আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয় শাজাহান পরলোকে

১৬ জানুয়ারি আউলিয়াবাদে এনডিএফের জনসভা ছিল। প্রচার শুরু হয়েছিল ৬ জানুয়ারি থেকে। ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত তা নির্বিবাদেই চলছিল। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী হয়েই পাল্টা সভা ডাকেন। কিছুতেই আমাদের সভা হতে দেবেন না।

বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব ও মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের হেলিকপ্টারে যাওয়ার কথা ছিল। বিনা ভোটে নির্বাচিত এমপি তার এলাকায় হেলিকপ্টারও নামতে দেননি, তাই তারা যেতে পারেননি। দেড়-দু'শ লোক নিয়ে আওয়ামী লীগ স্লোগান দিয়েছে, লাঠিখেলা করেছে। প্রশাসনকে এমন ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করে আমাদের সভার লোকজনকে বাধা দিয়েছে যা বলার মতো নয়। তারপরও মূল পথ ছেড়ে চকের মধ্য দিয়ে শত শত হাজারে হাজারে লোক এসে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং এনডিএফের সভাকে দারুণভাবে সফল করেছে।

এ জন্য এলাকাবাসীকে কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানিয়েছি। একজন প্রবীণ নেতা এবং মন্ত্রী আমাদের সভা পণ্ড করতে পাল্টা সভা ডাকায় আওয়ামী লীগের ২-৪ জন নেতানেত্রীকে ফোন করেছিলাম। প্রতিকার করতে পেরেছেন কিনা জানি না, তবে তারা কাজটিকে মোটেই সমর্থন করেননি। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক শিষ্টাচার দেখেছি যেটা বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর মধ্যে বিন্দুমাত্র দেখিনি। বড় ভাই প্রবীণ মানুষ, তার কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, নেতা-কর্মী রাজনৈতিক আচরণ পাবে_ এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু কেন জানি এমপি হওয়ার আগের লতিফ সিদ্দিকী আর পরের লতিফ সিদ্দিকী এক ছিলেন না। মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী আর রাজনৈতিক নেতা লতিফ সিদ্দিকী কেন যেন মোটেই এক নন। মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী আইয়ুব-মোনায়েমের চেলাদের চেয়েও খারাপ, অগণতান্ত্রিক। তাই তার এবং সরকারের কর্মকাণ্ড এক কিনা জানার জন্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম, প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, মোহাম্মদ নাসিম, তোফায়েল আহমেদসহ আরও অনেককেই ফোন করেছিলাম। তারা কেউ মাননীয় মন্ত্রীর কাজের সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারেননি বা করেননি।

জনাব নাসিম এবং তোফায়েল আহমেদকে ধরতে পারিনি। রেহানার ছেলে ভাগিনা ববিকে ফোন করেছিলাম। রিং হতেই জবাব এসেছিল, 'মামা কেমন আছো?' ভালোই আছি। তোর মাকে দরকার। শাড়ি পেঁৗছাতে হবে আর কিছু কথা ছিল।

ববি বলেছিল, 'আমি বাইরে। মা বোধহয় টুঙ্গিপাড়া গেছে। মা'র সঙ্গে যোগাযোগ করে তোমাকে জানাচ্ছি। ' কয়েক ঘণ্টা পর আবার ফোন করেছিলাম, সাড়া পাইনি। পরে রাতের দিকে ববির ফোন, 'মামা, কিছু মনে কর না।

ঘুমিয়ে ছিলাম। তাই তোমার ফোন ধরতে পারিনি। একটু আগে মাকে বলেছি। মার শরীরটা খারাপ। তবে সকালেই তোমাকে ফোন করবে।

' রেহানার ছেলে ববি কোলে উঠেছে, কাঁধে বসেছে, ভদ্রতার আকালের সময় তার এটুকু সৌজন্যই যথেষ্ট। বয়স হয়েছে একটু সম্মান ছাড়া এখন আর কার কাছে কি চাই? কিছুই না।

লেখাটা তৈরি করে শুয়ে পড়েছিলাম। সকালে চোখ বুলিয়ে পাঠিয়ে দেব, যা সাধারণত সব লেখার ক্ষেত্রেই করি। কিন্তু তা হলো না।

