শিরোনামটি যেন কিরাম কিরাম হয়ে গেল। ঠিক যেন বাংলা সিনেমার নামের মতো কয়েক দিন যাবৎ মনে হচ্ছিল একটি সিনেমা বানাই হালের ক্রেজ অনন্ত জলিলের মতো। অনন্ত আমার তরুণ বন্ধু। ও যদি পারে তবে আমি পারব না কেন। ও তো নিজে কাহিনী লিখে।
তারপর পরিচালনা এবং অভিনয়সহ অন্যান্য খুঁটিনাটি কাজও নিজে করে। তার ছবির নায়িকা সাধারণত তার স্ত্রী বর্ষাই হয়ে থাকেন। আমার স্ত্রী অবশ্য নায়িকা হতে রাজি নন। তাতে আমার ভালোই হয়েছে। বোম্বে বা কলকাতা থেকে আমার সঙ্গে মাননসই নায়িকা আমদানি করা যাবে।
কয়েকজন আমার বেশ জানাশোনা। এদের মধ্যে বিদ্যা বালানই আমার বেশি পছন্দ, রানী মুখার্জিও খারাপ হবে না। জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে_ তাই তো পরিণত বয়সে এসে নতুন করে রং ঢং করার সখ জেগেছে। শিরোনামের বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে বলে নেই হঠাৎ করে আজ লেখার তাড়না অনুভব করলাম কেন?
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সহযোগী পত্রিকা দৈনিক কালের কণ্ঠে খবর বেরিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রয়োজনীয় অর্থায়ন না করার কারণে সরকার অবশেষে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে যাচ্ছে।
এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বিপরীতে যে বৈদেশিক মুদ্রা লাগবে তা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সরবরাহ করা হবে। এ খবরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আবেগ আর অনুভূতির অনেক কিছুই জড়িত। দেশের বাঘা, বাঘা অর্থনীতিবিদ যখন বলছিলেন বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া পদ্মা সেতু সম্ভব নয়, কিংবা আমাদের বয়ঃবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী যখন বলছিলেন বিশ্বব্যাংক ছাড়া এ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়_ তখন সমগ্র স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আমিই উচ্চৈঃস্বরে বলেছিলাম_ সম্ভব। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
গত পাঁচটি বছর ধরে আমি বলে আসছিলাম পদ্মা সেতু সম্পর্কে আমার পরিকল্পনার কথা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করে।
স্থানীয়ভাবে অর্থের জোগান দিয়ে সেতুটি ৪-৫ বছরের মধ্যে নির্মাণ করা সম্ভব। যা কিনা সরকার বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে ঠিক সেভাবে, যেভাবে আমি প্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ২০১০ সালের প্রথম দিকে। এর পর বহু কলাম লিখেছি বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়। এ ছাড়া নানা সভা-সমিতি, সেমিনার এবং টেলিভিশন টকশোতে অসংখ্যবার আমার প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপন করেছি।
আমাদের দলের কট্টরপন্থিরা আমার এসব বক্তব্যে ভারি বিরক্ত হতেন।
নিজেরা আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে গালাগাল করতেন এবং দলের তরুণ বন্ধুদের লেলিয়ে দিতেন। ভাগ্যিস তরুণীদের লেলিয়ে দেননি! তাহলে আমার অবস্থা যে কি হতো তা সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে ইটা মারার দৃশ্য দেখেই বুঝতে পেরেছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা বহুদিনের। দলের যেসব প্রাজ্ঞ-অভিজ্ঞদের নেতৃত্বে রাজনীতি করতে করতে আমি যখন সংসদ সদস্য হয়ে গেলাম, তখন চারপাশে তাকিয়ে দেখি আমি আছি কিন্তু আমার নেতারা নেই। নবম সংসদের কার্যাকালীন সময়ে যারা সরকার ও দলের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের বেশির ভাগই অখ্যাত, অযোগ্য এবং ব্যক্তি বা মহলবিশেষের করুণায় নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন।
