দেখা যত ছবি, শোনা যত শব্দ, হৃদয়ের সব উপলব্ধি, আর যত এলোমেলো ভাবনা
১ জানুয়ারিকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে পালন করা হয়। ঢাক-ঢোল, বাজি-পটকা ফুটিয়ে বিশ্বব্যাপী ১ জানুয়ারিতে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করা হয়। কোটি কোটি মানুষের আনন্দ, বিনোদন আর উৎসবের উপলক্ষ হিসেবে প্রতি বছর আগমন করে থাকে ইংরেজি নববর্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া সহ বিশ্বের উন্নত দেশ সমূহে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয় এই নববর্ষ উৎসবকে কেন্দ্র করে। আতশ বাজির বর্ণীল রঙে রঙ্গিন হয়ে উঠে সে দিনের রাতের আকাশ।
বিশ্বব্যাপী ১২টা ০১ মিনিটে জেগে উঠে রাতের আকাশ। এখান থেকে কয়েক দশক আগেও নববর্ষকে এভাবে সাড়ম্বরে উদযাপন করা হতো না। উদযাপনের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। নববর্ষকে উৎসব হিসেবে পালন শুরু করার পেছনে রয়েছে আরেক ইতিহাস।
সর্বপ্রথম নববর্ষ উদযাপন শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মেরও ২০০০ বছর আগে।
সে সময় ২০ মার্চ তারিখের দিকে নববর্ষ উদযাপন করা হতো। এরপর কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন দিন পঞ্জিকাকে অনুসরণ করে এসেছে আজকের খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা।
আদি রোমান দিন-পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি বছর ১ মার্চ নববর্ষ উদযাপন করা হতো। ওই সময় বছর গণনা করা হতো ১০ মাসে। মার্চ মাস থেকে শুরু হতো নতুন বছর।
সুতরাং সে সময় নববর্ষ ছিল মার্চ মাসে। খ্রিষ্টের জন্মের ১৫৩ বছর আগে রোমে প্রথমবারের মতো ১ জানুয়ারিতে নববর্ষ উদযাপন শুরু করা হয়। রোমের দ্বিতীয় রাজা নুমা পন্টিলাস দিন-পঞ্জিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন নতুন দুটি মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি। যদিও তখনো অনেকে ১ মার্চ তারিখে নববর্ষ উদযাপন করতো। খ্রিষ্টের জন্মের ৪৬ বছর আগে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার প্রাচীন রোমান দিন-পঞ্জিকায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে নতুন দিন-পঞ্জিকা চালু করেন।
এই দিন-পঞ্জিকায় ১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে ১ জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। এই দিন-পঞ্জিকাকে বলা হতো জুলিয়ান দিন পঞ্জিকা। ৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এসে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ হিসেবে ১ জানুয়ারিকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়।
এ সময় ইউরোপের কোথাও ২৫ ডিসেম্বর, কোথাও ১ মার্চ আবার কোথাও ২৫ মার্চ নববর্ষ উদযাপন করা হতো।
১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান দিন-পঞ্জিকার সূচনা হয়। নতুন এই দিন পঞ্জিকা অনুযায়ী ০১ জানুয়ারিকে আবার নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন শুরু করা হয়। গ্রেগরিয়ান দিন-পঞ্জিকার যাত্রা শুরু হলেও প্রথম দিকে স্বাড়ম্বরে নববর্ষ উদযাপন করা হতো না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এসে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালন করা শুরু হয়।
এরপর ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসেবে আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে। ১৭৫২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ০১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন করা শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে ০১ জানুয়ারি ঘটা করে, স্বাড়ম্বরে, উৎসব মূখরভাবে বিশ্বের সকল দেশে নববর্ষ পালন শুরু করা হয়। ইউরোপের অনেক দেশে এই দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতি কিন্তু এক নয়।
