Set sail, ye hearts~ into the sea of hope..
আগের পর্বে একজন নাপিতের গল্প বলছিলাম , যে দুই ছেলেকে যূপকাষ্ঠে বলী হতে দেখে এবং শেষ সন্তানকে অত্যাচারী তান্ত্রিক দেওরাজার হাত থেকে বাঁচাতে এক মুসলিম সাধকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। সে সাধকের পরামর্শে বলির ঠিক আগের রাত্রে সে সপরিবারে পদ্মার পাড়ে অপেক্ষা করতে থাকে সাহায্যের জন্য। তার ধারণা ছিলো কোনো সদয় মুসলিম রাজা হয়তো এগিয়ে আসবে তাদের উদ্ধার করতে। কিন্তু অনেক রাত পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন কেউ আসে না, তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় সপরিবারে নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মাহুতি দিবে।
কোমর পানি থেকে গলা পানিতে আসার সময় সে শুনতে পায় সামনে থেকে কেউ তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, "ভয় নাই, ভয় নাই" - চমকে উঠে ঝট করে সামনে তাকালো লোকটা।
অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। আর একটু সামনে এগোতেই দেখতে পেলো কুমীর আকৃতির কাঠের একটা অবয়ব। একটা নৌযান। তার ভেতর থেকে একটা হাত তার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দেয়া হলো, প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একে একে তারা উঠে আসলো সেই নৌযানে।
আমরা আগেই বলেছি, সেই নাপিত বাঘায় আস্তানা গড়া যে সাধকের কাছে গিয়েছিলেন, কথা বলার পুরোটা সময় তার মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিলো।
কিন্তু কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলেন ইনি আসলে সেই সাধক যার সাথে সে কথা বলেছিলো। তখনো নাপিত ও তার স্ত্রী-পুত্রের ভয়ের রেশ কাটেনি, ঘটনার আকস্মিকতায় তারা রীতিমতো থরথর করে কাঁপছিলো। সাধক তাদের অভয় দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, তার সেই পুত্র যাকে বলী দেয়ার কথা, তাকে অভয় দিলেন, দোয়া করে দিলেন। এরপর বললেন তোমরা নিশ্চিন্তে বাড়ী চলে যাও, তোমার ছেলেকে কেউ বলী দিতে পারবে না, আর খুব শীঘ্রই এই দেওরাজার পতন হবে, নরবলির প্রথা লোপ করা হবে।
নাপিত তখন কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে।
কিন্তু সে কিছুতেই একজন মুসলিম সাধককে এমন রণবেশে দেখে ব্যাপারটাকে মেলাতে পারছিলো না। সে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু আমাকে বলেছিলেন একজন মুসলিম রাজা আসবেন, তিনি..
নাপিতকে থামিয়ে দিয়ে এবার স্মিত হেসে সাধক বললেন, আমিই সে, তবে আমি রাজা না, আমি মখদুম। যাও এখন, সাবধানে বাড়ীতে চলে যাও। আর আমার কথায় আস্থা রেখো কোনো দুঃচিন্তা করো না। আর আজকের এই ঘটনার কথা গোপন রেখো।
নাপিত এবার আশ্বস্ত হলো। খুব সাবধানে নৌযানটাকে পাড়ে ভেড়ানো হলো। নাপিত, তার স্ত্রী ও পুত্র একে একে নেমে গেলো।
আর একটা কথা.., তারা নেমে গিয়ে কয়েক পা এগুতেই পেছন থেকে আবার ডাকলেন সাধক।
বলুন হুজুর.. নাপিত উল্টোদিকে ঘুরে এগিয়ে এসে সন্ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
নৌযান থেকে নেমে স্মিত হেসে সাধক জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দেওরাজের বলীর যূপকাষ্ঠটা কোন দিকে? রাস্তাটা আমাকে একটু দেখিয়ে দিয়ে যাও তো!
