উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি
রুনা বন্দোপাধ্যায়ের লেখার লিংকটা: http://www.kbws.net/mitali/node/1944#new
কবি মুক্তি মন্ডল এক পরিচিত নাম। এপারবাংলা ওপারবাংলা ছাড়িয়ে বহির্বাংলার মানুষের কাছে একুশ শতকের এক উজ্জ্বল ঐশ্বর্যময় কবি। ২০০৮ সালে কৌরব থেকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ঘড়ির কাঁটায় ম্যাটিনি শো”, যেখানে সুশীল সমাজের সীমাবদ্ধ করিডোর পেরিয়ে তিনি হেঁটে যান সোজা ও সতর্ক ভঙ্গিমায় আর হাতে ধরে থাকা “এথনোগ্র্যাফিক বাইনোকুলার” নিয়ে গভীর নিরীক্ষণে দেখতে থাকেন নৈতিকতার ম্যাচবাক্স। কবির আঙুল ছুঁয়ে বাংলাভাষার অলীক শব্দভান্ডার উপচে ওঠে সফেন উষ্ণতায়। শহর ও গ্রামের ক্ষয়িষ্ণু জীবনের অন্তরমহল স্পর্শ করেন প্রাণময় ভালোবাসার স্বচ্ছ আতসে।
সেই চেনা কবির অচেনা কাব্যগ্রন্থ ‘পুষ্পপটে ব্রাত্য মিনতি’, ২০০৯ সালের বইমেলায়, প্রকাশনা জোনাকরোড। নামকরণেই প্রথম চমক। ব্রাত্য বলতে আমরা ব্রতভ্রষ্ট বুঝি। স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন ওঠে কোন ব্রত থেকে ভ্রষ্ট হলেন কবি? জানতে হলে আসুন প্রথমেই পড়ে ফেলি কবির ভূমিকাটুকু,
“পুষ্পরেণুতে পোকার যে পরিভ্রমণ, যে উচ্ছ্বলতা তার অন্তর্গত সলকে ব্রাত্য মিনতি, মুখোশ সরিয়ে দেখার আয়না ভেঙে নিজেকেই- টুকরো টুকরো দেখা, আর জোড়া লাগানোর চেষ্টা। “
নিজেকে দেখার অতৃপ্তি নিয়ে কবির পিচ্ছিল সরণ বাধা পায় কংক্রিটের চারদেয়ালে; নাচের স্কুলে অলকগুচ্ছের কুহকে যেখানে নদীহীন মুখের মানুষেরা যেচে যেচে আসে, সেখান থেকে মুক্তির পাখিরা ডানা মেলে দূরতম দ্বীপের টুকরো টুকরো আকাশে, গড়ে তোলে মেঘবৃষ্টির বাসা, দিগন্তের প্রলোভনে সংসারের মায়া ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়ে ‘সহজ মানুষের হাটে’,
“এদের ভেতর প্রতারণা বলে কিছু নেই, এরা আওলানো
জীবনের খানাখন্দে পরিভ্রমণে বের হয়
পুঁথিগ্রন্থের ময়লা ছেঁড়া পাতার কোণে এদের সংরাগ, বাসনা
মনোরীতির জঙ্গল হিসেবে স্থিতি পেয়েছে।
এরা কোনও সংহত শৃঙ্খলে আটকে থাকতে চায় না
দীপ্তির ভাষা তাদের চোখে-মুখে সমুদ্রস্নান। “ [‘সহজ মানুষের হাটে’]
কবিতার নিজস্ব স্পেসে কবি পাঠককে স্বাগত জানান। স্পর্শ করতে চান পাঠকের অনুভবের মাত্রাগুলি। হাত রাখতে চান সংবেদনশীল চেতনার পরিসরে। আর তারপরেই দেখি কবির সচেতন অতিক্রমণ।
