমন কোন কথা নেই।

১৯৭৮ সালে প্রথম বাজারে আসে নাইকন ৮৫ এফ ২ এআই লেন্সটি। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এই লেন্সের নির্মাণ কাল। যেহেতু এই লেন্সের সর্বোচ্চ আ্যাপার্চার ১.৪ কিংবা ১.৮ নয়, কাজেই এই লেন্সের আকার আকৃতি ছোট রেখে এর দাম তুলনামুলক ভাবে কম রাখে নাইকন কোম্পানি। আর এটিই নাইকনের এখন পর্যন্ত একমাত্র এফ ২ লেন্স।

প্রথমে বলে নেয়া ভাল যে এই লেন্স নাইকনের সকল এসএলআর এবং ডিএসএলআর ক্যামেরায় মাউন্ট হবে। ডিএক্স কিংবা ক্রপ ডিএসএল ক্যামেরাগুলির মধ্যে এই লেন্স মেট্রিক্স মিটার দেবে শুধুমাত্র ডি ৭০০০ এবং ডি ৭১০০ তে। এই দুটি ক্যামেরার মেন্যুতে ঢুকে এই লেন্সের কিছু তথ্য সংযুক্ত করে নিতে ব্যাস, আর কোন চিন্তা নেই। আর বাকি সব ডিএক্স ক্যামেরায় মিটারের কাজ ম্যানুয়ালি করতে হবে। যেহেতু ম্যানুয়াল লেন্স কাজেই ফোকাসের কাজটি হাত দিয়েই সারতে হবে।

ক্রপ ক্যামেরাগুলিতে এই লেন্সের ফোকাল দূরত্ব কিন্তু ৮৫ মিমি থাকবেনা, হয়ে যাবে ১২৭.৫ মিমি।

এই লেন্সের নির্মাণ গুন এক কথায় অসাধারণ। এর আয়তন এবং উচ্চতা দুটোই আকারে অন্যান্য ৮৫ মিমি লেন্সের চাইতে ছোট। এটি এখন পর্যন্ত নাইকনের ক্ষুদ্রতম ৮৫ মিমি লেন্স। এই লেন্সের আকৃতি নাইকনের যে কোন ৫০ মিমি লেন্সের সমান বলে মনে হয়।

এটি একাধারে বিস্ময়কর এবং বলা যায় নাইকনের প্রকৌশলী এবং নকশাবিদদের কর্মদক্ষতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার অনন্য নিদর্শন। এই লেন্স যে কোন ক্যামেরায় দারুণ মানিয়ে যায়। সেটি হোক নাইকন ডি ৪০ কি ডি ৮০ কি ডি ৭০০০, এমনকি আমার ম্যানুয়াল ক্যামেরা এফই-র সাথে এই লেন্স দেখতে অনবদ্য লাগে! এখানে জানিয়ে রাখি যে পারদর্শিতা ছাড়াও লেন্সের সৌন্দর্য এবং আকৃতি কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা আমি যে ক্যামেরা এবং লেন্স বহন করছি তার মধ্যে যদি নান্দনিক সৌন্দর্যের ঘাটতি থাকে তাহলে ব্যাবহার করে তো আরাম পাওয়া যায়না! এইদিক বিবেচনা করলে নাইকনের এই ৮৫ মিমি এফ ২ এআই এক কথায় চ্যাম্পিয়ন।
এই লেন্সের কয়েকটি ছবি দেখে নিই এইবার, কাছে থেকে।



দেখতে এই লেন্স একটি জেম। হীরকখণ্ড!

লেন্স হুড এইচএস ১০ যুক্ত করলে এমন লাগে।

লেন্সের পেছন দিকটা। ফুল মেটাল।

আমার লেন্সের নম্বর খোদাই করা রয়েছে, ১,৯৪,২৬০।



এই লেন্স একটি ফুল মেটাল লেন্স। এর ফোকাস রিং মেটাল। ফোকাস রিং এর বাইরের অংশে রয়েছে রাবার গ্রিপ। নাইকনের অন্যান্য ম্যানুয়াল লেন্সের মতই এর ফোকাস রিং ঘোরানোর অভিজ্ঞতা খুবই পেলব এবং মোলায়েম। লেন্সটি আকারে ছোট হলেও অনেক ভারী।

