অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে
দ্যা ব্যাটেল থিয়েটার
আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। আমাদের কাকা-জেঠারা সবাই কাছাকাছি একটা মহল্লায় থাকত। আমাদের কাজিনদের সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। এই এক্সটেনডেড ফ্যামিলিতে আগের জেনারেশনের সাথে পরের জেনারেশনের সনাতনী সম্পর্কই বহাল ছিল। অর্থাৎ ‘বড়দের’ কাজে ‘ছোটদের’ নাক গলানো বা ‘বড়দের’ কথার মাঝখানে ‘ছোটদের’ সর্দারি সেখানে ভাল চোখে দেখা হত না।
তবে এই বড়-ছোট তফাতি রেওয়াজ এক জায়গায় এসে নাকচ হয়ে যেত। সেটা হল দাবার বোর্ড ! ৬৪ ঘরের কী মাহাত্ম্য ! দেখতাম ৩২ ঘুটির পেছনে বসলেই কাকায়-ভাতিজায় দিব্যি ব্যতিহার অলুক। আমি দাবা খেলার নিয়ম কানুন কারো কাছে শিখি নি। খেলাটা দেখে দেখেই নিয়ম বুঝে গিয়েছিলাম। অবশ্য অনেক পরে জেনেছিলাম এর অনেকগুলোই ছিল ভুল।
ক্লাস সিক্সে থাকতে বাবা আমাকে রাণী হামিদ এর ‘মজার খেলা দাবা’ বইটা কিনে দিয়েছিল। অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আমি বইখানি পড়ি এবং প্র্যাকটিস করি। দাবার সঙ্গে আমার আগের পরিচয় থাকলেও সেই বইখানি পড়তে পড়তে দাবা’র বিস্ময় ভরা জগতে আমি যেন হারিয়ে গেলাম। তারপর অনেক কাল আর দাবা নিয়ে তেমন মাতামাতি করি নি। বছর চারেক আগে বইখানি নিজেই আবার কিনলাম।
আবার তোড়জোড় বেঁধে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেই বাঁধনে জোর ছিল না। তাই বেশিদিন টিকল না। আবার দাবার বোর্ডে ধুলা জমল।
কিছুদিন আগে ‘দাবা’ নামের এক গল্প লিখার পর থেকে দাবা নিয়ে আমার পুরনো ফ্যাসিনেশন আবার নতুন রূপ পেল।
এতদিনে আমার হঠাত করেই মনে হল দাবা বিষয়ে ম্যাটেরিয়াল আমি ইন্টারনেটে খুঁজি না কেন। খোঁজাখুঁজি চলল। অনেক রিসোর্স পেলাম। অনেক কিছু নতুন করে জানলাম। সেগুলো আস্তে আস্তে শেয়ার করার ইচ্ছা আছে।
দাবা নিয়ে এত কিছু হচ্ছে আমি জানতাম না। এখন বুলেট চেজ খেলা হচ্ছে ১ মিনিটে। আবার আগের দিনে করেসপন্ডেন্স নামে এক ধরণের দাবা খেলার চল ছিল। সেখানে দুই দাবাড়ু দু’টি রিমোট লোকালিটিতে (দুই শহরে, দুই স্টেটে বা দুই দেশে ইত্যাদি) থাকতেন। একজন আরেকজনকে তাদের চাল চিঠিতে লিখে জানাতেন।
তার মানে একটি চালের পর পরবর্তী চালের জন্য বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হত। এখন ইন্টারনেটেও করেসপন্ডেন্স দাবা খেলা হয়। সেক্ষেত্রে একটি চালের জন্য তিন থেকে পাঁচ দিন সময় পাওয়া যায় ! জানলাম চেজ ৯৬০ এর কথা। ববি ফিশার (বিখ্যাত দাবাড়ু) ভেবে দেখলেন দাবার ওপেনিং সম্পর্কে যার ধারণা নেই সে যদি এমন কারো সাথে খেলে যার সেই ধারণা আছে তবে সে প্রতিপক্ষের চেয়ে প্রথমেই পিছিয়ে আছে। এই অসুবিধা দূর করার জন্য, অর্থাৎ খেলাটিকে সম্পূর্ণরূপে ক্রিয়েটিভ করার জন্য ববি ফিশার বের করলেন দাবার এক নতুন নিয়ম।