কবিতার স্পেসের সঙ্গে এতক্ষণের আসঙ্গলিপ্সা কবি অতিক্রম করে যান এবং একরৈখিকতার দেওয়াল ভেঙে কবিতাকে উত্তীর্ণ করে দেন বহুরৈখিকতায়; আমরা দেখতে পাই ডাকিনিপাড়ার মেয়েরা পা খুলে নিয়ে যায় কবির আর ‘তুমি’ হয়ে ওঠে ‘রুমালের হলুদ আকাশ’,
“কেউ জানে না কাল আমার পা খুলে নিয়ে গেছে
ডাকিনিপাড়ার মেয়েরা
ওদের কাছে আমার ফুলগুলি শুকিয়ে শুকিয়ে
এখন মচমচে, তাদের রিমঝিম ঠোঁট
আমি দেখেছি পালের ওপর তোমার চুল
হাতের ভেতর জগতের সব আরাধনা
তারা ফুল হয়ে ওঠে
তারা কাঠের গায়ে পাখির পালক হয়ে ওড়ে
আমি পাপড়ির মধ্যে সুরের নীরব ডুবুরি
আলগা করে দেখি
তুমি রুমালের হলুদ আকাশ” [‘তুমি রুমালের হলুদ আকাশ’]
ইচ্ছের বংশীবাদক ডাকাডাকি করলে কবিতায় ভ্রমণ পিপাসু কবির রেহাই নেই। অথচ চোখের সড়ক বরাবর সমস্ত মাইলপোষ্ট ছায়া হয়ে নামে, কবির কোথাও যাওয়া হয় না। বাসনার নাও নিয়ে বিরহপাড়ার বণিকেরা যখন বন্দর ছেড়ে যায়, তখন কবি গভীর স্বরে উচ্চারণ করেন, “এবার গভীর গাঙে ছেড়ে দেবো শ্লোকের বিষণ্ণ ভেলা / জলের শব্দে আকাশের হাতছানিতে আর বাড়িতে ফিরবো না”। কবির ভ্রমণে রওয়ানা দেওয়া আছে, পৌঁছনোও আছে কিন্তু কোথায় পোঁছনো? নাকি ফিরে ফিরে আসা নিজেরই অপরিমেয় অনুভূতির নিজস্ব এলাকায়? যেখানে অস্পষ্ট তিলের দিকে কবির অগ্রসরে উড়ে যায় ডানামেলা পাখিদের ঝাঁক, টুপ শব্দে ডুবে যায় চাঁদ নদীর কাছে গিয়েই কিংবা প্রগাঢ় সম্পর্কসেতুর ভাঙনে গড়িয়ে যায় ভ্রমণপেয়ালা আর সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় কবি দেখেন,
“আয়নামহলে চুড়ি হাসির পায়রাগুলো উড়ে উড়ে
কোথাও বসেনি, গাছেদের কাছে
এগিয়ে এসেছে দূরের কেউ,
তাকে কেউই চেনে নাই, হরেকরকম ঝুমঝুমির ভেতর
হারিয়ে গেছে যেসব ডালে বসা সবুজ দাগের
চিহ্ন, তাদের বুকের পাশে শুকনো নদীদের মেলা বসেছে” [‘ভ্রমণ’]
কবি বলেন, “ একটি শব্দের সঙ্গে আরেকটি শব্দের এসোসিয়েশান ঘটে দৃশ্য ও ভাবনার একসাথে সমন্বয় করার কারণে। এইটা করতে গিয়ে দৃশ্য ও ভাবনার ভেতর দিয়ে জগতকে দেখা আর সেখানে নিজেকে সামিল করা।
এর ভেতর দিয়েই কবিতাযাপন। ” এই কবিতাযাপনেই নৌকোর ভেতর লুট হয়ে যায় বিহ্বলতা, তার পালের দড়ি উড়িয়ে জাগরণের জানলা বেয়ে নামতে থাকে রোদ্দুর,
“গমন পথের চারপাশ জেগে উঠছে প্রস্ফুটিত আঁধার
কড়ির সাদা চোখে বসন্ত সরিয়ে
নীল কামরায় ঢুকে পড়ছে শীতের দহন, নীল টেলিগ্রাম।
জানালার কাঁচে লুপ্ত ভোর স্নান
শরীরে সবকটা কপাট খুলে উড়িয়ে দিচ্ছে
তিলোত্তমা উত্ফুল্ল গাল। আমি মাথা
নুয়ে থাকি, স্নায়ুর গভীরে