খালি হাতে লেন্সটি ধরলে শক্ত পোক্ত অসাধারণ এক অনুভূতির সন্ধান মেলে, আজকালকার হাল্কা পাতলা প্লাস্টিক লেন্সগুলিতে এই অনুভব কোথায়? আকারে ছোট হওয়ায় এই লেন্সের সম্মুখভাগে ৫২ মিমি ফিল্টার যুক্ত করা যায়। যেখানে ইদানিং সব ৮৫ মিমি লেন্সের ফিল্টারের আকার অনেক বেশী, এদের কোনটি ৬৬ আবার কোনগুলি ৭৭, এর আ্যাপারচার রিঙটিও মেটাল আর জন্মের শক্ত, এই রিং হাল্কা করে ঘুরিয়ে কোন লাভ হবেনা, জোর লাগবে। এই লেন্সের আ্যাপারচার ব্লেড মোট সাতখানা। আ্যাপারচার ব্লেডের সাথে ব্লার অংশের কোয়ালিটি জড়িত। যদিও এই লেন্সের ব্লেড সংখ্যা অন্যান্য ৮৫ মিমির চাইতে কম তবুও আউট অফ ফোকাস অংশগুলি অন্যদের চাইতে কম মসৃণ, তা বলা যাবেনা।

এই লেন্সের আ্যাপারচার সংখ্যা ২ থেকে ২২, নতুন ৮৫ মিমি লেন্সগুলির সর্বনিম্ন আ্যাপারচার মুল্য ১৬ পর্যন্তই সীমিত। এই লেন্সের নির্মাণ কাল ১৯৭৮ সাল হলেও এটি উৎপাদিত হয়েছে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। মানে দীর্ঘ ১৬ বছর! বোঝাই যায় নাইকন ব্যাবহারকারিরা কত দীর্ঘ সময় ধরে এই লেন্সটির চাহিদা বজায় রেখেছিলেন! এমন কি যুক্তরাষ্ট্রে এই লেন্সের ভাল মানের স্যাম্পলের সেকেন্ড হ্যান্ড বাজার মূল্য গত পাঁচ বছর ধরেই $২৫০ ডলার যার তেমন কোন পতন চোখে পরেনা। তার মানে হল যারা এই লেন্স একবার ব্যাবহার করেছেন, তারা হয় এটি বিক্রি করতে আগ্রহী নন কিংবা বিক্রি করলেও দাম কমাতে রাজী নন! এই লেন্সগুলির সবই জাপানে নির্মিত।
নীচে দুটো ছবি যুক্ত করছি যেখানে এই লেন্সের সাথে দুটো লেন্সকে দেখানো হল।

একটি নিক্কর ৩৫ ডিএক্স ১। ৮ জি এবং আরেকটি নাইকনের ক্ষুদ্রতম লেন্সগুলির একটি ৫০ ১। ৮ ডি।


নিক্কর ৩৫ ১। ৮ জি এবং ৫০ ১।

৮ ডি দুটোই ভীষণ জনপ্রিয় দুটি লেন্স। তবে ওপরের ছবি দেখে বোঝাই যাচ্ছে, ৩৫ ১। ৮ আমাদের আলোচ্য লেন্সটির চাইতে অনেক বেশী পেটমোটা এবং লম্বায় খানিকটা বড়। আর ৫০ ১। ৮ ডি লম্বায় খাটো হলেও মনে রাখা দরকার এই লেন্স নাইকনের খুদ্রতম লেন্সগুলির মধ্যে একটি।

আধুনিক ৫০ ১। ৪ কিংবা ৫০ ১। ৮ দুটোই উচ্চতা এবং চওড়ায় বেশী। হাতের কাছে না থাকায় পার্থক্য দেখানো গেলনা যদিও!

নাইকনের সব ৮৫ মিমি লেন্স শার্পনেসের জন্য জগদ্বিখ্যাত। এই লেন্সও তার ব্যাতিক্রম হতে যাবে কেন! তবে এখানে একটা কিন্তু আছে।

এই লেন্সের সর্বোচ্চ আ্যাপারচার এফ ২ এ তোলা ছবিগুলি ঘোলা। যার অর্থ হচ্ছে এই আ্যাপারচারে ভাল রকম ক্রোমাটিক আ্যবেরেশন আছে এই লেন্সে। তবে এক স্টপ কমিয়ে অর্থাৎ ২.৮ এ ছবি তুললে আর কোন সমস্যা চোখে পরেনা। এই সমস্যা অবশ্য শুধু যে এই লেন্সের তা নয়, অনেক লেন্সের সর্বোচ্চ এফ পয়েন্টে এই সমস্যা বিদ্যমান। যারা এফ ২ তে ছবি তোলায় আগ্রহী তাঁরা এই লেন্স কিনে হতাশ হতে পারেন।