খেলার শুরুতে ঘুটিগুলোর পজিশন বরাবরের মত হবে না। লটারি করে ঘুটি বসানো হবে শাফল করে। এতে করে ওপেনিং প্রিপারেশন কোন কাজে আসবে না; অর্থাৎ খেলার শুরুর চাল থেকেই এটি হবে সম্পূর্ণ ক্রিয়েটিভ খেলা। এই পদ্ধতিতে খেলার শুরুতে ঘুটিগুলোর ৯৬০ টি পজিশন সম্ভব। এজন্য খেলার নাম হয়েছে চেজ ৯৬০।
আমাদের এখানে দাবা’র ওপর বাংলায় দুইখানির বেশি বই আমি পাই নি। এবার দাবার ওপর বিশ্বের নামজাদা দাবাড়ুদের বই পড়া শুরু করলাম। পড়তে পড়তে মনে হল একটা বই বাংলা করলে কেমন হয়। অনেকের মনের খোরাক কিছুটা হলেও জুটবে। এই চিন্তা থেকে একটি বই সত্যিই অনুবাদ করা শুরু করেছি।
ধীরে ধীরে ব্লগে শেয়ার করার ইচ্ছা আছে।
গ্যারি ক্যাসপারভের ২৪টি দাবা লেসন নিয়ে স্পোর্টস ইন দ্যা ইউএসএসআর ম্যাগাজিনে ১৯৮৪-৮৫ সালে একটি সিরিজ প্রকাশিত হয়। এই লেসনগুলো নিয়ে ১৯৮৬ সালে ‘স্কুল অফ চেজ’ নামে একটি বই বের হয়। এর লেসন ১: হোয়াই স্টাডি চেজ এ ক্যাসপারভ তাঁর দাবার ভূবনকে পাঠকের সামনে কিঞ্চিত উন্মোচিত করেছেন। একটুখানি শেয়ার করে শেষ করব।
দাবা কী ? কোন স্পোর্ট ? সায়েন্স ? নাকি আর্ট ?
কেউ বলেন দাবাড়ুরা টুর্নামেন্ট এবং ম্যাচে অংশগ্রহণ করে থাকেন, তারা জেতার জন্য ফাইট করেন এবং ফলাফলটা তাদের কাছে গুরুত্ববহ- এটা এই নির্দেশ করে যে দাবা একটি স্পোর্ট। এটি ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করে এবং আত্মশক্তিকে আরো বলীয়ান করে।
ক্যাসপারভ যেন নিজের সাথেই বোঝাপড়া করছেন। যেন বিস্ময়ের সাথে স্পর্শ করছেন এক অপার্থিব জগত যেখানে শেষ চালে হেরে যাওয়ার আগ মুহূর্তের এক অসামান্য সেক্রিফাইং চালের স্বাদও দাবাড়ু উপভোগ করেন। ক্যাসপারভের কাছে তারা দাবা-শিল্পী যাদের কাছে দাবা অপার আনন্দময় এক শিল্প।
আবার এমন হাজারো দাবা পাগলা আছে যারা একটি ছোট্ট চালের ব্যাখ্যার খোঁজে রাতের পর রাত পার করে দিতে পারে। তাদের কাছে দাবার রহস্যময় জগত ধরা দেয় যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানের রূপে।
দাবার বুদ্ধিবৃত্তিক সৌকর্য শিশু ক্যাসপারভকে মুগ্ধতায় বেঁধেছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁর নিজের খেলায় এই সৌন্দর্যের অনুসন্ধান এবং তারও পরে সৌন্দর্যময় দাবা খেলার প্রয়াসের মধ্যেই ক্যাসপারভ দাবার শিল্পীত গ্রন্থিতে বাঁধা পড়েন। কিন্তু যখন ক্যাসপারভ টুর্নামেন্টের পর টুর্নামেন্টে অংশ নিতে নিতে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় উপনীত হলেন, তখন তাঁর মনে হল তিনি দাবার স্পোর্টিং এর যাত্রায় বেরিয়ছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।