আমরা যে কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক বা কারও কোনো কাজ নিয়ে সমালোচনা করতে অনেক বেশি ভালোবাসি। অথচ ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া কোনো কাজ করতে প্রথমে এগিয়ে আসি না বা নিজের কাজের অন্যের সমালোচনাও পছন্দ করি না।
প্রায় সবাই বলছি বর্তমান সরকার বৃহৎ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে না অথচ সরকারের বিপক্ষে বৃহৎ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জনগণের সামনে নিজেকে দাঁড় করাচ্ছি না। উল্টা তথাকথিত জনগণের পক্ষ নিয়ে সন্ত্রাস করে সরকারের পতন করাতে চাচ্ছি যা হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে।
সরকার সদা পরিবর্তনশীল।
আজ পর্যন্ত কোনো শক্তিই পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রেই চিরস্থায়ীভাবে থাকতে পারেনি। হয়তো কোনো শক্তি কখনো কখনো দোর্দণ্ড প্রতাপে সব কিছুই তাদের করায়ত্ত করতে পেরেছে কিন্তু সময়ের স্রোতে একদিন তা ভেসে গেছে। কালের স্রোতে কেউই টিকে থাকতে পারেনি। সময় কাউকে ধরে রাখে না।
পরিবর্তন হবেই কিন্তু সেই পরিবর্তনে আমার ভূমিকার কৃতিত্ব আমার অবস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তনেই নির্ধারণ করে দেবে।
বিগত সময়ের বিএনপির সব কার্যক্রমের চুলচেরা বিশ্লেষণের মোট ফলাফল হলো বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান। বর্তমান অবস্থানে যারা সন্তুষ্ট তাদের কাছে পরিবর্তন আশা করা যতটা বোকামি ও কালক্ষেপণ ততটাই তাদের সঙ্গে বিতর্ক করাও। কালের প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বর্তমান বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতৃত্বে নেই। বিএনপি একটি বিশাল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি, যার রয়েছে বিশাল দেশপ্রেমিক ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ লাখ লাখ কর্মী, যারা সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দিকভ্রান্ত। বিএনপির সব স্তরের বিশেষ করে মূল নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতার সুযোগে প্রতিপক্ষ আজ অনেক বেশি সংগঠিত ও প্রতিষ্ঠিত, যা দিবালোকের মতো পরিষ্কার কিন্তু তা বিএনপির নেতা-নেত্রীদের চোখে পড়েছে বলে দৃশ্যমান নয়।
বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। দলের বর্তমান নেতারা তাদের পদ ও অবস্থান নিয়ে চরম সন্দিহান। ফলে তারা কোনো অবস্থায়ই দলের কোনো পরিবর্তন আনতে দেবে না এবং ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে বর্তমান চেয়ারপারসনেরও দলের নেতৃত্বের বর্তমান কাঠামোর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপি এখন একটি অসাধু মহলের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত এবং তাদেরই ওপরে রয়েছে মূল নেতৃত্বের পূর্ণ আশীর্বাদ। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান_ তাদের কাছে এখন নগদ পুঁজি ও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার ও ডিবেঞ্চার যা তারা যখন খুশি তখন ব্যবসার কাজে লাগাতে পারবে।
বর্তমান সরকার রাজনীতি করার কোনো সুযোগ পারতপক্ষে বেগম খালেদা জিয়াকে দেবে না। বর্তমানে সরকার যেভাবে মামলার ভয় দেখিয়ে এরশাদকে বাঁদর নাচ নাচাচ্ছে ঠিক একইভাবে না হলেও বাঘকে খাঁচায় পুরে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে অন্তত সেভাবে হলেও বেগম খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন মামলার ফাঁদে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করে রাখবে। দশ ট্রাক অস্ত্র ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে আজীবন তাড়িত করে বেড়াবে, যার পূর্ণ সুযোগ নেবে যাদের ব্যর্থতার কথা বেগম খালেদা জিয়া নিজেও বলতে পারেন না। বিএনপির বর্তমান দুর্বল দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের কাঠামো অবশ্যই বেগম খালেদা জিয়ার কোনো কাজে আসবে না, তারপরেও এই কুচক্রী বলয় ভাঙার ক্ষমতা বেগম খালেদা জিয়ার নেই। এটিই চরম বাস্তবতা।