এই লেন্সের সুইট স্পট হচ্ছে এফ ৪, ৫.৬, ৮ এবং ১১, এই আ্যাপারচারগুলিতে এই লেন্স দিয়ে অসাধারণ শার্প ছবি আসে। শুধু শার্প-ই নয়, অনন্য কালার এবং কনট্রাস্ট মেলে। এই লেন্সে কোন ডিস্টরশন নেই। তার মানে আপনি যে ছবিই তুলুন না কেন, আঁকা বাঁকা ছবি ওঠার কোন সুযোগ নেই। নাইকনের সকল ৮৫ মিমিই অবশ্য এই সমস্যামুক্ত।



আগেই বলেছি আমি যে লেন্স দিয়ে জগতকে দেখতে চাই সেটিই দেখায় এই ৮৫ মিমি। আমি নিজে যখন আমার কন্যা কিংবা আমার পরিচিতদের ছবি তুলতে গেছি তখন এই লেন্স ক্যামেরা এবং সাবজেক্টের মাঝে বেশ খানিকটা স্পেস এনে দিয়েছে। তাই ব্যাক্তি হিসেবে সাবজেক্ট তেমন একটা বিরক্ত বোধ করেনি কখনো। শুনেছি ৮৫ মিমি লেন্সকে সবাই পোর্ট্রেট লেন্স হিসেবে মনে করে। কিন্তু আসলে শুধু এটিকেই কি আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা যায়? ৮৫ হোক চাই ১০৫, কি ১৩৫ কিংবা ১৮০, ২০০, ৩০০, ৪০০ দিয়ে এত অসাধারণ সব পোর্ট্রেট দেখি যে শুধু এই লেন্সটিকেই আদর্শ বিবেচনা করতে ইচ্ছে করেনা।

তবে এটা আমার মনে হয়েছে যে দূরত্ব অনুযায়ী এই লেন্সের সাথে সাবজেক্টের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে। এটি যেমন খুব কাছের দূরত্ব নয় তেমনি খুব দুরেরও নয়। মাঝামাঝি বলা যায়। এই দূরত্ব থেকে ছবি তুললে সাবজেক্ট বুঝবে যে ছবি তোলা হচ্ছে, তারপরেও সে স্বাভাবিক থাকবে, ভীত সন্ত্রস্ত হবেনা, ক্যামেরার সাথে একটা যোগ সৃষ্টি হবে। এমনটাই আমার ছবি তোলার অভিজ্ঞতা বলে!

এই লেন্স দিয়ে আমি বর্ষণ-সিক্ত সবুজ পাতা, আলোকসজ্জায় সজ্জিত পুরনো শহর, সবুজ ঘাসে হলুদ ফুলের আবাস, আমার কন্যার মিষ্টি মিষ্টি দুষ্টুমি, অন্ধকারের ভেতর অল্প আলোয় ভেসে ওঠা তাঁর কোমল মুখ, স্ত্রীর ভালবেসে চেয়ে থাকা, শহরের রঙিন দোকান, ছাই হয়ে যাওয়া শহরের স্মৃতি- এই সব অসাধারণ সব মুহূর্তকে ধারণ করে বিমলানন্দ উপভোগ করেছি।

ছবি তুলতে গিয়ে কখনো হতাশায় ম্লান হয়েছি আবার কখনও আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছি। তবুও চিত্রগ্রহনের এই সংক্ষিপ্ত পথ পরিক্রমায় আলোকচিত্রকে ভালবাসতে দিয়েছে আমাকে এই লেন্স। যখন ডি ৪০ তে এই লেন্স মাউন্ট করলে মিটার হতনা, ফোকাস হতনা, খুব যন্ত্রণায় ভুগতাম। মনে হত এই জগত আমার জন্য নয়। আবার যখন এই লেন্স দিয়েই পুরনো ঝলমলে প্রাসাদের ছবি, কিংবা কাছের মানুষদের মুখমণ্ডল মন দিয়ে সময় নিয়ে ভালো করে তুলেছি, মনটা ভরে উঠেছে।

এখন যখন ডি ৭০০০ এ এই লেন্স মিটার দিচ্ছে তখন আরও সুবিধে হয়েছে। শুধু ফোকাসটা হাত দিয়ে করতে হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে আপত্তি তো নেই! আপত্তি কি কখনোই ছিল?
এইবার কিছু ছবি যুক্ত করার পালা।




























সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.