আমার প্রিয় কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় । আজ আমার প্রিয় এই অমর কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুদিবস ।
আমি যখন স্কুলে ৯ম শ্রেনীতে দ্রুত পঠন হিসেবে “পথের পাঁচালী” পাঠ করি সেই থেকেই তিনি আমার প্রিয় কথাশিল্পী । “পথের পাঁচালী”র অনেক পাতার কাল্পনিক দৃশ্য সেই কিশোর বয়সে আমি হৃদয়পটে এঁকেছি । এখন সেই উপন্যাসের কোন কোন অধ্যায় আমার চোখে ভেসে উঠে ।
অপু, দূর্গা আর তাদের মা , সর্বজয়া যেন চিরন্তন বাঙলারই অবিনশ্বর প্রতিচ্ছবি । বিশ্বখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় নির্মিত তার লেখা অপরাজিতা, অপু’র সংসার, পথের পাঁচালী চলচিত্রের প্রতিটি দৃশ্য এত জীবন্ত এত আবেগঘন যা সিনোমাগুলো না দেখলে কেউ বুঝতে পারবেন না ।
প্রকৃতির মাঝে তিনি লীন হতে পারতেন। দু'চোখ ভরে উপভোগ করতে পারতেন নিসর্গ সৌন্দর্যকেও। আবহমান বাংলার নিভৃত পল্লীজীবন ও সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম তিনি দেখেছেন একেবারে কাছ থেকে।
ফলে তার রচনাতে মানবজীবন ও প্রকৃতি একীভূত হয়ে অভিনব ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কথাসাহিত্যে যে ক'জন শক্তিমান লেখকের আবির্ভাব ঘটেছিল, বাংলা উপন্যাসের মূল স্রোতধারার মধ্যে থেকেও মৌলিকতা এবং সরস উপস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যিনি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের রূঢ় বাস্তবতা ও সমকালের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তার রচনায় যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, বাংলা সাহিত্যে তা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রকৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়েও তিনি গভীর জীবনবোধকে নিরলসভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নিভৃতচারী এ কথাশিল্পী।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর [২৯ ভাদ্র ১৩০০ বঙ্গাব্দ] পশ্চিমবঙ্গের চবি্বশপরগনা জেলার মুরারিপুর গ্রামে, মামাবাড়িতে। তবে তার পৈতৃক নিবাস ওই জেলারই ব্যারাকপুরে। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। পাণ্ডিত্য এবং কথকতার জন্য তাকে 'শাস্ত্রি' বলেও অভিজ্ঞান করা হতো। স্বল্প আয়ের অস্বচ্ছল সংসার ছিল তার।
বিভূতিভূষণদের পাঁচ ভাই-বোনের তাই বাল্য ও কৈশোর কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। কিন্তু বিভূতিভূষণ ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। পিতার কাছে শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হলেও অল্পদিনের মধ্যেই তার মেধার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। ফলে বিভূতিভূষণ স্থানীয় বনগ্রাম ইংরেজি বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ পান। ১৯১৪ সালে বনগ্রাম ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স, ১৯১৬ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ এবং ১৯১৮ সালে একই কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেন।
এরপর তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু সাংসারিক অসচ্ছলতার কারণে দ্রুত তাকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। ফলে পরীক্ষা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে এবং শেষও করেন শিক্ষক হিসেবে। মাঝখানে কিছুদিন ছিলেন গোরক্ষিণী সভার প্রচারক, খেলাৎচন্দ্রের বাড়িতে সেক্রেটারি, গৃহশিক্ষক এবং ভাগলপুর এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার।
এরপর যোগ দেন খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে। তারপর আসেন গোপালপুর স্কুলে এবং এ বিদ্যালয়েই তিনি আমৃত্যু ছিলেন।
বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত হয় ১৯২১ সালে, 'উপেক্ষিতা' শিরোনামের গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন উপন্যাসে। তার সামাজিক উপন্যাসগুলো এক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
১৯২৫ সালে ভাগলপুর এস্টেটে অবস্থানকালে লিখতে শুরু করেছিলেন 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসটি। এটি লিখে শেষ করতে লেগেছিল প্রায় তিন বছর। এরপর রচনা করেন অপরাজিত, যা পথের পাঁচালীরই পরবর্তী অংশ। উভয় রচনাতেই উপনিষদের জীবনদর্শনকে আধুনিক বিশ্বানুভূতির সুরে বেঁধে রেখেছেন। দাম্পত্য প্রেমের নিবিড়তার অভাবে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, এ উপন্যাস দুটিতে তা অনন্তের বাধাহীন প্রসার ও সাংকেতিক ব্যঞ্জনায় নিজ সীমা অতিক্রম করেছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেক সৃষ্টি 'আরণ্যক'। উপন্যাসটির পরিকল্পনা বাংলার সাধারণ উপন্যাসের ধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মাত্র ২১ বছরের সাহিত্যিক জীবনে তিনি অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। গোয়েন্দাধর্মী কাহিনী রচনায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। 'চাঁদের পাহাড়' এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তার রচনাবলি ভারতীয় বিভিন্ন ভাষাসহ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ১ নভেম্বর ১৯৫০ সালে [১৩৫৭ বঙ্গাব্দের ১৫ কার্তিক] তিনি ভারতের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন।
সহায়তা: দৈনিক সমকাল - ০১-১১-০৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।