অনেকে তাদের মেনে নিয়েছিলেন প্রচণ্ড হতাশা সত্ত্বেও। আবার অনেকে মেনে নেননি কিন্তু চুপচাপ ছিলেন বাস্তব পরিস্থিতি এবং নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। কিন্তু আমি বিষয়টি কোনো দিন মেনে নিতে পারিনি। অনায়াসে এবং নির্দ্বিধায় আমার মতামত ব্যক্ত করেছি।
২০১১ সালে আমি বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছিলাম_ তোফায়েল ভাই, আমু ভাইকে মন্ত্রী পরিষদে দেখতে চাই।
পুরনো নেতাদের রাজনীতিতে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য দলীয় সভানেত্রীকে একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, খ. ম. জাহাঙ্গীর, আখতারুজ্জামান, সাবের হোসেন চৌধুরী, মুকুল বোস, আবদুল মান্নান, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন প্রমুখকে রাজনীতির পাদপীঠে নিয়ে আসা হোক। আমার যুক্তি ছিল নেতা সহজে সৃষ্টি হয় না, কিন্তু ধ্বংস করতে সময় লাগে না। আওয়ামী লীগ ৩০ বছর ধরে যাদের সৃষ্টি করেছে তাদের আবার নিজ হাতে বিনাশ করাটা কোনোমতেই ঠিক হবে না।
উপরোক্ত লেখা প্রকাশ হওয়ার পর আমার শুভার্থীদের কেউ কেউ ফোন করে বলেছিলেন, তুমি কেন খ. ম. জাহাঙ্গীরের কথা বলতে গেলে? সে যদি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়, তাহলে তোমার জায়গা কোথায়? আমি মুচকি হেসে বলেছিলাম_ অসুবিধা নেই, তবুও আমি চাই তারা আসুক।
আমার বিশ্বাস যদি এমপি হতে চাই তবে জনগণের ভোটে আমি তা হতে পারব এবং সে ক্ষেত্রে ইনশাল্লাহ দলীয় মনোনয়ন লাগবে না। অন্যদিকে রাজনীতির মূল লক্ষ্য কেবল মন্ত্রী বা এমপি হওয়া নয়। যে কোনোভাবে জনকল্যাণ করার একটা অদম্য আকাঙ্ক্ষা থাকলে মানুষ কখনো জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় না। আর একজন মানুষ যদি সারা জীবন একাই পদ-পদবি অাঁকড়ে থাকে, তাহলে নতুন নেতৃত্ব আসবে কীভাবে?
আমি এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ধরে নিয়েছিলাম দ্বিতীয় মেয়াদে আমি মনোনয়ন চাইব না বা পাব না কিংবা এমপি হতে পারব না। ফলে আমাকে যা কিছু করতে হবে তা পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যেই করতে হবে।
ফলে এলাকার উন্নয়ন, স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সৃষ্টি এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিছু কাজ করার পরিকল্পনা আমি প্রথম থেকেই করে রেখেছিলাম। উদ্দেশ্য একটাই_ এমপি না হলেও যেন আমি জাতীয় রাজনীতির ধারাবাহিকতা ও আলোচনা থেকে বাদ না পড়ি, কিংবা মানুষ যেন আমাকে ভুলে না যায়।
পদ-পদবির প্রতি লোভ বা সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা না থাকার কারণে আমি নির্ভয়ে সব কথা বলতে পেরেছি এবং এখনো পারছি। কোনো প্রভাবশালীর পদলেহন আমাকে করতে হয়নি। ফলে নিজের মধ্যকার সহজাত এবং অন্তর্নিহিত গুণাবলী নষ্ট হয়নি।