হঠাৎই এক সহযোদ্ধার মৃত্যু সংবাদ সব এলোমেলো করে দিল। এই তো ৩-৪ দিন আগে উপমহাদেশের সাড়াজাগানো নায়িকা ৮২ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। রমা দত্ত ওরফে সুচিত্রা সেন আমাদের পাবনার মেয়ে। তিনি তার অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষকে আলোড়িত করেছিলেন, বিখ্যাত হয়েছিলেন। শাপমোচন, হারানো সুর, সবার উপরে, হাসপাতাল এসবে তার অভিনয় দেখে বিমোহিত হয়েছি।

সুচিত্রা সেনের মতো সুন্দরী নায়িকা সাদা-কালো ছায়াছবিতে দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। কিন্তু এ মৃত্যু সংবাদ আমার কাছে সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর চেয়েও হৃদয়বিদারক, বেদনাদায়ক। সখিপুরের মোক্তার আলী চেয়ারম্যানের ছেলে শওকত মোমেন শাজাহান ২০ জানুয়ারি সকালে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছে (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। শাজাহান মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছিল রাজনৈতিক মানুষ। ভালো হোক খারাপ হোক সব সময় রাজনীতির সঙ্গেই লেগে থাকত।

কোনো স্থিরতা না থাকলে যখন যার সঙ্গে থাকত তার সঙ্গে ষোলআনাই থাকত। '৬৯-এর দিকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় লতিফ সিদ্দিকীর কর্মী ছিল। '৭১-এ ছিল আমার যোদ্ধা। আমি আওয়ামী লীগ ছাড়লে '৯৯ থেকে সে-ই বড় আওয়ামী লীগার হয়ে যায়। একজনকে ছেড়ে আরেকজনের কাছে গেলে সে কখনো পিছু ফিরে দেখেনি।

বড় বেশি বর্তমাননির্ভর ছিল। সেভাবেই এপার থেকে ওপার গেল। আমি তার আত্দার শান্তি কামনা করি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে শওকত মোমেন শাজাহানকে পেয়েছিলাম। সব সময় একটু বেশি কিছু করতে চাইত, তাই যুদ্ধের সময় ক্ষমতা দেখানোর কারণে শাস্তি পেয়েছিল।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছাড়েনি। স্বাধীনতার পর আমার একনিষ্ঠ ভক্ত অনুরক্ত ছিল। আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করলে সে গ্রেফতার হয়ে কারা নির্যাতন ভোগ করে।

তারপর যায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কয়েকজন নিহত হলে পালিয়ে যায় ভারতের বর্ধমানে আমার বাড়িতে।

এক-দুই বছর থেকে প্রেম করে শিপ্রাকে নিয়ে দেশে ফেরে। '৮৬-র নির্বাচনে আমার মনোনয়ন মিথ্যে মামলায় বাতিল করলে শওকত মোমেন শাজাহানকে প্রার্থী হতে বলি। সে আমার স্ত্রী নাসরীন সিদ্দিকীকে প্রার্থী করতে অনেক চেষ্টা করেও না পেরে বাধ্য হয়ে প্রার্থী হয়। ২৭-২৮ হাজার ভোট পেয়ে সেবার নির্বাচিত হয়। তার সংসদের মেয়াদ দেড় বছরের বেশি ছিল না।

বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী তখন জননেতা আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ মানে বাকশাল করায় তার সম্পর্কে এত ন্যক্কারজনক কথাবার্তা বলেছে যেটা শুনে অনেকেই বিরক্ত হতো। এরপর '৯০-এ দেশে ফিরে '৯১-এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পাকিস্তানের সেবাদাস হুমায়ুন খান পন্নীর কাছে হাজার ভোটে হেরে যাই। এ নিয়েও অনেকের অভিযোগ ছিল শওকত মোমেন শাজাহানের অসংলগ্ন কথাবার্তাই নাকি পরাজয়ের মূল কারণ ছিল। হতেও পারে। কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি।

এর পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। '৯৯ সালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে ১৫ নভেম্বর উপনির্বাচন করি। আওয়ামী লীগ শাজাহানকে প্রার্থী করে। বিএনপির আমলে যেমন মাগুরায় ভোট চুরির মহাউৎসব হয়েছিল, ঠিক তেমনি সখিপুর-বাসাইলে ভোট ডাকাতিতে বিশ্ব রেকর্ড করে। এর পর গঙ্গা-যমুনার পানি অনেক গড়িয়েছে।

