১৯৮৩ সাল। আমার বয়স তখন নয়। বাবা তখন বাবুগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ।
নতুন কলেজ। কলেজের নানান কাজ জমা হয়েই থাকতো।
তাই সে বছর রোজার ঈদের ছুটি কাটিয়ে আমার বাবা অধ্যাপক আলতাফুর রহমান চলে যান কর্মস্থল বাবুগঞ্জে।
মাসহ আমরা থাকতাম ভোলার বাসায়।
আব্বা কলেজের কোয়ার্টারে একা থাকতেন।
কলেজের কেয়ারটেকার আব্বার দেখাশোনা করতেন। আর এক বুয়া এসে আব্বার রান্না করে দিয়ে চলে যেতেন।
আব্বা ভোলা থেকেই কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় বাবুগঞ্জ যান। আব্বার ছিল গ্যাস্টৃক আলসার এবং সেই সময় পেটের পেইন নিয়েই বাবুগঞ্জ যান।
তিনি ছিলেন ইংরেজির প্রফেসর। ছাত্র পড়িয়ে কখনো টাকা নিতেন না। বিনা টাকায় প্রাইভেট পড়াতেন।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও বুয়া এসে সকালে আব্বাকে চাল-ডালের নরম খিচুড়ি রান্না করে দিয়ে চলে যান।
আব্বার শরীর তখন খুব খারাপ ছিল। বুয়াকে আব্বা কিছুই জানাননি।
বিকেলে পিয়ন এসে আব্বার সঙ্গে কথা বলে চলে যান নিজের বাড়ি। পিয়নের বাড়ি কলেজের কাছেই ছিল।
পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় পিয়ন এসে দেখেন আব্বার রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পিয়ন অনেক ডাকার পরও সাড়া না পেয়ে কাছের হস্টেলের ছাত্রদের ডেকে আনেন।
ছাত্ররা ও কয়েক শিক্ষক আসেন। তারা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখেন, আব্বা জমাট বাধা রক্তের ভেতর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছেন।
ছাত্ররা তাদের প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে যান বরিশাল মেডিকাল কলেজ হসপিটালে।
সেখানে আব্বা দেড় মাস অসুস্থ অবস্থাতে ছিলেন।
প্রথম দিকে ডাক্তাররা ধরতেই পারেননি সমস্যাটা কোথায়। বেশ কয়েকবার মেডিকাল বোর্ড বসে। সিদ্ধান্ত হয় আব্বার অপারেশন দরকার।
দিন দিন আব্বার অবস্থা অবনতি হতে থাকে।
আব্বার প্রচুর রক্ত লাগে।
খবর পেয়ে বাবুগঞ্জ থেকে দলে দলে ছাত্ররা আসতে থাকেন প্রিয় শিক্ষককে রক্ত দিতে।
আব্বার পেটের ভেতরে রক্তের ধমনি ছিড়ে গিয়েছিল। তাই রক্ত দিলেও তা থাকতো না।
আব্বার অপারেশন হলো।
ধীরে ধীরে আমার বাবা সুস্থ হতে লাগলেন। এক চল্লিশ ব্যাগ রক্তের বিনিময়ে আমার বাবা সুস্থ হলেন।
পুরো রক্তই দিয়েছেন তার প্রিয় ছাত্ররা। ছাত্রদের এ ভালোবাসাই একজন দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষককে আজও বাচিয়ে রেখেছে।
মা-বাবা ও সন্তান
আমার বাবা যতোদিন বরিশাল মেডিকাল কলেজ হসপিটালে অসুস্থ ছিলেন, আমার মাও সেবার জন্য তার পাশেই থাকতেন।
আমার বাবা যখন ঘুমাতেন তখন আমার মা আশপাশের রুমগুলোতে ঘুরে রোগী দেখতেন।
আমার বাবার পাশের রুমেই একটি বেডে সতেরো-আঠারো বছরের কিশোরী মেয়েও খুব অসুস্থ ছিল।
আম্মা কয়েকদিনই লক্ষ্য করেছেন, মেয়েটি তার মা-বাবা আসলেই চিৎকার দিতো, চেচামেচি করতো। মা-বাবার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতো না। বরং খুব খারাপ ব্যবহার করতো।
আম্মা মেয়েটির ওই অদ্ভূত আচরণে খুব অবাক হন এবং কৌতূহলী হয়ে মেয়েটির প্রতি লক্ষ্য রাখতেন।
একদিন আম্মা এক সিনিয়র নার্সকে ব্যাপারটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, মেয়েটি কেন তার মা-বাবার সঙ্গে ওই অদ্ভূত আচরণ করে। অন্য কারো সঙ্গে তো এই ব্যবহার করে না।