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী শক্তিকে বসে থাকলে চলবে না। সময়ের দাবিতে বিএনপিকে নতুন আঙ্গিকে সংগঠিত হতে হবে। ২০১৪ সালের বাস্তবতার নিরিখে দলের তথা জাতীয়তাবাদের স্বার্থে যা প্রয়োজন তাই করতে হবে। কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় এখন জাতীয়তাবাদীদের হাতে নেই। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে।
দলকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করে লড়াইয়ের পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। এই লড়াই সরকারের বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয়। এই লড়াই অস্তিত্বের, এই লড়াই আগ্রাসী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, এই লড়াই আমার সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার, এই লড়াই জাতির স্বাতন্ত্র্যের ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের। এই লড়াই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের আত্দপরিচয় টিকিয়ে রাখার চূড়ান্ত লড়াই। এই লড়াই কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়।
এই লড়াই সমগ্র জাতির, যার নেতৃত্ব ঐতিহাসিকভাবেই জাতীয়তাবাদী শক্তিকেই নিতে হবে। এই লড়াইয়ে ব্যক্তির কোনো অবস্থান নেই, থাকতে পারে না। অতীতে বহুবার ব্যক্তির লোভ-লালসার কাছে জাতির স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হয়েছে কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ব্যক্তির স্বার্থও রক্ষিত হয়নি।
জাতি আজ মহাসন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত করছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ আজকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে।
একে একে ধ্বংস করা হচ্ছে রাজনীতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, রীতিনীতি বা শিষ্টাচার। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব করা হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছায় জনধিকৃত ও প্রত্যাখ্যাত ব্যক্তিদের, রাজনীতিকে করা হচ্ছে ব্যবসায়িক পণ্য, রাষ্ট্রীয় পদে বসানো হচ্ছে চিহ্নিত লোভী ও চরিত্রহীনদের। ধ্বংস করা হচ্ছে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অর্থকে করা হচ্ছে সব কিছুর মানদণ্ড তথা সব কিছুর নিয়ামক শক্তি যেখানে মেধা ও যোগ্যতার কোনো মূল্য রাখা হয় না। আমরা সবাই যেন নীরব সাক্ষী গোপাল।
ব্যক্তির আদর্শ, বিশ্বাস, নীতি, মূল্যবোধ বা তার আবেদন, নিবেদন, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটক, সিনেমা, বক্তৃতা-বিবৃতি বা টকশোর বাঘা বাঘা বক্তব্য হয়তো জনমত সৃষ্টিতে প্রচণ্ডতম অবদান রাখে কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় না, যদি না জনগণ তাদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমে না আসে। গত ৫ বছরে জনগণ মাঠে নেমে আসেনি বা বলা যায় বিএনপি জনগণকে মাঠে নামাতে পারেনি। গত পাঁচ বছরে মাঠে না নামলেও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি মহাসুযোগ জনগণ পেয়েছিল কিন্তু বিএনপির রাজনীতির ভুল কৌশলের কারণে সেই সুযোগ পাঁচ বছরের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেছে। সরকার তার খেয়ালখুশিমতো আগামী পাঁচ বছর বৈধভাবেই রাষ্ট্র চালাবে তাতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা বর্তমানে বিএনপির নেই এবং আগামী পাঁচ বছরে হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন পাগলা ঘোড়াকে থামাতে হলে এখন জনগণকেই রাস্তায় নেমে আসতে হবে।
কিন্তু নেতৃত্ব ছাড়া জনগণ মাঠে নেমে আসবে কার কথায়?
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।