আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।
দুর্বল শরীরে কোনক্রমে বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘর পর্যন্ত এসেই মকবুল সাহেব এই বিশ্রী বোঝা আর হাতে রাখতে চাইলেন না । সেখানেই ধুপ করে রাখলেন । গোটা চারেক গাজর মাটিতে গড়িয়ে পড়লো । উচ্চস্বরে টেলিভিশনে টক শোতে বকাবাজি চলছে , কেউই বাড়ির কর্তার তিরিক্ষি মেজাজে ভ্রুক্ষেপ করলোনা ।
শান্তা নিজের ঘর থেকে সবই শুনছিলো কিন্তু নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহে এতোটা বিচলিত হলে চলেনা । জন্মদাতার ক্রোধের কারণ , জননীর অপরিসীম সহ্যশক্তি এর সবের অংশ হবার পর থেকেই শান্তা আর বিচলিত নয় । টেলিভিশনের ঝলকানি , পত্র-পত্রিকার লোভনীয় জগত , বিলবোর্ডের সুশোভিত ছবির কোরাসে তাদের মতো অধিকাংশ মানুষ পরম তাচ্ছিল্যে মুখ ফিরিয়ে নেয় । নিতে হয় । ডেভেলপমেন্ট , গ্রোথ ইত্যাদি দিয়ে বোকার মতো আহ্লাদে মনুষ্যজীবনের ৫টির মৌলিক চাহিদার একটিও নিরুপণ করা সম্ভব নয় ।
শান্তার নিস্তরঙ্গ জীবনে বিগত আট মাসে যেই ঝড়ের আবির্ভাব সেটা কবে , কিভাবে নৌকার ভেতরে পানির আওয়াজকে অনুভব করার মতো স্তিমিত হবে সে বলতে পারেনা । সেই ঝড়ে শান্তা এমনই টালমাটাল যে ক্রমশই সে নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে । আজকেই অফিসে তুচ্ছ কারণে কলিগ শামসুলের সাথে যেই রুঢ় ব্যবহারটা করলো চিন্তা করে নিজেরই মাথা হেঁট হয়ে আসছে । লোকটা নেহায়েতই ভদ্রলোক বিধাতে সেভাবে রিএক্ট করেনি । কিন্তু তার নিজের কি আরো সাবমিসিভ থাকা উচিত না ? এক ঝড়ের কারণে অন্যদের সাথে আষাড়ের আকাশ হয়ে থাকবার কোন অর্থ হয়না ।
এদিকে বাইরের আকাশ দেখতে মন চাইলে দিনে প্রথমবারের মতো জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে অর্ধাকৃতির চাঁদটাকে দেখতে কেমন যেন ছবির বিষণ্ণ নায়কের মতো প্রাণহীন দেখাচ্ছে । এদিকে পাড়ার গুন্ডা ছেলেপুলেরা শিস বাজাতে বাজাতে যার যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে । দেখে মনে হচ্ছে নাইট শো সিনেমা দেখে ফিরলো । আকাশ দেখতে জানালা খুলেছিলো শান্তা । না দেখছে আকাশ না পারলো আচমকা চলে আসা বৃষ্টির ছাঁচ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে ।
সেই বৃষ্টিই ক্রমশ বাড়তে বাড়তে যখন হাতের উপর ঠান্ডা শিরশিরানি অনুভূতি এনে দিলো তখন হুশ ফিরে পেয়ে জানালাটা সশব্দেই বন্ধ করে দিলো । একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া একরাশ চিন্তা এসে অন্যসব চিন্তাকে নিমেষে প্রান্তিক করে দিলো । রাজধানীর রাজনীতি , হুমায়ূন আহমেদ , ইমদাদুল হক মিলনের সাহিত্য কেচ্ছা , শেয়ারবাজারের তড়িৎ পতন , রামগতিতে কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা , প্রেসক্লাবে পকেটমারকে গণপিটুনী , কাপাসিয়ায় ডাকাতি , দিনাজপুরে ২ গৃহবধূকে গলা টিপে হত্যা , ক্রিকেট দলের নির্লজ্জভাবে হেরে যাওয়া , প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস , এলাকা জুড়ে সেঁটে দেওয়া এমপি সলিমের প্রশংসা সংবলিত পোস্টার সবকিছুকেই একঘেঁয়ে জ্ঞান করে শান্তা তার মাথা থেকে সরিয়ে দিলো । ঘরে জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত বাবা আছে সেই এসব নিয়ে ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিক । তার এসব নিয়ে ভেবে কোন কাজ নেই ।
তার সামনে অগণিত অনাগত সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার অনিবার্যতা ।
সেই একরাশ চিন্তাগুলোকে মাথায় থিতু হবার সময় দিতে পারলোনা । ঘর খোলাই ছিলো । খালাতো বোন নাফিসা এসেই অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার জন্য রাখা শাড়ীটা কোথায় আছে সেটা শান্তাকে বের করে দিতে বললো । চুপচাপ ওয়ার্ড্রোব থেকে বের করে নাফিসার হাতে দিয়ে যখন পুনরায় শাকিলের শক্ত চোয়াল নিয়ে ভাবতে বসলো আচমকা অনুভব করলো তার কাছে আসলে নিঃশ্বাস নিতে পারে এমন কোনই অপশন নেই ।
হয়তো স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নিয়ে সুখী হবার প্রাণপণ ভান করে যাওয়া নয়তো বিনা দোষেই হৃদয়বৃত্তিক যাবজ্জীবনে প্রবেশ করা । ডিলেমাটা শান্তার কাছে কতোটা প্রাণতিষ্ঠানো অথচ শাকিলের একবারও মনে হলোনা ......
নাফিসা শান্তাকে শাড়ীটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে এমন সময়েই তীব্র ঝনঝনাতিতে বজ্রপাত তার সরব অস্তিত্বের জানান দিলো । এমন বজ্রপাতে নির্ঘাত গোটা তিনেক গৃহহীন মানুষ ইলেকট্রিকের তারের সাথে কোনভাবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে মৃত্যুবরণ করেছে । প্রতিষ্ঠিত কবি – সাহিত্যিকরা এই কাঠখোট্টা বজ্রপাতের মধ্যেই হয়তো নতুন দিনের আগমনের সংকেত দেখতে পেয়ে আবেগে থরথর করে কাঁপবে । তবে শান্তার বেলাতে উপরের কোনটিই হলোনা ।
বছর তিনেকের বড় নাফিসার কাছে তড়িৎ গতিতে ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতেই বললো “ শাকিলটা কিছুই বুঝলোনা রে । চিঠি লিখে জানিয়েছে হয় চাকরী নয় বিয়ে । কোন জায়গাতেই আশ্রয় হলোনা । “
সেই সময়ে শান্তা বাইরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলোনা । দেখতে পেলে জানতো ঠিক এমন বিজলী চমকানোর মধ্যেও তাদের পাড়ার বখাটে সেলিমটা মেকানিকের চাকরীর প্রথম মাস শেষে বেতনের টাকাটাকে নানাভাবে ভেজা থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে বাড়ি ফিরছে ।
অল্প কিছু পেটে দিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করে আগামীকাল সকালে বাপের জন্য একটা দামী কলম আর মায়ের জন্য একটা সেকেন্ড হ্যান্ড স্যুয়েটার কিনতে বের হবে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।