একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের রায় গত ৩ নভেম্বর ঘোষণা করে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক এবং ডাক্তারদের হত্যাকান্ডের জন্য চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।
তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, মুঈন ছিলেন আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর। মুঈন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ও আশরাফ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।
আদালত তার রায়ে বলেছে, এই দুই জনের বিরুদ্ধে আনা এগারোটি অভিযোগের সবগুলোই সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে।
আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছে, ১৯৭১ সালে সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক এবং ডাক্তারদের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে তারা যে অপরাধ করেছে সেজন্য তাদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য।
এই দুই জনের বিরুদ্ধে যে এগারোটি অভিযোগ আনা হয়েছিল: মুঈন ও আশরাফের বিরুদ্ধে প্রথম থেকে পঞ্চম অভিযোগে রয়েছে, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে দৈনিক ইত্তেফাক-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, ১১ ডিসেম্বর ভোরে পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, ১২ ডিসেম্বর দুপুরে বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ এবং ১৩ ডিসেম্বর শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে অপহরণ করা হয়। মুঈন ও আশরাফের নির্দেশে এবং তাঁদের অংশগ্রহণে আলবদরের সদস্যরা ওই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যা করে। তাঁদের মধ্যে সেলিনা পারভীন ছাড়া আর কারও লাশ পাওয়া যায়নি।
ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সকাল আটটা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়জন আলবদর সদস্য অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, আবুল খায়ের, ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য ও চিকিত্সক মো. মর্তুজাকে তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে অপহরণ করে।
১৬ ডিসেম্বরের পর মিরপুর বধ্যভূমিতে তাঁদের ছয়জনের লাশ পাওয়া যায়। সিরাজুল হক খান ও ফয়জুল মহিউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়নি।
সপ্তম থেকে একাদশ অভিযোগে রয়েছে, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও দৈনিক সংবাদ-এর যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণ করা হয়। তাঁদের কারও লাশ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক মো. ফজলে রাব্বী এবং চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে অপহরণ করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁদের লাশ পাওয়া যায়।
এ মামলার সাক্ষী যাঁরা ছিলেন: এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে যাঁরা সাক্ষ্য দেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে একমাত্র জীবিত ফিরে আসা ও নির্যাতন-হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী দেলোয়ার হোসেন, শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভাতিজা ইফতেখার হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরীর ছোট ছেলে আসিফ মুনীর, ফজলে রাব্বীর মেয়ে নুসরাত রাব্বী, আলীম চৌধুরীর মেয়ে ফারজানা চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিনের বোন ফরিদা বানু, ভাগনি মাসুদা বানু, সিরাজুল হক খানের ছেলে এনামুল হক, আবুল খায়েরের ছোট ছেলে রাশিদুল ইসলাম, মো. মর্তুজার স্ত্রীর বড় ভাই ওমর হায়াত, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর, সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মর্তুজা নাজমুল ও ভাই গোলাম রহমান, আ ন ম গোলাম মোস্তফার ছেলে অনির্বাণ মোস্তফা, সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ।
মমুঈনুদ্দীন ও আশরাফের বিরুদ্ধে ২৮ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। পলাতক দু’জনকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেয়া হয়। এরপরও তাঁরা হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই ২৪ জুন থেকে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
যেহেতু চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান আদালতে হাজির হননি কিংবা তাদের পক্ষে কোন আইনজীবীও নিয়োগ করেননি সেজন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। তাদের একজন সালমা হাই টুনী। তিনি বলেন, এই দুই আসামীর পক্ষে কোন সাফাই স্বাক্ষী পাওয়া যায়ন। তাছাড়া, আসামীদের তরফ থেকেও তার সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষনের মতো নানা অপরাধ হলেও যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে এসে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিকে আলাদা করে দেখা হয়।
ইতিহাসবিদরা বলেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের বাংলাদেশী সহযোগীদের মাধ্যমে আল-বদর বাহনী গঠন করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
এবার বাংলাদেশ সরকারের করণীয় কি?
সদিচ্ছা থাকলে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ফিরিয়ে আনতে ব্রিটিশ সরকারকে চাপ সৃষ্টি করতে পারতেন, এইত গত ১৫ ই নভেম্বর কলম্বোতে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে কমওয়েলথ প্রধান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস এর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল উনার, কিন্তু উনি কি তাকে জিগাসা করেছেন যে, যখন ব্রিটেন বিশ্ব মানবধিকার রক্ষা নিয়ে দারুন শোচ্চার তখন তাঁর দেশেই একজন গণহত্যাকারী চৌধুরী মুঈনুদ্দীন বসবাস করছে বিগত ৪০ বছর থেকে?
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিনের ব্রিটিশ ইন্টারফেইথ গ্রুপগুলোতে অনুপ্রবেশ বিষয়ে ব্রিটিশ সোসাইটিকে সতর্ক করে দিয়েছে অলফেইথ নেটওয়ার্ক, একই সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে চরমপন্থি দল আখ্যা দিয়ে এটির ব্যাপারেও সতর্কতা জারি করেছে নেটওয়ার্কটি। এখন বাঁকি শুধু বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা।
প্রয়োজনে এব্যাপারে কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশগুলোর সহাতার জন্যে বাংলাদেশের আপ্রাণ চেষ্টা চানিয়ে যাওয়া উচিত। পৃথিবীর উদাহরণ থেকে আমাদেরকে শিখতে হবে কি ভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করব: অক্টোবরে যখন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের জানতে পারল যে তার ফোনে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ এনএসএ আড়ি পেতেছে, তখন তিনি ব্রাসেলস এ ছুটে গিয়ে ইউরোপের সব নেতাদের কাছে নালিশ করে পৃথিবীর মহা শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন।
পরবর্তিতে সয়ং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আঙ্গেলা ম্যার্কেলের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এর অর্থ হলো আমাদেরকে কেউ করুনা করে দেশ ও জাতিগঠনে সহায়তা করবে না, সেটা আমাদেরকে নিজেদেরকেই করতে হবে, আর সেই পথে পৌছাতে হলে আমাদের অনেক শুভাকাঙ্খী ও ভালো বন্ধু দরকার। > আজেকের বাংলা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।