-- -- --
পরের দিন সকাল। আজ থেকে মহাকাল মন্দিরে শুরু হবে দেবতার পূজা। এই পূজার নিয়ম হলো, সকল আচারের শুরুতে দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলি দিতে হবে। তাই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে নরবলির যোগাড় যন্তর কাজ তদারকি করছেন মন্দিরের পুরোহিতদের একজন। কিছুক্ষণের মধ্যে দেওরাজ দুই ভাই এসে নরবলির প্রক্রিয়া শুরু করবেন।
আপাতত মন্ত্রপূত জল দিয়ে যূপকাষ্ঠটি ধোয়া হচ্ছে। ধোয়ার কাজে নিয়োজিতদের উদ্দেশ্যে পুরোহিত হাঁক ছাড়লেন, কই! বলীর নর কে আনা হলো?
বলীর জন্য যাকে রাখা হয়েছে, নাপিতের সেই ছেলেকে বাবা সহ নদীতে পাঠানো হয়েছিলো স্নান করিয়ে আনার জন্য। তাদেরকে সেই পুরোহিতের সামনে আনা হলো। পুরোহিত পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন সেই ছেলের। তারপর নাপিতের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন, "তিনটা ছেলেকেই মহাকাল দেবতার কাছে সমর্পণ করলি, তুই তো পুণ্যে আমাদেরকেও ছাড়িয়ে যাবি রে!" নাপিত কাঁপতে কাঁপতে সেখানে বসে পড়লো।
গাম্ভীর্যের সাথে পুরোহিত ইশারা করলেন ছেলেকে যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। আর তিনি রওনা দিলেন দেওরাজকে বলী প্রস্তুতির খবরটা জানাতে, কাজটা দ্রুত শেষ করতে হবে, যোগ সময় আর খুব বেশি হাতে নাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকঢোল সহ দেওরাজা মন্দিরে প্রবেশ করলেন। দেওরাজা হিসেবে পরিচিত এই দুই ভাই প্রকৃতপক্ষে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান পুরোহিত। তারা দুইজন বিগ্রহের সামনে যজ্ঞ শুরুর জন্যে দাঁড়িয়ে গেলেন।
পেছনে অন্য পুরোহিত গন, আর একজন যূপকাষ্ঠের বলী তদারকি করছেন। যোগ সময় শুরু হতেই বলীর জন্য হাত ইশারা করলেন রাজাদ্বয়।
বলীর দায়িত্বে থাকা পুরোহিত জল্লাদকে আদেশ দিলেন বলী শুরু করতে।
এক - দুই - তিন - হলো না!
জল্লাদ একটু অবাক হয়ে গেলো। পুরোহিত বিব্রত।
তাড়া দিলেন, আবার করো!
এক - দুই - তিন- এবারও হলো না! জল্লাদ ভয়ে দুই পা পিছিয়ে আসলো, হাত জোড় করে দাঁড়ালো পুরোহিতের সামনে।
এদিকে দেওরাজ সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন, অন্য পুরোহিতরা অনেকেই পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করছেন কি সমস্যা হলো। বলীর পুরোহিত তো রাগে অগ্নিশর্মা!!
অকর্মার দল! গজগজ করতে করতে নিজেই ক্রমাগত বলী দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।
হঠাৎ করে ঢাকঢোল বন্ধ হয়ে গেলো, মন্দিরের ভেতর থেকে ভেসে আসলো চিৎকারের শব্দ। হুড়োহুড়ি করে বের হয়ে আসছেন পুরোহিতরা।
যূপকাষ্ঠ ফেলে বলীর পুরোহিত মন্দিরের ভেতর উঁকি দিলেন। তাকিয়ে দেখলেন প্রচন্ডভাবে দুলতে শুরু করেছে বড় বিগ্রহ, যেকোনো মুহূর্তে আছড়ে পড়বে দেয়ালে। দেওরাজ তখনো ভেতরে, তারা মন্দির থেকে বের হননি।
এক মুহূর্ত সেই বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে আবার যূপকাষ্ঠের দিকে তাকালো সেই পুরোহিত। সেটা তখনো দুলছে, কাছে গিয়ে যূপকাষ্ঠ থেকে ছেলেটিকে আলাদা করে ফেললো।
ধীরে ধীরে থেমে গেলো বিগ্রহের দুলুনি।
সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর করনীয় ঠিক করতে পুরোহিতরা সবাই ঢুকে পড়লেন মন্দিরের ভেতর। বাইরে রুদ্ধশ্বাস হয়ে ঘটনাটা দেখছে নাপিত পিতা। মন্দিরের ভেতর গুঞ্জন শুরু হলো, কিছুক্ষণ পরেই একজন পুরোহিত বের হয়ে এসে ঘোষণা করলেন, "এই নরের দোষ আছে! এই নরের বলী হবে না!"
আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো নাপিত পিতা। তার দেহে যেন নড়ার শক্তিটিও অবশিষ্ট নাই আর।
দেখলেন তার সন্তানের বাঁধন খুলে দেয়া হচ্ছে, তবু নিজের চোখকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছ না সে। ছেলেটি অবাক দৃষ্টিতে দেখছে নিজের শরীরের বাধন খোলার দৃশ্য। এ যেন যমের বাড়ীতে উঁকি মেরে ফেরত আসা, নতুন জীবন ফিরে পাওয়া।
এখানেই কোথাও ছিলো দেওরাজার সেই মন্দির
মহাকাল গড় রাজ্যে যখন এই নাপিত পরিবারের কাহিনী নিয়ে চলছে তুমুল কানাঘুষা, ঠিক সেই সময় অতি গোপনে সৈন্য সামন্ত সংগ্রহ করছেন শাহ মখদুম। আশপাশের ফকির দরবেশ এবং গাজী গন ক্রমে সমবেত হচ্ছেন এই সাধকের পতাকা তলে।
মহাকাল গড় রাজ্য থেকে তুরকান শাহের হত্যাকারী এই অত্যাচারী দেওরাজার পতন ঘটাতে হবে, নরবলি প্রথার অবসান ঘটাতে হবে এবং সেখানে মুসলিম ফকির দরবেশদের অবাধ যাতায়াত ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
(শেষকথা: দিল্লীর বাদশাহ আওরঙ্গজেব এই নদীপথ দিয়ে যাওয়ার সময় রসদ সংগ্রহের জন্যে জাহাজ ঘাটে দাড় করান এবং মাজার পরিদর্শনে আসেন। সেসময় তিনি হযরত শাহ মখদুমের জীবন বৃত্তান্ত মাজারের খাদিমদের কাছে জানতে চান। সেসময় খাদিমদের কাছ থেকে শোনা ঘটনাসমূহ এবং আর সব কাহিনী এক করে ফারসি ভাষায় একটি বিবরণ তৈরি করা হয়, এবং বাদশাহের কাছে তা পেশ করা হয়। এটা ১৬৬৬ সালের ঘটনা।
এরপর সেই বিবরণটির আর হদিস পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ১৮৩৭ সালে এই সম্পত্তি খাস করার সময় সেই বিবরণের একটি অনুলিপি দরগার সেরেস্তায় পাওয়া যায়। তখন সেটি বাংলায় অনুবাদ করে সংরক্ষণ করা হয়েছিলো। এরপর সেই অনুবাদটি একজন মুতওয়াল্লীর পরিবার সংরক্ষণ করেছিলো ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। তাদের কাছে থেকে অধ্যাপক আবু তালিব এই পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে প্রকাশ করেন।
সেখানেই উল্লেখ করা হয়েছিলো এই নাপিত পরিবারের কাহিনী যেটা গল্পের আকারে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করলাম। বর্তমানে এই পাণ্ডুলিপিটি বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষিত আছে, এটি মুসলিম বাংলার প্রাচীনতম গদ্য রচনা। )[/si
(ফকির দরবেশদের সাথে কিভাবে দেওরাজার বিরোধের সূত্রপাত হলো আর সেখান থেকে তুরকান শাহ হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটনাগুলো আসছে পরের পর্বে)
--
আগের পর্ব: রাজশাহীতে এখনো সংরক্ষিত আছে অত্যাচারী দেওরাজের নরবলী দেয়ার যন্ত্র, সেই ঐতিহাসিক যুপকাষ্ঠ (প্রথম পর্ব)
আরও পড়ুন: বরেন্দ্র জাদুঘর: পুরাকীর্তির এক অচেনা জগতে.. (ছবি ব্লগ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।