আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিভূতিভূষণ মিট্‌স্‌ স্লো-মো ইন্ডিয়ানা জোন্‌স্‌ মিটস্‌ ন্যাটজিও বাংলা




এই পোস্টের শিরোনাম দেখেই মোটামুটি বুঝে গেছ সবাই, কি নিয়ে লিখতে চলেছি। হ্যাঁ, চাঁদের পাহাড় ছবিটা দেখে আমার ঐটাই মনে হয়েছে- এ হল বিভূতিভূষণের আদত গল্পের সাথে স্লো-মো ইণ্ডিয়ানা জোন্‌স্‌ এবং ন্যাটজিও /ডিসকভারি বাংলার এক মৃদুমন্দ ককটেল।
যেহেতু মোটামুটি অনেক জায়গাতেই এতদিনে চাঁদের পাহাড়ের রিভিউ, সমালোচনা ইত্যাদি সবই বেরিয়ে গেছে,এবং তাদের অনেকের সাথেই আমি একমত,তাই নতুন করে আমার আবার লেখার প্রয়োজন পড়ে না। তাও লিখছি।

আগে ভাল গুলো বলিঃ
১।

আফ্রিকা দারুণ। বিশেষ করে শুরুর মিনিট কয়েক তো দেখতে দারুণ লাগে। ক্যামেরার কাজ বেশ ভাল।
২। সঙ্গীত ভাবনা বেশ ভাল।


৩। বুনিপ এর ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন বেশ ভাল। অন্তত সত্যান্বেষীর চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার থেকে ভাল।
৪। মরুভূমির বুক চিরে আসা রেলগাড়ি, ব্ল্যাক মাম্বার সামনে শঙ্কর, তার দক্ষিণী বন্ধুর মাথার ওপরে সিংহের ওত পেতে থাকা – এইসব বেশ ভাল।

শঙ্করের সিংহ শিকারের ভাবনাটা মন্দ ছিল না, কিন্তু সেটাকে সঠিকভাবে ক্যামেরাবন্দী করা উচিত ছিল।
৫। হলে ছবিতে সাবটাইটেল ছিল ইংরেজিতে, সেটা বেশ ভাল ব্যাপার। অবাঙালিরাও যদি দেখতে যেতে চান, বোঝার অসুবিধা নেই।
৬।

এই বাজারে, পরিচালক এবং প্রযোজক যে লাস্যময়ী নায়িকা এবং বাংলা-ভাষার-পিন্ডি-চমকানো গান ছাড়া একটা ছবি বানানোর কথা ভেবেছেন, এবং বানিয়েছেন, এটাই যথেষ্ট ভাল ব্যাপার।
এবার বাজে দিক গুলো বলিঃ
১। পরিচালক বড্ড বেশি মূল কাহিনীকে অটুট রাখতে চেয়েছেন। ঋতুপর্ণের মত গল্পের আমূল খোল নলচে বদলে না দিয়েও কিছু কাট-ছাঁট করা যেত। এই কারণে ছবিটি অত্যন্ত ধীর গতির হয়ে গেছে।

এতই ধীর গতির যে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল। বিশেষ করে শেষের দিকে। চাঁদের পাহাড়ের চারিপাশের অঞ্চল ছেড়ে, কালাহারি পেরিয়ে শঙ্করের লোকালয়ে ফেরা- সেটা এক দীর্ঘ যাত্রা। কিন্তু যাত্রার দৈর্ঘ , ক্লান্তি এবং হতাশা বোঝানোর জন্য নানা ধরনের সিনেম্যাটিক কারিকুরি সম্ভব ছিল, যেগুলি আকছার অন্যান্য বাণিজ্যিক ছবিতে হয়ে থাকে। তাই, সেগুলি ব্যবহার না করে পরিচালক কেন নিজে এক ধীরগতির ব্যাকগ্রাউন্ড ন্যারেশন ব্যবহার করলেন, বুঝলাম না।

(ওই জন্যেই বললাম স্লো-মো আর ন্যাট জিও বাংলা)।
২। শঙ্কর (তার অভিযানের পোষাক আসাক এক্কেরে ইন্ডিয়ানা জোন্‌স্‌-এর মত), এবং তার সঙ্গী দিয়েগো আল্ভারেজ চাঁদের পাহাড়ের সন্ধানে বেরোয়। তারা দুজনে যখনি ক্যাম্প করে, তখনি দেখা যায় শুধু তাঁবু নয়, তার সাথে রয়েছে ফোল্ডিং খাট, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি। দুইজন মানুষ মিলে অতকিছু বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা, সেটা আমার জানা নেই।

স্বাভাবিক বুদ্ধি, এইধরণের অন্যান্য ছবি এবং নানা ধরনের অ্যাডভেঞ্চার গল্প পড়ে যা জানি, তাতে এইসব ধরনের জিনিষ খচ্চরের পিঠে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়, সাথে লোক থাকে সেইসবের নজরদারি করার জন্য। মূল গল্পে কি ছিল জানিনা, আবার পড়ে দেখতে হবে। মোট কথা , অবিশ্বাস্য।
৩। অভিযান শুরু হওয়ার অনেকদিন পর অবধি শঙ্কর এবং আল্ভারেজ এর জামাকাপড় বেশ পরিষ্কার থাকে।

দাড়ি-গোঁফ ও কামানো থাকে। শেষেরটা না হয় সিনেমার খাতিরে থাকতে পারে ( সে তো রামায়ণে রামের ও ১৪ বছর বনবাস সত্বেও দাড়ি গোঁফ ছিল না) , কিন্তু পরিষ্কার জামা-জুতো বড্ড চোখে লাগে। একদম শেষের দিকে এসে শঙ্করের হঠাত করে দাড়ি গজায়, চুল বাড়ে ইত্যাদি।
৪। ছবিতে নানারকমের ভাষার ব্যবহার আছে।