কিছু কিছু মিল থাকলেও নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যোগ হয় দেশীয় ঐতিহ্য। নববর্ষের কিছু প্রথা আছে অবাক করা এবং মজার। যেমন থাইল্যান্ডে একজন আরেকজনের গায়ে পানি ছিটিয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। স্পেনে রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২টা আঙ্গুর খেয়ে নববর্ষের প্রথম ক্ষণটি উদযাপন করা হয়। সবই ঐতিহ্যের সুতোয় গাঁথা বিভিন্ন রেওয়াজের সমন¦য়।
বর্তমানকালে মিসরে নববর্ষে চাঁদ দেখে নববর্ষ ঘোষণা করেন দেশের ধর্মনেতা বা প্রধান মুফতি। বিশেষ ধরনের খাবারসহ ভোজ উৎসব এবং নতুন কাপড় পরার নিয়ম সেখানে। তারপর ঈদের মতো পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময়। ইরানে প্রাচীনকাল থেকেই নববর্ষে নওরোজ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এদিন কৃষকরা ক্ষেতে বপন করে বিভিন্ন শস্যের বীজ, ঘরদোর সাজায়, নতুন পোশাক পরে।
চীন দেশে পূর্ণিমার শুরুর দিন থেকে শুক্লপক্ষের ১৫ দিন উৎসব চলে নববর্ষ উপলক্ষে। পৃথিবীতে একমাত্র চীনারাই নববর্ষ পালন করে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী। নববর্ষের প্রথম দিনে তারা স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাকে তুষ্ট করে নানা উপাসনা-উপাচারে, দ্বিতীয় দিন পূর্ব পুরুষের মঙ্গল কামনা করা হয়। ‘ওয়েইলু’ নামক বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয় এদিন। পক্ষকালব্যাপী আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের মধ্যে সপ্তম দিনটি পালিত হয় ‘শস্য দিবস’ নামে।
’হাফত-সিন’ নামের বিশেষ খাবার এদিনের সর্বজনীন খাবার, যা সাত রকমের উপকরণে তৈরি করা হয়। আমেরিকান ও জার্মানরা নববর্ষ উপলক্ষে শিশু শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এর প্রচলন হয়েছিল ‘চৌদ্দ শতকে’, স্কটল্যান্ডে নববর্ষ উৎসব পরিচিত ‘হগমানে’ নামে। বছরের শুভাগমন স্মরণে কোনো কোনো গ্রামে মানুষ রাস্তায় ঢেলে দেয় ব্যারেল ব্যারেল টার। এদিন ‘ফাস্ট ফুটিং’ নামে উপহারসামগ্রী দেওয়ার একটি প্রথা চালু রয়েছে সেখানে।
সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ায় সেন্ট সিলভেস্টারের পোশাকে সজ্জিত হয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়, বর্তমানে আমেরিকা-ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ইংরেজি নববর্ষের আয়োজন খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপন করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক ইভ পার্টি বা থার্টি ফার্স্ট নাইট এখন সারা বিশ্বে পরিচিত। নতুন বছরে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ সম্ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক সম্ভাষণে পরিণত বলা যায়। আমেরিকায় নববর্ষে স্বজনদের বাড়ি বেড়ানোর ধুম পড়ে। পরদিন আমেরিকানরা জাতীয় খেলা ফুটবল দেখে এবং বাদ্য সহকারে বের করে শোভাযাত্রা।
ঘোড়ার গাড়ির পেছনে এগিয়ে চলা এ শোভাযাত্রার নাম ‘রোজেস প্যারেড’।
অনেকে ভারতীয় বর্ষবরণ উৎসবকে দিওয়ালি উৎসব বলে অভিহিত করেন। দিওয়ালি অর্থ দীপাবলী বা আলোর উৎসব। এটি হয় বিভিন্ন রাজ্য বা সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী। দিওয়ালি ধর্মীয় উৎসবও বটে।
লক্ষ্মীপূজাসহ চলে দেবদেবীর স্মৃতিতর্পণ করার উদ্দেশ্যে ভজন সংগীত, শ্রী কৃষ্ণকীর্তন ইত্যাদি। পাঞ্জাবে নববর্ষ উৎসব পরিচিত বৈশাখী নামে। নববর্ষে পুসজ্জা প্রায় সর্বভারতীয় রেওয়াজ, দক্ষিণ ভারতের অঞ্চলবিশেষের মজাদার খাবার ও পুষ্প উপহার গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। তবে বর্তমানে ইংরেজি নববর্ষ পালন সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান উৎসব হয়ে উঠেছে। আর্জেন্টিনায় নববর্ষের আগের দিন রাতে পরিবারের সব সদস্য একত্রে খাবার টেবিলে বসে আহার করে।
তার পর বড়রা নাচের অনুষ্ঠানে চলে যায়। ভোর পর্যন্ত চলে এ নাচের অনুষ্ঠান। নববর্ষের প্রথম দিন নদী বা পুকুরে সাঁতার কেটে তারা নববর্ষ উদযাপন করে। ভিয়েতনামে নববর্ষকে সংক্ষেপে ‘টেট’ শব্দে অভিহিত করা হয়। ভিয়েতনামীদের বিশ্বাস, ঈশ্বর ঘরে ঘরে বাস করেন।