নার্স তখন জানান, মেয়েটির ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। মেয়েটির আয়ু আর মাত্র কয়েক মাস বাকি আছে।
মেয়েটি যে কোনো ভাবে তার অসুস্থতার কারণ জানতে পেরেছে। তাই তার মা-বাবার সঙ্গে এই ব্যবহার করে।
এক ডাক্তার কৌশলে মেয়েটির কাছ থেকে এই কথা জানতে পারে।
মেয়েটি তার মনের এ গোপন কথাটি সেই ডাক্তারকে জানায়। মেয়েটি মা-বাবার একমাত্র সন্তান।
মা-বাবা ওকে খুব ভালোবাসেন। তাই মেয়েটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ওর মৃত্যুর পর মা-বাবা যেন কষ্ট না পান। ওর খারাপ ব্যবহারের কথাই যেন মা-বাবা বার বার মনে করেন।
মেয়েটির এ সিদ্ধান্তই বুঝিয়ে দেয় মা-বাবাকে ও কতো ভালোবাসতো।
সন্তান ও বাবা
১৯৯৫ সালে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আতিয়ার হোসেন ভোলায় বদলি হয়ে আসেন।
প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল।
আতিয়ারের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সংসার।
আতিয়ারের মেয়ে সুরভি দেখতে বেশ সুন্দর ছিল। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ভালো ও যোগ্য পাত্র পেয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। পত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার।
ভোলায় বাড়ি আছে।
সুরভি খুশি। মা-বাবা, ভাই, আত্মীয়-স্বজন সবাই খুশি উপযুক্ত পাত্রে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পেরে।
বাবার বিত্তের ভেতর বড় হয়েছে সুরভি।
সুখে-শান্তিতেই ওদের দিন কাটছিল।
বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই সুরভির অসুস্থতার শুরু। প্রায়ই জ্বর হয়।
শুরু হলো ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে ধরা পড়ে সুরভির লিউকোমিয়া অর্থাৎ ব্লাড ক্যান্সার।
মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজনদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে খবরটা শুনে।
শুরু হয় সুরভির চিকিৎসা পর্ব। দেশে অনেক চিকিৎসা করানোর পরও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা পরামর্শ দেন বিদেশে নিয়ে যেতে।
সুরভির বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। অনেক টাকার দরকার।
ম্যাজিস্ট্রেটের জমানো সব টাকা শেষ। তাদের দিন কাটে না, রাত কাটে না মেয়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের চিন্তা।
অনেক ভাবনার পর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে সিংগাপুর পাঠাবেন।
মেয়েকে সিংগাপুর পাঠালেন ঠিকই। বিনিময়ে মায়ের গয়না, মা-বাবা-মা জমি, ঘরের মূল্যবান সব ফার্নিচার, মূল্যবান যা ছিল সবই বেচে দেয়া হলো।
মেয়েকে নিয়ে মা সিংগাপুর গেলেন।
সুরভির চিকিৎসা শুরু হলো। চিকিৎসা চললো দীর্ঘ সময়। এ সময়ের মধ্যে আরো কয়েকবার টাকা জোগাড় করে পাঠানো হলো চিকিৎসার জন্য।
সুরভি ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলো।
সবশেষ টাকা পাঠাতে হবে মেয়ের হসপিটালের বিল মেটাতে ও দেশে ফিরে আসার টিকেটের টাকার জন্য। এডিএম সাহের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিলেন এবং তার শেষ সম্বল তার মাথা গোজার ঠাই গ্রামে নিজের বাড়ি বেচে দিয়ে টাকা পাঠালেন।