তোমার গ্রীবার উপর আঙুলের জলছাপ তলিয়ে গেছে
আমি টের পাই নাই” [‘রোদ্দুর’]
কবি তার দ্বিতীয় জীবনে কবি হলেও প্রথম জীবনে তিনি সমাজবদ্ধ মানুষ। তাই তাঁর চেতনে মননে সমাজ সচেতনতা গড়ে ওঠে স্বাভাবিকভাবেই।
প্রাত্যহিক জীবনে সমাজের রুক্ষ্মতা ও ধূসরতার যাবতীয় ইঙ্গিত ও সংকেত থাকে কবির লেখনীতে, খোঁজ থাকে শুভবোধের। তাই দেখি কাঠ চেরাইকারী শ্রমিক ও রুমাল নির্মাতাদের ঘনিষ্ঠ চোখাচোখির অরণ্যে কবির ভ্রমণ। বাদাম বিক্রেতার সজল চোখ বেয়ে নামে আসা বর্ষণমুখর রাতের ধ্বনি শব্দলিপি হয়ে ওঠে কবির খেরোখাতায়। কিন্তু কবি তো সমাজবিপ্লবের অস্ত্র নয়; কিংবা সাম্যবাদের যন্ত্রও নয়। তাই তাঁর কবিতারও সমাজসংস্কারের কোনো দায় নেই।
কবিতার আঁচলছায়ায় পা মুড়ে বসলে পাঠকের অনুভূতি জাগ্রত হবে, এটুকুই শুধু কবিতার দায়। কবি শুধু দায়বদ্ধ তাঁর চেতনার কাছে, অনুভবের সত্ প্রতিফলনের কাছে, যা আরো একজনের চেতনায় টঙ্কার তুলবে, যা অনুরণিত হবে চেতনা থেকে চেতনায়। তরকারিআলার বাঁকের পাশে শুয়ে থাকা একফালি রোদে, যেখান থেকে স্পর্শ করা যায় জীবনের অন্তস্থল, সেখানে কবির মননের স্বচ্ছ আয়নায় প্রতিফলিত হয় চিরায়ত ফুলের রেণুতে ভ্রমণকারীরা,
“রেণুতে যারা ভ্রমণে যায়, তাদের আকাঙ্ক্ষা ও বাসনা
রাক্ষসী লোভের স্তুপ, বাজারি হট্টগোলে তাদের নখে,
চোখে-মুখে ভেসে ওঠে ভাগাড়ের অসংখ্য শেয়াল” [‘চিরায়ত ফুলের রেণু’]
পরিচিত ঘরানার উঠোন ছেড়ে এক ভিন্নমাত্রার কবিতা নির্মাণে আস্থাশীল কবি মুক্তি মন্ডল। সম্ভাবনার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। সেই অসীম সম্ভাবনাময় জগতে নিজেরই আলোসম্ভাবনার ঘেরে কবির চলন,
“ঘাই মেরে ওঠে রাতে খুব নিবিড় দেহভঙ্গির বাঁক
চেনা নয়, অজ্ঞাত, অন্য কেউ, গভীর পদধ্বনি
উড়ে যায় মেঘে মেঘে
না চেনা মুখের রঙে ভাসে
নিজেরই আলোসম্ভাবনার ঘের, কৈ লাফিয়ে ওঠে
তার কান্কোতে
স্তব্ধতার গুহাতে – অজ্ঞানতার সাপ, বুনোজন্তুদের
ভিড় ঠেলে –
মন ওইখানে যেতে চায় – তীব্রতীরের শৃঙ্গারে
সেই নেশাপুরের বাগান ঘেরা মোমঘরে” [‘আলোসম্ভাবনা’]
আমাদের চারপাশের চেনাজানা জগত্ নিয়ে রচিত অভিজ্ঞতা পাঠকের পরিচিত।