স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, সোয়াহিলি, জুলু, মাসাই, ইংরেজি, বাংলা ইত্যাদি। এবং অনেক সময়েই ডাবিং এর গন্ডগোল আছে। মাঝে মাঝে আবার সাবটাইটেল আছে, কিন্তু কোন কথা শোনা যাচ্ছে না। মাঝে এক আধ জায়গায় হটাৎ করে সম্পূর্ন অন্য ভাষায় কোন ডায়ালগ, সেটার একটা জোর করে চাপানো ডাবিং । কোথাও আবার শঙ্কর জুলু বা মাসাই বুঝতে পারছে…এইসব গন্ডগোল আর কি! এই ধরণের ছবি করলে এইরকম সমস্যা হবে, জানাই কথা।

তাই এক্ষেত্রে পরিচালকের উচিত ছিল পুরোটাই পরিষ্কার বাংলায় ডাব করে করা। এক্ষেত্রে কিছুদিন আগে শ্রী শ্যাম বেনেগালের একটা অনেক পুরনো ছবি দেখছিলাম টিভিতে- ত্রিকাল, সেখানে পরিচালক খুব সুন্দর ভাবে ব্যাপারটা মিটিয়েছেন। উনি ছবি শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই, কথক চরিত্রের মাধ্যমে বলিয়ে দিলেন যে এই গল্পের যা পটভূমি, তাতে সমস্ত চরিত্রের পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলা উচিত, কিন্তু তাহলে দর্শকদের বুঝতে অসুবিধা হবে, তাই এই ছবিতে সবাই হিন্দিতেই কথা বলবে। কমলেশ্বরের উচিত ছিল এই ধরণের কিছু একটা করা। তাহলে ওই ডাবিং এর অপরিচ্ছন্নতাটা থাকত না।


৫। এটা আরো বেশি করে মনে হয়েছে ডিয়েগো আল্ভারেজ এর চরিত্রে জেরার্ড রুডল্‌ফ্‌ এর ডায়লগ নিক্ষেপণ দেখে। ভদ্রলোক ভাল অভিনেতা, বাংলাটাও মোটামুটি শিখে নিয়েছিলেন, কিন্তু আদতে কি বলছেন সেটা বুঝতে পারছিলেন না যেহেতু, ফলে বাক্যের কোথায় কতটুকু যতি বসা উচিত, সেই নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে ছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে। ফলে অনেক সময়েই, যে বাক্যের নিক্ষেপণ যেরকম হওয়া উচিত সেরকম হয়নি, ধীরে টেনে কষ্ট করে বলতে হয়েছে ওনাকে। এর থেকে অনেক ভাল হল সঠিক বাংলা ডাবিং থাকলে।


৬। ছবির শেষ দিকে বুনিপকে হত্যার ছক, এবং তার পরিকল্পনা এবং কার্যোদ্ধার – একেবারেই নেওয়া যায় না। যে লোক প্রায় মরতে বসেছিল, সে হটাত চাগিয়ে উঠে (খাবার -জল কোথা থেকে জুটছে জানা নেই) শুধু একটা কুঠার দিয়ে ডাল কেটে কেটে একটা দৈত্যকে ধরার জন্য একটা দৈত্যাকার ফাঁদ বানাল, (এবং বুনিপ ততদিন দেখা দিল না, যতদিন না ফাঁদ বানানো শেষ হল), এবং তারপরে তাকে মারল- এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।

এইবারে শেষ কথা। শঙ্করের চরিত্রে দেবকে কেমন মানিয়েছে? কেউ বলছে মানায়নি, কেউ বলছে মানিয়েছে।

আমি বলছি, মানিয়েছে। একেবারে ঠিকঠাক মানিয়েছে। গল্পে শঙ্কর এফ-এ পাশ করা, কিন্তু আদতে খেলাধুলো ভালবাসা ছেলে- কুস্তি, সাঁতার, অ্যাডভেঞ্চারের শখ। গল্পে কোথাও লেখা নেই, সে বড় দিগগজ পন্ডিত। তাই দেবের মুখে যে নিজস্ব একটা না-আঁতেল ভাব আছে, সেটা ঠিকই আছে এখানে।

তার ইংরেজি উচ্চারণ ও সাদামাটা, সেটাও মানিয়ে গেছে। অন্য এক দাড়িওয়ালা “জন্মজ্যাঠা” পরিচালক-অভিনেতাকে ওই চরিত্রে মোটেও মানাত না, সে তিনি যতই সেটা দাবি করুন না কেন। অভিনয়ের জায়গায়, দেবের থেকে খুব বেশি আশা হয়ত কারোরই ছিলনা, কিন্তু এই ছবিতে তো নয়টি রসের সবগুলি দেখানোর জায়গাও নেই। তাই কোথায় যেন পড়েছিলাম, সিংহ মারার সময়ে দেবের মুখভঙ্গী “চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা” গোছের- সেটাই হওয়া উচিত ছিল নয় কি? যে ছেলে ভেবেছে সে সিংহের মুখোমুখি হবে, তাকে তো আর ভয় পেলে চলবে না, তাকি ওই চ্যালেঞ্জ নিবি না…গোছের হাবভাবই দেখাতে হবে। বাঙালি দর্শক যদি লালন ফকির হিসাবে পোসেনজিত কে হজম করতে পারে, তাহলে শঙ্কর হিসাবে দেবকে দশে অন্তত সাত দেওয়া উচিত।

আমি দিলাম।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।