অধীর অপেক্ষায় রইলেন মেয়ে ফিরে আসার দিনটির জন্য।
একেক করে মেয়ে আসার সময় ঘনিয়ে আসছিল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন।
আল্লাহর দরবারে মেয়ের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। এমনি করে দিন যেতে লাগলো।
অবশেষে মেয়ের দেশে আসার দিন ঠিক হলো।
মেয়ে ঢাকায় আসার আগের দিন ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের কাজে বরিশাল গেলেন। কাজ সেরে ঢাকায় যাবেন, এটাই তার ইচ্ছা ছিল।
বরিশাল যাওয়ার সময় তার সঙ্গে ছিলেন তার মেয়ের বিয়ের ঘটক ফরহাদ।
ফরহাদ ভোলার ছেলে।
বরিশাল পৌছে ম্যাজিস্ট্রেট মাগরিবের নামাজ আদায় করলেন।
ফরহাদ ইতিমধ্যে তাকে চা খাওয়ার কথা বললেন।
তিনি জানালেন, নামাজ শেষ করেই চা খাবেন।
দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া-দরুদ পড়ে মোনাজাত শুরু করে মেয়ের জন্য দোয়া চাইতে লাগলেন খোদার দরবারে।
ফরহাদ আবারও তার দরজার কাছে এসে আস্তে করে দাড়িয়ে রইলেন। মোনাজাত শেষ হলে এডিএম-কে বললেন, চা ঠান্ডা হচ্ছে।
দরজার কাছে গিয়েই থমকে দাড়ালেন ফরহাদ। এডিএম আল্লাহর কাছে মোনাজান করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ, তুমি আমার মেয়েকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আমি আর কিছুই চাই না তোমার কাছে। তুমি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার মেয়ের জীবন তুমি ফিরিয়ে দাও। খোদা, তুমি আমার মেয়ের প্রতি দয়া করো। এক বাবা তার সন্তানের জন্য তোমার দরবারে হাত তুলেছে, তুমি আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না।
ফরহাদের চোখে পানি এল এই প্রার্থনা শুনে।
ম্যাজিস্ট্রেট জোরে জোরে খোদার দরবারে এই প্রার্থনা করতে থাকেন। অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করার পর মোনাজাত শেষ করেন তিনি।
নামাজ থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেলেন।
বললেন কিছু খাবেন না।
তার শরীরটা ভালো লাগছে না।
শরীর খারাপের কথা শুনে ডাক্তারকে খবর দেন ফরহাদ।
ডাক্তার আসতে আসতে ম্যাজিস্ট্রেটের অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যায়।
ডাক্তার এসে জানান, ম্যাজিস্ট্রেট আর বেচে নেই।
১৯৯৮ সালের ২৭ জুন ম্যাজিস্ট্রেট মারা যান।
যে রাতে ম্যাজিস্ট্রেট মারা যান সে রাতেই সুরভি ও তার মা প্লেনে চড়েন। পরের দিন এয়ারপোর্টে এসে এডিএমের স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনতে পান।
ম্যাজিস্ট্রেট ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি, এমনকি নিজের জীবন দিয়ে মেয়ের জীবন ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন।
ম্যাজিস্ট্রেটের অসীম ভালোবাসার কাছে আল্লাহ দিলেন অলৌকিক সমাধান। নিজের ¯েÅ“হ-ভালোবাসা দিয়ে খোদার কাছ থেকে চেয়ে আনলেন মেয়ের জীবন।
এ যেন ছোটবেলায় গল্পে শোনা সম্রাট বাবর তার ছেলে হুমায়ুনের সুস্থতার জন্য খোদার দরবারে এভাবেই নিজের জীবনের বিনিময়ে ছেলের জীবন ভিক্ষা চান এবং খোদা তার দোয়া কবুল করেন। বাবর মারা যান, হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এ যুগে এমন ঘটনা বিরল।
সুরভি এখন সুস্থ। ওর সন্তানও বড় হয়ে গেছে।
তারা এখন আর ভোলায় থাকে না। ওরা কোথায় আছে তাও জানি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।