অন্যদিকে নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে অসম্ভব সব কাজ করতে পেরেছি। একটি উদাহরণ দিলেই সম্মানিত পাঠক বিষয়টি বুঝতে পারবেন। ঢাকার অদূরে বিমানবন্দর তৈরির জন্য মাত্র ৬০০ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেও পারেনি। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় সেনা কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক এলাকা করতে গিয়ে জনরোষের কারণে সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে।
এবার আমার এলাকার কথা বলি। এশিয়ার বৃহত্তম বীজ বর্ধন খামার প্রতিষ্ঠিত হলো আমার নির্বাচনী এলাকায়। বলতে দ্বিধা নেই এই খামার প্রতিষ্ঠার চিন্তা এই অধমের মস্তিষ্কপ্রসূত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, বর্তমান কৃষি সচিব এটি অনুমোদন দেওয়া এবং সর্বাত্দক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু নেপথ্যের সব কাজই আমি এককভাবে করেছি।
যখন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন লাভ করল তখনই শুরু হলো আমার অগি্নপরীক্ষা। প্রকল্পের জন্য মোট ৫৩০০ (পাঁচ হাজার তিনশ) একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে এবং আমি তা করে দিলাম দুই-তিন মাসের মধ্যে। একটি মিছিলও হয়নি, একটি মামলাও হয়নি। সরকারের পুলিশ বাহিনীকে কিছুই করতে হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালে সেটি উদ্বোধন করলেন কোনো একদিন সকাল ১০টার সময়।
চারদিকে সাত-আট কিলোমিটার প্রশস্ত একটি নদীবেষ্টিত নির্জন দ্বীপে অত সকালে একলাখ লোকের সমাবেশ করেছিলাম। সকাল ৯টার মধ্যে লোকজন সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়েছিল। কেউ কেউ বাড়ি থেকে ট্রলারে রওনা হয়েছিল আগের রাত ১২টার সময়। বিশাল নির্বাচনী এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত একলাখ লোক আট-নয় ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে এবং ট্রলারে বসে তিন বেলা খাবার খেয়ে সমাবেশে এসেছিল এমপির আহ্বানে। আর আমি এসব করেছিলাম কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে।
নমিনেশন পাওয়ার জন্য নয় কিংবা মন্ত্রী-এমপি হওয়ার জন্য নয়।
আজ আমি এ কথা ভেবে কিছুটা হলেও তৃপ্তি পাই যে, গত পাঁচটি বছর যেসব অযোগ্য ও অদক্ষ মন্ত্রীদের কার্যকলাপ এবং দুর্নীতি নিয়ে সরব ছিলাম_ তারা সবাই নতুন মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ পড়েছেন। অনেকে তো মনোনয়নই পাননি। যাদের দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য বারবার প্রস্তাব করেছিলাম কম-বেশি তাদেরই তো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে তাই আওয়ামী লীগের ঘোর শত্রুরাও সমালোচনা করতে পারছে না।
এসব বিষয় নিয়ে আমি যখন সমালোচনামুখর থাকতাম তখন দলের কিছু লোক আমাকে নব্য খন্দকার মোশতাক বলত। তারা এখন কী বলবেন!
আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় দলের একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে সর্বদা চেষ্টা করেছি দল ও সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য। সেখানকার ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি বা অন্য কোনো অরাজক কার্যকলাপের অভিযোগ ছিল না। অত্যন্ত শক্ত হাতে আমি দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করেছি। কোনো সরকারি অফিস, কোর্টকাচারি, থানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কোনো রাজনৈতিক নেতা-কর্মী সে যে দলের হোক প্রভাব বিস্তার তো দূরের কথা ঢুকতেও সাহস পেত না।