নববর্ষে বেড়াতে যান স্বর্গে। সেখানে বসে মর্ত্যরে লোক কি করছে, তা খতিয়ে দেখেন। বলা হয়, কার্প মাছের পিঠে চড়ে ঈশ্বর ভ্রমণেও বের হন। এ বিশ্বাসে অনেকে নদী বা পুকুরে কার্প মাছ ছাড়েন। জাপানে নববর্ষ উদযাপন করা হয় ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে।
শুভদিন হিসেবে অন্তত সূর্যাস্ত পর্যন্ত নববর্ষে হাস্যমুখর থাকে জাপানিরা। লোকাচার অনুযায়ী মন্দভাগ্য এড়াতে অনেকে বাড়ির সামনে টানিয়ে রাখে বিশেষভাবে তৈরি রশি। পারসিক অগ্নি উপাসকদের নববর্ষ ৩১ মার্চ। নতুন পোশাক, উত্তম আহার এবং বেড়ানো তাদের উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ। ব্রাজিলের রিওডি জেনিরো সমুদ্র সৈকতে নববর্ষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটি হয়।
এর অন্যতম আকর্ষণ চোখ ধাঁধানো আতশবাজির প্রদর্শনী। এ দিন অনেক লোকই সাদা পোশাক পরিধান করে। সমুদ্রে সাতটি ডুব দিলে এবং সাতটি ফুল ছুঁড়ে দিয়ে তারা মনে করে বছরটি খুব ভালো কাটবে। এ উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় দুই মিলিয়ন পর্যটক যোগ দেয়। মেক্সিকোতেও ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২ বার ঘণ্টা বাজানো হয়।
এ সময় প্রতি ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে একটি করে আঙ্গুর খাওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে, এ সময় যা কামনা করা হয়, তাই পূরণ হয়। কোরিয়ায় নববর্ষ শুরুর সময় কেউ ঘুমায় না। এ সময় ঘুমালে নাকি চোখের ভ্রূ সাদা হয়ে যায়! রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে ৩৩ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। কোরিয়ার ৩৩ বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটি করা হয়।
কোরিয়ায় প্রায় সবাই সূর্যোদয় দেখে। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার সময় একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানায়।
এছাড়া নববর্ষ ঘিরে প্রচলিত আছে অনেক মিথ। যেমন-
১. গ্রিসে বাচ্চারা নববর্ষের রাতে আগুন জ্বালিয়ে আগুনের কুণ্ডের কাছে তাদের জুতা জোড়া ফেলে আসে। তাদের বিশ্বাস, মহানুভব দেবতা বাসিল তাদের জুতাগুলো উপহারে পূর্ণ করে দেবেন।
২. নিউ ইয়ার ইভ বল’ নিচে নামিয়ে টাইম স্কয়ারে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। এ প্রথা শুরু হয়েছে ১৯০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে। ৫ ফুট ব্যাসের বলটির ওজন প্রায় ৭০০ পাউন্ড।
৩. খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ সালে প্রাচীন গ্রিসে নববর্ষ উদ্যাপন করা হতো একটি নবজাতক শিশুকে দিয়ে।
৪. জার্মানিতে নববর্ষের প্রথা হলো, গলিত পারদ ঠান্ডা পানিতে ফেলে তা যে আকারের হবে, সেটা দেখে অন্যের ভাগ্য বলার চেষ্টা করা।
৫. থাইল্যান্ডে নববর্ষ উদ্যাপিত হয় ১৩-১৫ এপ্রিল (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী), থাইরা বিশ্বাস করে, এই আচার পালনে পরবর্তী বছরে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হবে, যার ফলে ভালো ফসল ফলবে।
৬. স্প্যানিশরা ১২টি আঙুর আর জাপানিরা তোশিকোসোবা নুডলস খেয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করে।
বিশ্বের সকল দেশে গ্রেগরিয়ান নববর্ষ উদযাপিত হলেও সকল দেশে এটি প্রধান নববর্ষ উৎসব নয়। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহে আরবি নববর্ষকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষকে উৎসবের সাথে পালন কর হয় আবার চীনে চীনা পঞ্জিকা অনুসারে নববর্ষ পালন করা হয়। এছাড়াও বিশ্বের অনেক উপজাতিরা তাদের নিজস্ব দিবসে নববর্ষ উৎযাপন করে।
পরিশেষে বলা যায় কিছু দেশে আলাদা নববর্ষের দিন থাকলেও সাধারণভাবে এখন বর্তমান বিশ্বের সকল দেশের নববর্ষের দিন ০১ জানুয়ারি।
/* সকল তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত, তথ্যে ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দরভাবে দেখার আহবান থাকলো */ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।