আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষার আধিপত্য ও প্রজন্মের ভাষাপ্রেম



ভাষার আধিপত্য ও প্রজন্মের ভাষাপ্রেম
ফকির ইলিয়াস
________________________________________________

বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা চালুর দাবি আমরা প্রায় চার দশক থেকেই শুনে আসছি। পূরণ কি হয়েছে? না, হয়নি। কারণ বাস্তবতা ভিন্ন। ভিন্ন আজকের বিশ্ব প্রেক্ষাপট।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিরিজ আয়োজিত এক সেমিনারের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল ভাষার অর্জন।

একটি ভাষা কী ফসল ফলাতে পারে সে বিষয়ে ভাষা বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখছিলেন। স্প্যানিশ ভাষা বিশেষজ্ঞ জিসান রডরিগাস তার বক্তব্যে তুলে ধরেছিলেন, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে স্প্যানিশ ভাষার অগ্রগতি ও আধিপত্যের কথা। তিনি স্প্যানিশ ভাষাভাষী ক’জন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, এরা স্প্যানিশ ভাষায়ই তাদের লেখাগুলো লিখেছিলেন। তাদের লেখার দক্ষতা, মুন্সিয়ানা, ভাবপ্রকাশ ও বিষয় নির্বাচন বিশ্বের বোদ্ধা পাঠককে সাড়া দিতে সক্ষম হয়। তারপর স্থান করে নেয় বিশ্বসাহিত্যে।

একটি লেখা যখন নিজ ভাষায় বিশ্ব মানবের পক্ষে বিশ্বভাষা হয়েই মাথা উঁচু করে তখনও গোটা মানবসমাজ তা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে পড়ে। একুশে ফেব্র“য়ারি এলে বাঙালিরা বাংলা ভাষার অর্জন, দেনাপাওনার হিসাবও মেলানোর চেষ্টা করেন। সন্দেহ নেই, ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করা হয়েছিল, তা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি রাষ্ট্র, একটি বৃহৎ জাতি বাংলাদেশ ও বাঙালি।
একটি রাষ্ট্রে একটি ভাষাই যে সবার মাতৃভাষা হবে, তারও শতভাগ নিশ্চয়তা নেই।

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষার দিকে নজর দিলে আমরা সে দৃষ্টান্ত পাব। আর বহুজাতিক-বহুভাষিক ‘মাল্টিকালচারাল কান্ট্রি’ বলে সুপরিচিত যুক্তরাষ্ট্র তো এর বড় উদাহরণ। ভাষার স্বীকৃতি দিতে গিয়ে নিউইয়র্কের বোর্ড অব এডুকেশন বাংলা ভাষাভাষী দোভাষীর ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন হেলথ ইনস্যুরেন্স হাসপাতালগুলো গর্বের সঙ্গে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে- ‘আমরা বাংলায় কথা বলি’। বাংলা ভাষার এই অর্জন প্রজন্মের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করছে এই বিদেশেও।


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভাষার সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। চীন এ সময়ে প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে বিশ্বের চারণভূমি। তাই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব শোরুম, নির্মাণ কারখানা তৈরি করছে চীনে। এজন্য এখন যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, কিংবা নিতে চাইছে তাদের জন্য চীনা ভাষা অপশনাল করা হয়েছে এবং অনেক নবিস ব্যবসায়ী নিজ ব্যবসা প্রসারের প্রয়োজনে জাপানি কিংবা চীনা ভাষা রপ্ত করে নিচ্ছেনও। লক্ষ্য একটিই, বিশ্বে ব্যবসার প্রসারকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা।

চীন, জাপান, হংকং, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎই তাদের ভাষা প্রসারে বিশ্বব্যাপী ভূমিকা রাখছে। দৃষ্টি কাড়ছে বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীদের।
ভাষা একটি রাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে গভীরভাবে। যে শিশু ওই রাষ্ট্রের ভাষার মর্ম মূলে পৌঁছতে পারে, তার লক্ষ্যের পরবর্তী ধাপটি হয় সে ভাষার সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোয় প্রথম থেকে পঞ্চম গ্রেডের ছাত্রছাত্রীদের একেকটি দেশের ওপর বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে ওই দেশ সম্পর্কে পুরো জ্ঞানদানে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

লক্ষ্য হচ্ছে, একজন মার্কিনি যাতে বড় হয়ে ওই রাষ্ট্র, ওই ভাষার সারটুকু আহরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারে।
দুই.
একটি রাষ্ট্রের ভাষা কি বদলে যায়? ভাষা কি আধুনিক হয়? এসব প্রশ্ন আমরা মাঝে মাঝেই দেখি। বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন প্রবণতা শুরু হয়েছে- ‘কবিতার ভাষা’। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী, লিটল ম্যাগাজিন ‘কবিতার ভাষা সংখ্যা’ প্রকাশ করছে মাঝে মাঝে। একটি ভাষায় অন্য ভাষার ঘনিষ্ঠ প্রভাব পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।