অভাবী ও অসহায় লোকজন সব সময় নিরাপদবোধ করতেন। কারণ প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য তাদের রাজনৈতিক নেতা বা টাউটদের দ্বারস্থ হতে হতো না।
আমার কার্যকালীন সময়ে আমি যখন এলাকায় যেতাম তখন কম করে হলেও ১৫ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত অবস্থান করতাম। গত পাঁচ বছরে একটি সংবর্ধনা নিইনি। একটি তোরণ নির্মিত হয়নি আমার জন্য।
চলাফেরার জন্য পুলিশ প্রটেকশন দরকার হয়নি। এক দিনের জন্য সরকারি গাড়ি ব্যবহার করিনি। কোনো সার্কিট হাউস বা ডাকবাংলোতে বসে সরকারি পয়সায় এক কাপ চা খাইনি। একটি ভাড়া করা মোটরসাইকেল নিয়ে দিন-রাত পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম আর এমপিগিরি করতাম একজন ইউপি মেম্বারের মতো। রাজনীতিতে আমি এসেছি ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবেই এবং নিজস্ব অর্থ দ্বারাই সেবা করেছি।
এলাকার মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এবং আর্তমানবতার পুনর্বাসন ও চিকিৎসার জন্য স্বোপার্জিত অর্থই ব্যয় করেছি বেশি। অন্যদিকে সরকারি বরাদ্দগুলো বণ্টনে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছি।
আমি যখন এসব কাজ করতাম তখন নিজেকে সিনেমার নায়কের মতোই মনে হতো। কখনো কখনো মনে হতো হজরত ওমর (রা.)-এর মতো। আমি শুধু নায়কের সফলতার কথাই চিন্তা করতাম।
কিন্তু সিনেমার নায়কের করুণ পরিণতি কিংবা বহুমুখী ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের ফাঁদে পড়ার কথা ভাবনায় আসত না। কিন্তু বাস্তবে আজ আমার জীবন সত্যিই নায়কের মতো হয়ে গেছে। শিরোনামের বিষয়, 'এমপি যখন ডাকাত কিংবা লুটেরা' নামক সিনেমার নায়ক হিসেবে আমি কি যে এক নিদারুণ সময় পার করছি তা সম্মানিত পাঠকদের জানাতে চাচ্ছি। আমার জীবনের ট্র্যাজেডি থেকে কেউ হয়তো শিক্ষা নিতে পারবেন আবার কেউ হয়তো ট্র্যাজেডির মধ্যে চরম একটি আদিম ও বন্য প্রকৃতির কমেডির স্বাদ পেয়েও যেতে পারেন। কথা না বাড়িয়ে সিনেমার গল্পটি আপনাদের বলি।
নায়কের ছিল ছোট্ট একটি সুখী সংসার। সমবয়সী স্ত্রী অনেকটা বন্ধুর মতো। অল্প বয়সে প্রেম করে বিয়ের পর জীবনের বাস্তবতায় নায়ক অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে খুব দ্রুত। সচ্ছল সংসারে দুটি ফুটফুটে মেধাবী পুত্র সন্তান এবং একটি রাজকন্যার মতো অপরূপা মেয়ে সন্তান নিয়ে নায়কের সুখী জীবন। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় সুন্দর বাড়ি, দামি গাড়ি এবং কাঁড়ি কাঁড়ি উপার্জনের স্বল্পসুখের মধ্যে নায়কের হঠাৎ করেই ভাব এলো_ তিনি নেতা হবেন, জননেতা।
দেশসেবা করে স্বর্গে যাবেন।
নায়কের সারা শরীরে এমনিতেই ভীষণ সুড়সুড়ি ছিল। নেতা হওয়ার পরিকল্পনা মাথায় আসতেই তার সুড়সুড়ি বেড়ে গেল বহুগুণে। নায়কের যে সুড়সুড়ির ভাব এসেছে এ কথা প্রচার হয়ে গেল এবং রাতারাতি পাত্রমিত্ররূপী রাজনৈতিক টাউট-বাটপাররা ভিড় করল নায়ককে কাতুকুতু দেওয়ার জন্য। সুড়সুড়িযুক্ত নায়ক এমনিতেই হাসির রাজা, তার ওপর আবার লোকজনের কাতুকুতু পেয়ে মনের আনন্দে হেসে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
