আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওরা সংখ্যালঘু নয়, ভূমিপুত্র

বাংলাদেশে কারা সংখ্যালঘু সেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কাউকে সংখ্যাগুরু আর কাউকে সংখ্যালঘু বলে অভিহিত করাটা অন্তত আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ বাঙালি এটাই বড় পরিচয়। কে কোন ধর্মের অনুসারী এ বিষয়ের বিবেচনা সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে না। আজ যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করে বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনুসারীকে সংখ্যালঘু বলতে চান_ তারা হয় চোখ থাকতে অন্ধ; না হয় এ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।

এমনকি তাদের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও খুব জ্ঞান আছে এমনটিও মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দাবিকারী অনেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সংখ্যালঘু বলে অভিহিত করছেন অহরহ। তারা কতটুকু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বোঝেন বা লালন করেন সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই উচ্চারিত হয়েছে : বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ আমরা সবাই বাঙালি। যদি সবাই বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত হই, তাহলে কীভাবে বাঙালিদের একটি অংশ আবার সংখ্যালঘু হয়?

ইসলাম ধর্মের অনুশাসনে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর ধারণা অচল।

সেখানে ধর্মের বিবেচনায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অনুশাসনের ক্ষেত্রে মুসলিমদের সঙ্গে অমুসলিমদের ন্যায্য পার্থক্য আছে ঠিকই। তবে ওই ধর্মের বিধানে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই কাউকে সংখ্যালঘু আর কাউকে সংখ্যাগুরু অভিহিত করা হয়নি। বরং মহানবী (সা.) যে মদিনাকেন্দ্রিক উষ্মাভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; ওই রাষ্ট্রে অমুসলিমদেরও মুসলিমদের পাশাপাশি বসবাসের সমান অধিকার ছিল। মদিনা সনদের ১ নম্বর ধারাতেই বলা হয়েছে : 'অন্যদের মোকাবিলায় তারা এক উষ্মা (মুসলিম-অমুসলিম সবাইকে এর অন্তর্ভুক্ত) বলে গণ্য হবে' এবং ৪৩ নম্বর ধারাতে বলা হয়েছে : 'আর ইয়াছরিব উপত্যকা এই চুক্তিনামার সবার পক্ষের কাছে পবিত্র ভূমি বলে গণ্য হবে'। মদিনা রাষ্ট্রের সংবিধান বলে অভিহিত এই সনদের ৫৩টি ধারার কোথাও কাউকে সংখ্যালঘু আর কাউকে সংখ্যাগুরু বলে চিহ্নিত করা হয়নি।

মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ পাঠ করলেই খুব সহজে উপলব্ধি করা যায়, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ভাষা ও জাতিগত বৈচিত্র্যর কারণে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বা গুরু দাবি করার সুযোগ ইসলাম ধর্মে নেই। বিশ্বনবী (সা.) তার বিদায় হজের ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন : '...আজ হতে বংশগত কৌলিন্য বিলুপ্ত হলো। সেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে নিজ কাজের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। ... আরবদের ওপর অনারবদের এবং সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই। '

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যখন তিনি এই ভাষণ প্রদান করেছেন; তখন 'জনতা', 'জনমণ্ডলী' বলে উপস্থিত লোকদের সম্বোধন করেছেন।

আল-কোরআনেও বহু স্থানে : 'হে মানব জাতি!'_ এমন উল্লেখ রয়েছে। যা থেকে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, ইসলাম কেবল মুসলিমদের ধর্ম নয়, এটি সব মানুষের জন্য মনোনীত ধর্ম। যারা এর অনুসরণ করেন তারাই মুসলিম। আর যারা এর অনুসরণ করেন না; তারা মনুষ্য সমাজচ্যুত এমন মনে করার সুযোগ নেই। বরং অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি, উদারতা ও সহনশীলতা মহানবী (সা.) ও তার ঘনিষ্ঠ সাহাবিরা দেখিয়েছেন, তা অনুসরণ করলে ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে যারা রামু, সাঁথিয়া ও অভয়নগরসহ বহু স্থানে মন্দির এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে; তারা প্রকৃতই ইসলাম ধর্মের বিধান লঙ্ঘন করেছেন তা স্পষ্ট হবে।

আল-কোরআনে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, 'আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে তাদের তোমরা গালি দিও না, কেননা, তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে...' (সূরা আন্'আম : ১০৮)। আর আল-কোরআনের অন্য আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে : হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তাকে ভয় কর যিনি তোমাদের একটি ব্যক্তি [হজরত আদম (আ.)] থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তার থেকে তার জীবনসঙ্গিনীকে [হজরত হাওয়া (আ.)] সৃষ্টি করেছেন, আর তাদের দুজন হতে অসংখ্য পুরুষ ও নারীর বিস্তার ঘটিয়েছেন, তোমরা আল্লাহতাআলাকে ভয় কর, যার নামে তোমরা পরস্পরে যাচনা (তাগাদা) করে থাক এবং আত্দীয়স্বজনের ব্যাপারেও ভয় কর। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন (সূরা আন-নিসা : ১)। ওই আয়াত অনুসরণ করলেই তো সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।

আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যও ওই বাঙালিদের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুতে বিভাজন স্বীকার করে না। আমরা যারা ধর্মীয় কারণে গর্ব করে নিজেদের সংখ্যাগুরু দাবি করি; তারা কী কখনো ভেবেছি : ওই সংখ্যালঘুরা কারা, কি তাদের পরিচয়, কোথা থেকেইবা তারা এসেছে? তাদের ও আমাদের পূর্বপুরুষরা একই পিতা ও মাতার সন্তান। একই পরিবারে আমাদের ও তাদের পূর্ব-পুরুষরা বেড়ে উঠেছে। তারা যে ভাষায় কথা বলে আমরাও সেই ভাষায় কথা বলি। তাদের বাড়ির বধূর কপালে যদি সিঁদুর আর হাতে শাখা না থাকে; তবে আমাদের বাড়ির বউ আর তাদের বাড়ির বউকে আলাদা করাই দায় হয়ে পড়ে।

আমাদের কুমারী মেয়ে আর তাদের কুমারী মেয়েদের আলাদা করা যায় কী? আমাদের ও তাদের মধ্যে এত মিল যে, অপরিচিত কোনো এলাকাতে আমাদের অথবা তাদের কেউ দুর্ঘটনায় মারা গেলে সৃষ্টির আদিম অবস্থায় ফিরে না গেলে বোঝাই দায়; মৃত ব্যক্তিটি সংখ্যালঘু না সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের! ওই রকম যদি হাজারটা মিল-অমিল দুপক্ষের মধ্যে খুঁজতে যাই; তবে ৯৯.৯৯ ভাগ দিক দিয়ে আমরা সংখ্যাগুরু এমন দাবি করার সুযোগ নেই। সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর এই কেচ্ছা আমাদের রাজনীতিবিদরা সাজিয়েছে কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে। যেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বলে কিছু নেই। ইসলাম ধর্মকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে তারা প্রায় সবাই সংখ্যালঘু ধোঁয়া তুলে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে নিপীড়ন করেছে যুগের পর যুগ। ওই কথিত ইসলামপ্রেমীরা জানে, ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালালে ওরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পাড়ি জমাবে।

তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি হয় সংখ্যাগুরুর কাছে কম দামে বিক্রি করবে। আর তারা ওই বিক্রির সুযোগ না পেলে তো এমনিতেই দখলে চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে হিসাব করলে দেখা যাবে, ১৯৭১-২০১৪ হিন্দু সম্পত্তি অধিকারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই।

মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনেও ওই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বিএনপি ও জামায়াতের অনুসারীদের উৎপীড়ন প্রকাশ্য স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে খুব কমই অভিযোগ উত্থাপন করেছে।

ইদানীংকালে তারা ওই লুকোচুরি খেলা থেকে বেরিয়ে এসে সত্য প্রকাশ করছে। যশোরের অভয়নগরের চাঁপাতলায় ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার নায়ক বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক হুইপ আবদুল ওহাবের লোকেরা, তা আর শেষ পর্যন্ত চাপা থাকেনি। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থীর দায়ও কম নয়। তারা চাইলে এই হামলা প্রতিরোধ করা যেত। একতরফা নির্বাচন আয়োজনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা যে আক্রান্ত হতে পারে তা পাগলেও বোঝে।

বিরোধীদলীয় নেতাকে অবরুদ্ধ করতে যত পুলিশ নিয়োগ করা হয়েছিল; তার সিকি ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত প্রতিটি এলাকায় নিযুক্ত করলেই এই ধরনের বর্বরতা ঠেকানো যেত।

কিন্তু সরকার অগোচরে হয়তো এমন একটি ঘটনার জন্যই অধীর অপেক্ষায় ছিল। ওই ঘটনাতে সরকারেরই লাভ হয়েছে বেশি। ওই হামলার পর মিডিয়ার দৃষ্টি একতরফা নির্বাচনের ওপর থেকে চাঁপাতলার দিকে সরে গেছে। উপরন্তু লাভের ওপর ফাও হিসেবে ওই এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পকেট ভারী হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

এখন হিন্দুদের পুনর্বাসনের নামে যে সরকারি অর্থ খরচ করা হবে, তার সিংহ ভাগই তাদের পকেটে যাবে। আগের ইতিহাস অন্তত তাই বলে। উপরন্তু, বিদেশিদেরও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যাবে যে, জামায়াত-বিএনপি কত ভয়ঙ্কর! আমরা ক্ষমতায় থেকে তাই ওদের আক্রমণ থেকে এদের রক্ষা করতে পারছি না; আমরা ক্ষমতায় না থাকলে ওই বর্বরতা আরও কত ভয়াবহ হবে সেই বিষয়টি। তাই এই ঘৃণিত ঘটনার দায়ও কমবেশি সরকারকেও নিতে হবে। পরিশেষে, কথিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাঙালিদের যেমন এ দেশে বসবাসের অধিকার রয়েছে; তেমনি অন্য ধর্মের মানুষেরও এই মা, মাটি, দেশের ওপর অধিকার কম নয়।

তারাও বাংলার ভূমিপুত্র। তারা কোনোভাবেই সংখ্যালঘু নয়; তারা আমাদের ভাই। তাই তাদের রক্ষায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। ইসলামের উদারতা ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে আল-কোরআনের নির্দেশ ও মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে ওই সব কথিত মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে মুসলিমদের দায়িত্বও কম নয়।

লেখক : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল : salah.sakender@gmail.com

 

 

 



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.