বাংলা ভাষায় অনেক ইংরেজি প্রতিশব্দ মিশে আছে, যা এখন আমরা বাংলা বলেই মনে করি।
ভাষার বদলে যাওয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সুইডিশ ভাষাবিজ্ঞানী এডলফ মেকিনসের ভাষ্য হচ্ছে, যেহেতু অক্ষর ও শব্দগুলো বদলায় না, অতএব মৌলিক ভাষা বদলাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যা বদলায় তা হচ্ছে বাক্য গঠনের ধরন। চিত্রকল্পের ব্যবহার এবং বাক্য প্রকরণের গতিবিন্যাস। যে কবি অনুপ্রাস কিংবা নেপথ্য চিত্রের আধুনিক বিন্যাস ঘটিয়ে কবিতা লিখছেন, তিনিই দাবি করছেন তিনি নতুন ভাষায় লিখছেন।

যদিও শুধু তার বলার ধরনটি বদলেছে। বাংলা সাহিত্যে বিদেশী গল্প, কবিতা, উপন্যাসের ছায়া অবলম্বন করে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটিকা রচিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, একটি অন্য ভাষার লেখা যখন পাঠকের মনে দাগ কাটে, তিনি যদি লেখক হন তবে তার পরবর্তী লেখায় এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে ভাষার বিবর্তনের আলো। অন্য ভাষার দূতিময় সারমর্মকে নিজ ভাষার পাঠকের জন্য তুলে আনাকে বৃহৎ সাহিত্য ভাণ্ডার তেমন দোষের কিছু বলে বিবেচনা করে না।


ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির একটি গৌরবময় অধ্যায়। কারণ একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি।
মাতৃগর্ভ থেকে যেমন সন্তানের জন্ম হয়, তেমনি এ দেশের জনজাতির মর্মস্থল থেকে বাংলা ভাষা উদ্ভূত হয়। সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় দেশের ভূমিজ সন্তানদের জীবনরস মন্থন করে বাংলা ভাষার জন্ম হয়, যা জাতির নিরলস চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে বিকশিত ও প্রসারিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় উন্নীত হয়েছে।
আঞ্চলিক প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে।

প্রাকৃতজনের তথা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাই প্রাকৃত ভাষা। ‘চর্যাপদ’ হল প্রত্নবাংলা বা আদি বাংলার নিদর্শন। প্রাকৃত ভাষা ক্রমে লোপ পায়, কিন্তু মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা টিকে থাকে।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, বাংলা ভাষা ভুঁইফোড়ের মতো হঠাৎ করে জন্মলাভ করেনি বা একে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়নি। এর মূল জাতীয় জীবনের গভীরে প্রোথিত।

শুধু ভূখণ্ড নয়, নৃতত্ত্ব-জাতিতত্ত্বের মতো ভাষাতত্ত্বের অনেক সম্পদ আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি।
আমাদের আজকের মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা সমগ্র জাতির শত-সহস্র বছরের সাধনার ফসল। তবে প্রশ্ন ওঠে, আমাদের মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার চলার পথ কি সরল-সুগম ছিল নাকি বন্ধুর-কণ্টকাকীর্ণ ছিল? এ কথা সবাই জানে, ভাষার জন্য বাঙালিকে অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে যখন জাতিসত্তার বিকাশ ঘটতে থাকে, তখন থেকেই একটা বৈরী পরিবেশের মধ্যে পড়তে হয় আমাদের। এখন প্রশ্ন হল, মাতৃভাষার এত বড় গৌরব ও অর্জনকে আমরা কি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি?
বাংলাদেশে গত দু’দশকে নামি-দামি বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটেছে।

বিশ্বের বর্তমান প্রবহমানতার নিরিখে ইংরেজি শিক্ষা অত্যাবশ্যক বলেই আমি মনে করি। কারণ ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী খুব সহজেই সমসাময়িক বিশ্বমান অর্জন করতে পারে। এর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। আর রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সম্পর্কে প্রথমে যে কথাটি আসে, রাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়া, দলিল-দস্তাবেজ এখনও যখন ব্রিটিশ শাসনের ছায়া নির্ভর, তখন শুধু ভাষা পরিবর্তনের কথা আসছে কেন? বদলালে তো আমূল বদলে দিতে হবে- পুরো দলিলপত্র, প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যাচ্ছে গোটা বিশ্বের ভাষা প্রকাশের দৃশ্যকল্প।

ছাপা বই প্রকাশনার পাশাপাশি এখন ইন্টারনেটে ই-বুক প্রকাশের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে পাঠকের তৃষ্ণাকে। এখন এক সঙ্গে একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পাঠক একই বই পড়তে পারছেন। মেধা ও মননের বিকাশে তাই ভাষার বিস্তার ঘটছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে যদি ভাষান্তরের মাধ্যমে বিশ্বের অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তবেই উপকৃত হতে পারে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা। শুধু ভাষার সৌন্দর্যই নয়, রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত সৌন্দর্য, স্থিতিশীলতা এবং শান্তির অব্যাহত ধারা বহাল থাকলে বাংলাদেশও হতে পারে বিশ্বের অন্যতম বিনিয়োগ, পর্যটন ও বাণিজ্যনগরী।

আর সে জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমি মনে করি, প্রজন্মকে ভাষাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হলে আগে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষার উজ্জ্বলতা দিতে হবে। সব বাধা সরিয়ে নিতে হবে। শুধু অর্জন নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তিই দিতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শান্তির নিবাস।


===========================================
দৈনিক যুগান্তর ॥ ঢাকা ॥ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ শনিবার



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.