নায়ক হাসে আর পকেট থেকে টাকার তোড়া বের করে বিলাতে থাকে। এভাবেই চলল বহুদিন। বহু চড়াই-উৎরাই, ঘটনা-দুর্ঘটনার পর নায়ক সত্যিই একদিন সংসদ সদস্য হয়ে গেল।
নায়কের দুটো মারাত্দক বদ অভ্যাস রয়েছে_ নিয়মিত লেখাপড়া এবং ধর্মমতে নৈতিক বিধান মেনে জীবন পরিচালনা করা। লেখাপড়ার মধ্যেও আবার দুটি খারাপ বিষয় রয়েছে।
একটি ইতিহাস চর্চা আর অন্যটি জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা। নায়কের দল রাষ্ট্র ক্ষমতায়। স্বভাবজাত কৃতজ্ঞ নায়ক সারা দিন দলীয় প্রধান এবং একই সঙ্গে সরকারপ্রধানের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করে। স্ত্রী ছেলেমেয়েদেরও দোয়া করতে বলে। নায়ক ব্যক্তিজীবনে প্রচুর লাজুক লজ্জাবতী মেয়েদের চেয়েও বেশি।
ফলে সে যার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় দিবারাত সময় গুজার করে জীবনে একবারের জন্যও স্বপ্রণোদিত হয়ে তার সামনে যেতে পারেনি।
নায়ক হঠাৎ করেই লক্ষ্য করল কিছু লোকের খারাপ কাজের দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর বর্তাল। জনগণ বানিয়ে বানিয়ে নানা কল্পকাহিনী প্রচার করতে থাকল। সরকারবিরোধীরা বাতাস দেওয়া শুরু করল। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সটান হয়ে উঠল।
পুঁচকে নায়ক ভাবল_ এ অবস্থায় একটাই করণীয়_ প্রধানমন্ত্রী এবং খারাপ লোকগুলোকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে হবে। লোকজনকে বুঝাতে হবে যে, যারা খারাপ কাজ করেছে তারা প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দল বা প্রধানমন্ত্রী এসব কিছুই জানে না। এতে দল ও প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ রক্ষা হবে_ যদিও পদ পদবিধারী কিছু লোকের ক্ষতি হবে। এটা অনেকটা অপারেশন বা অস্ত্রোপচার করে ক্যান্সার ফেলে দেওয়ার মতো।
যদি ক্যান্সার ফেলে দেওয়া না হয় তবে তা সারা শরীরে বিস্তার লাভ করে। এ কাজে নায়কের ঝুঁকি ছিল শতভাগ। কারণ প্রধানমন্ত্রী জানতেন না কোন নায়ক এসব করছে। অন্যদিকে যাদের বিরুদ্ধে সে একা লড়াই করছিল, তারা ছিল সবাই ঐক্যবদ্ধ। তারা এক সময় প্রধানমন্ত্রীকেও নায়কের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে ফেলে পরস্পর যোগসাজশে।
নায়ক সবই টের পাচ্ছিল। কিন্তু তার কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তার উদ্দেশ্য একটাই, যে কোনো মূল্যে প্রধানমন্ত্রীকে কলঙ্কমুক্ত রাখা এবং এ কাজে সে যতই সফলতা লাভ করতে থাকল; তার শত্রুরা ততই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নায়কের পতনের জন্য উঠেপড়ে লাগল। অবশেষে নায়ক ফাঁদে পড়ে জেলে গেল এমপি হওয়ার সাড়ে চার বছর পর। জেল থেকে বের হওয়ার পর নায়ক ভিন্ন এক দুনিয়ার ভিন্ন এক স্বাদ অনুভব করতে লাগল।
অত্যধিক ব্যস্ততায় সে বিগত দিনগুলোতে লক্ষ্যই করেনি যে প্রধানমন্ত্রী, দেশ, জাতি এবং দলের জন্য কাজ করতে গিয়ে নিজের অনেক সর্বনাশ করে ফেলেছে। চমৎকার সাজানো একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছে। শিশুপুত্রটি বালক হয়েছে। বালিকা কন্যাটি কিশোরী হয়েছে এবং কিশোর পুত্রটি যুবক হয়ে গেছে_ আর প্রিয়তমা স্ত্রী বার্ধক্যের পথে পা বাড়িয়েছে।
জেল থেকে বের হয়ে দেখল নায়কের মাথার ওপর তিনটি মামলা।