কিন্তু কবি সেই অভিজ্ঞতার কাল্পনিক সীমারেখা অতিক্রম করে যান। বহির্জগতের সৃষ্ট শব্দতরঙ্গ কবির ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে জারিত হয়ে যে কল্পচিত্র তৈরি করে তা অনেকসময়ই পাঠকের কাছে অচেনা। তাই কবিতায় ব্যবহৃত ভাষায় দৃশ্য সম্পর্কিত কিছু সূত্র কবি ছড়িয়ে রাখেন। সেই সূত্রগুলির হদিস নিতে নিতে পাঠক ঢুকে পড়েন কবিতার রহস্যময় বলয়ে। কবির ইমোশন আর কল্পনার জারকরসে অনবরত যে শব্দের শস্য ফলছে, সেই জেব্রাক্রসিং-এ শব্দগুলি যত রহস্যময় হয়ে ওঠে, ততই বাড়ে কবিতার ডাইমেনশান।
এই বহুরৈখিকতা মুক্তি মন্ডলের লেখনীর মূল্যবান সম্পদ,
“দৃশ্যবাদী কাঠুরে ও তার গোপন রান্না ঘরের
পাশে, আমি দেখি জানলায় ভালুকের ছবি, অর্ধেক নারী
অর্ধেক পুরুষেরা বৃক্ষের ছালের মধ্যে
চোখ ডুবিয়ে দেখছে পোকাদের
সুচুম্বন।
সুদূরে তার ছায়ার শীতে জড়োসড়ো কালো হরিণের ছাপ
যার কোলে মুখোশের দর্পচূর্ণ দেয়াল, নির্জন গ্রীবায়,
জঙ্ঘায় জাগিয়ে রাখে সুষমার সিঁথি। “ [‘দৃশ্যবাদী কাঠুরে’]
কবিতায় বোধ্য বা দুর্বোধ্য বলে কিছু হয় না। একটু মনোনিবেশেই বোঝা যায় কবি ও পাঠকের মিলনবিন্দুটি হল অনুভব। দৃষ্টিগ্রাহ্য বস্তুসমূহ কবির চেতনায় প্রতিফলিত হয়ে তৈরি করে এক বিমূর্ত উচ্ছাস, যার অবয়বে লেগে থাকে সমাজ বা রাজনীতির যাবতীয় ঘ্রাণ, লেগে থাকে বর্তমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির চোরাবালিতে সংকীর্ণ হয়ে আসা প্রেম ও জ্যোত্স্নার পারস্পরিক আকুতি।
মধু ও বিষে ভরা জগত্ সংসারে ভাবুক পথের প্রতিক্ষণটুকু কবি ধরে রাখেন নিরাভরণ মানুষের ভাষা ও ধ্বনিতে, যেখানে শব্দের রহস্যময় সংকেত, যেখানে ভাষার ভিন্নতর প্রয়োগ, যেখানে বাঁকা চাহনির ঘড়াভর্তি জল নিয়ে কবির জলসওয়া,
“বাঁকা পথের সবুজ নথে যে তৃষ্ণার মোড় ঘুরে
গেছে কাঁটাঝোপের রূপসী ঠোঁটে,
তার গভীর আড়ালে, আমি বক্ষ খুলে দেখি সুর
মাটির সরাতে দুধ
ফেটে, দুভাগ হয়ে গেছে শরের নদী।
একভাগে আমার লোভের মোহনায় ঢেউ ওঠে,
জলের কাঁপনে জন্মদাগে এসে
দাঁড়ায় বাহুর ছায়া।
অন্যভাগে, শীত ছাউনির করিডোরে চেয়ারের হাতলে
সমুদ্র ঘ্রাণে ভরে ওঠে – এই গন্ধ জাগিয়ে রাখে শরীর।
তোমার দেহের নৈশলিপি
উড়ে এসে ভরে তোলে ঘর, খুলে রাখি ঘরের জানালা।
উঠোনে গভীর মুগ্ধতার তুলশী গাছের কাছে
পড়ে থাকে নৈঃশব্দের ছাপ, বাঁকা চাহনির
ঘড়াভর্তি জল।
“ [‘বাঁকা চাহনির ঘড়াভর্তি জল’]
**********************
বইঃ পুষ্পপটে ব্রাত্য মিনতি
কবিঃ মুক্তি মন্ডল
প্রচ্ছদঃ রাজীব রায়
প্রকাশনাঃ জোনাকরোড, ঢাকা
প্রকাশকালঃ বইমেলা, ২০০৯
বিনিময়ঃ ৪০ টাকা
"ঘড়ির কাঁটায় ম্যাটিনি শো" কবিতার বইটা নিয়ে সুদীপ্ত'র আলোচনাটা এইখানে আছেঃ
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।