এলাকায় বহু কথা উঠেছে। কিন্তু তবু যোগাযোগ রাখতে কখনো পিছপা হয়নি। কত আর হবে ৫-৬ মাস আগের কথা। ছেলে জয়কে নিয়ে বাসায় এসে হাজির। স্যার, মুজিব কলেজ সরকারি হয়েছে এই যে তার চিঠি।

যে মুজিব কলেজ স্বাধীনতার পরপরই প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, যাতে সব থেকে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন পাহাড়ের বন্ধু হামিদুল হক বীরপ্রতীক। সেই কলেজে মন্ত্রী হিসেবে লতিফ সিদ্দিকী এবং এমপি হিসেবে শওকত মোমেন শাজাহানের সংবর্ধনা সভায় প্রতিষ্ঠাতা হওয়া সত্ত্বেও যেতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম, মায়ের পেটের ভাই মন্ত্রী হিসেবে আমার কলেজে যাচ্ছে তাকে সাধুবাদ জানাই। আমার শুভ কামনা, শুভেচ্ছা এবং প্রশংসা হয়তো তাদের কাম্য ছিল না, তাই লতিফ ভাই তার মন্ত্রীর ক্ষমতা খাটিয়ে পুলিশ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করেছিলেন। যেমনটা ভোটারবিহীন কলঙ্কজনক নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে ১৬ তারিখ আউলিয়াবাদের জনসভায় পুলিশ এবং তার দলের গুণ্ডাপাণ্ডা দিয়ে সভা পণ্ড করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

কলেজ সরকারিকরণের কাগজ হাতে নিয়ে বলেছিলাম, কই, এ তো প্রধানমন্ত্রীকে তুমি সরকারিকরণের যে আবেদন জানিয়েছ সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর চিঠি। মনে হয় তার ১ বা ২ দিন পর ২৮ তারিখ ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায় আমার জনসভা ছিল। সেই দিনই শাজাহানের বাবা মোক্তার আলী চেয়ারম্যানের মৃত্যুবার্ষিকীর দাওয়াতে কি করে যেন রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। দলীয় লোকজনকে শাজাহানের বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে যাচ্ছি বলতেই ফুঁসে উঠেছিল, না যাওয়া হবে না। শাজাহানের বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে যাওয়া হয়নি।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাজাহানের মৃত্যু সংবাদে বুকটা কেন যেন ভারি হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে শওকত মোমেন শাজাহানের ভূমিকার কথা ভোলার মতো নয়। সে বন্দুক হাতে যুদ্ধ না করলেও সংগঠন গড়ে তোলায় যে কজন ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে তার মধ্যে শওকত মোমেন শাজাহান অন্যতম। হামিদুল হক বীরপ্রতীক, স.ম. আলী আজগর, আবদুল আউয়াল সিদ্দিকী, খোরশেদ আলম, আমজাদ মাস্টার এরা যেমন বেসামরিক প্রশাসন এবং সংগঠন গড়ে তুলেছিল, ইদ্রিস কমান্ডার, লোকমান হোসেন, আবদুর গফুর বীরপ্রতীক, আবদুস সবুর খান বীরবিক্রম, ফজলুল হক বীরপ্রতীক, ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান_ এরা সশস্ত্র যুদ্ধ এবং কাদেরিয়া বাহিনীকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তুলতে ভূমিকা ও অবদান রেখেছিল।

আবদুস সবুর চেয়ারম্যানের ছেলে লুৎফর আর মোক্তার আলী চেয়ারম্যানের ছেলে শাজাহান এক সময় ছিল হরিহর আত্দা।

এরা দুজন আমার খুবই প্রিয় ছিল। একজন শেষদিন পর্যন্ত আমাকে বুকে লালন করে কয়েক বছর আগে এ দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। আরেকজন ২০ জানুয়ারি ২০১৪ দুনিয়ার সব ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। দয়াময় পরম প্রভু আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই, তিনি আমায় মুক্তিযোদ্ধা শওকত মোমেন শাজাহানের জানাজায় শরিক হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আমি তার আত্দার মাগফিরাত এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

লেখক : রাজনীতিক।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.