এর মধ্যে দুটি হয়েছে তার নির্বাচনী এলাকায়। একটি ছিনতাই আর অন্যটি লুটের মামলা। নায়ক তার ছোটভাই, ৭৫ বছর বয়স্ক শ্বশুর, শালা-সম্বন্ধিসহ পরিবারের প্রায় একশ লোক নিয়ে এক ব্যক্তির ৩০ হাজার টাকা ছিনতাই করেছে এবং অজপাড়াগাঁয়ের একটি দোকান লুট করেছে। নায়ক ওসিকে জিজ্ঞাসা করল কেন এই মিথ্যা মামলা। ওসি বলল_ উপরের নির্দেশ_ এসপি জানে।
এসপি বলল_ ডিআইজি জানে। ডিআইজি বলল মন্ত্রীর কথা। আর মন্ত্রী বলল প্রধানমন্ত্রীর কথা। নায়ক জীবনে এই প্রথমবারের মতো হৃদয়ের গভীর থেকে গভীরে বেদনা অনুভব করল। অভিমান করে কারও কাছে গেল না।
কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করল না; কেবল নিয়তি মেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকল।
এদিকে, নায়কের পরিবারের বেশির ভাগ লোক জেলে গেল। দিনের পর দিন পার হয় কোর্ট জামিন দেন না। বিধবা মা কাঁদে, স্ত্রী কাঁদে, শ্বশুর-শাশুড়ি কাঁদে। নায়ক লক্ষ্য করল তার পঞ্চম শ্রেণীপড়ুয়া ছেলেটি পরিবারের এই কষ্টের দিনে বাইরে খেলতে যায় না, বাসায় বসে থাকে মুখ গোমরা করে।
দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েটি হঠাৎ কেমন জানি চুপ হয়ে গেছে। তার মুখে ব্রণ উঠেছে। মনে হয় সারা রাত ঘুমায় না। আর বড় ছেলেটি যে কিনা এই বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবে সে একদম বাইরে যায় না। স্ত্রী নামাজ কালাম ও কোরআন তেলাওয়াতে মনোযোগী হয়ে উঠেছে।
সারা দিন তসবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এত কিছুর পরও নায়কের কোনো পরিবর্তন নেই। সে নিয়মিত ইতিহাস চর্চা করে আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের চুলচেরা মাপকাঠিতে রাহু, শনি ও বৃহস্পতির অবস্থান নির্ণয় করে। তার একটাই বক্তব্য, আমি যা করেছি তাতে আমি অবশ্যই পুরস্কৃত হব। এসব ঝামেলা খুবই সামান্য ও সীমিত সময়ের জন্য।
একদিন নায়ক জ্ঞানচর্চা করছে এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে স্ত্রী মহাশয়া এগিয়ে এলেন, বললেন শুনেছ! পুলিশ আব্বাকে তাড়া করছে! ৭৫ বছরের বৃদ্ধ মানুষ কতদিন পালিয়ে বেড়াবে। নায়ক উত্তর করল আমার কি করার আছে? স্ত্রী মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না। ২৯ বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম স্বামীর মুখের ওপর বলে দিলেন তুমি একটা হাদারাম আর রামছাগল।
স্ত্রীর কথায় নায়ক বেশ মজাই পেল। সে মনে মনে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাল।
তার মনে পড়ল ২৯ বছরের পুরনো কথা। ১৯৮৬ সালে নায়কের বিয়ের সময় তার প্রভাবশালী এবং ধনাঢ্য শ্বশুর বড়ই ঝামেলা করেছিল। বিয়ের পরও প্রায় একবছর নায়কের সঙ্গে কথা বলেননি শ্বশুরজি। আজ এত বছর পর জীবন সায়াহ্নে সেই লোকটি এখন ৭৫ বছরের বৃদ্ধ। মেয়ের জামাইয়ের জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দিনের পর দিন।
২৯ বছর আগে নায়কের ইচ্ছে হতো, ইস্ শ্বশুর যদি একটু বিপদে পড়তেন! না তিনি কোনো দিন বিপদে পড়েননি। আজ নায়কের কল্যাণে উঁচু হাতের ঈশারায় তিনি এখন বৃদ্ধ ফেরারি। আচ্ছা বলুন তো, উপরোক্ত কাহিনীটি অবলম্বন করে যদি একটি সিনেমা বানানো হয় আর তাতে আমি থাকব নায়ক এবং বিপরীতে থাকবেন বিদ্যাবালান কিংবা রানী মুখার্জি তবে কেমন হবে?
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।