আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতারা এলাকায় ধরাশায়ী

উপজেলা নির্বাচনে প্রভাবশালী মন্ত্রী ও দলের শীর্ষ নেতাদের এলাকায় শোচনীয়ভাবে পরাজয় হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের। মন্ত্রী-এমপিদের অহমিকা, দাম্ভিকতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পাঁচ বছরে সংগঠন না করা, কর্মীদের অবমূল্যায়নই এ পরাজয়ের মূল বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। ফলে জাতীয় নির্বাচনে জবাব না দিতে পারলেও দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নিয়েছেন ভোটাররা। তা ছাড়া ওই সব এলাকায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের ঠেকাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগই নেননি প্রভাবশালী নেতারা। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের ওপর আস্থা হারান নিজ দলের কর্মী-সমর্থকরাও।

বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীদের কাছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয়ে তার ইঙ্গিত মিলছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। ভবিষ্যতে সতর্ক না হলে আওয়ামী লীগ একই ধরনের বিপর্যয়ে পড়বে বলে মনে করেন তারা।

পরাজয়ে শীর্ষ নেতাদের প্রাথমিক মূল্যায়ন হলো_ মন্ত্রী ও দলের প্রভাবশালী নেতাদের এলাকায় দল সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ দলীয় ঐকমত্য না থাকা, জোটগতভাবে নির্বাচন না করতে পারা এবং বিদ্রোহী প্রার্থী থাকা। এগুলো যত দ্রুতনিরসন করা যাবে ততই আওয়ামী লীগের জন্য কল্যাণ হবে। বুধবার প্রথম ধাপে ৯৭ উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মাত্র ৩৪টিতে জয়ী হওয়ার ঘটনায় দলের হাইকমান্ড উদ্বিগ্ন।

গত নির্বাচনে এ ৯৭ উপজেলার ৬৭টিতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। পরাজয়ের কারণ নিয়ে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নির্বাচন নিয়ে নেতারা গণমাধ্যমে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ওই দিন রাতেই দলীয় ফোরামে পরাজয়ের কারণ নিয়ে আলোচনায় বসেন শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এরই মধ্যে পরাজয়ের কারণ জানতে চেয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন। এ ছাড়া সামনের পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচনে চলমান পরিস্থিতি উত্তরণে করণীয় নিয়েও নানা দিকনির্দেশনা দেন তিনি।

অবশ্য পরাজয়ের কারণ স্বীকার করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং জোটগতভাবে প্রার্থী ঠিক করতে না পারায় আমাদের সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় হয়েছে। তবে ভোট যা-ই হোক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে_ এটাই সরকারের সফলতা। ' সামনে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত চেয়ারম্যানদের এলাকায় প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল ইক ইনু, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম মাহমুদ আলী, সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান প্রমুখ।

খোদ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম শিমুলের কাছে হেরেছেন কর্নেল (অব.) ফারুক খানের পছন্দের প্রার্থী শ্যামলকান্তি বোস। অবশ্য সেখানে আওয়ামী লীগের আরেক বিদ্রোহী প্রার্থীও ছিলেন। গুটিকয় নেতার কাছে জিম্মি স্থানীয় আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা ক্ষোভ ও হতাশা থেকেই শ্যামলকান্তি বোসকে 'না' বলে দিয়েছেন। আশরাফুল আলম শিমুল গত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির সমর্থনে বিপুল ভোট পেয়ে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার বাবা ১৯৯১ ও '৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন।

জানা গেছে, জামালপুর সদরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজনকুমার চন্দ্রের পরাজয়ের কারণ হিসেবে দলীয় কোন্দলকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার পছন্দের প্রার্থী হলেও তৃণমূল আওয়ামী লীগের কাছে বিজনকুমার চন্দ্রের জনপ্রিয়তা ছিল শূন্যের কোঠায়। এর মধ্যে বিএনপি প্রার্থী ব্যক্তিগতভাবে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর আত্দীয়।

পাবনার সাঁথিয়ায় জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর সমর্থিত মঞ্জুরুল এলাহী। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন ও পরিবারতন্ত্রের কারণে টুকুকে লালকার্ড দিয়েছেন সর্বস্তরের ভোটাররা।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টুকুর ছেলের জাল ভোট দেওয়া নিয়ে সমালোচনার ঝড় ছিল দেশজুড়েই।

পাবনার আটঘরিয়ায় পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী শহিদুল ইসলাম রতন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর ছেলে। এলাকার নেতা-কর্মীদের জনপ্রিয়তার বাইরে গিয়ে আত্দীয়করণের কারণে নিজের ছেলেকে প্রার্থী করেন। এ ছাড়া সেখানে দলীয় কোন্দলও ছিল চরমে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের আসন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে।

এ ছাড়াও হাটহাজারী উপজেলায় চেয়ারম্যানসহ তিনটি পদের একটিও পায়নি ক্ষমতাসীন দলটি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলই পরাজয়ের মূল কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নিজ এলাকা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা। একই সংসদীয় আসনে দুই প্রভাবশালী নেতার বাড়ি হওয়ায় মনস্তাত্তি্বক দ্বন্দ্ব চলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। কেন্দ্রের চাপে জোটগতভাবে জাতীয় নির্বাচন করলেও উপজেলা নির্বাচনে পৃথক প্রার্থী দাঁড় করান তারা।

অন্যদিকে বিএনপির ছিল একক প্রার্থী। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। তাদের দুই প্রার্থীরই শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। হানিফের প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বর্তমান চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক আর ইনুর প্রার্থী ছিলেন জাসদ নেতা আবদুল আলীম স্বপন।

অন্যদিকে কুষ্টিয়া সদরে হানিফের সংসদীয় আসনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাকির হোসেনের পরাজয় হয়েছে।

এ উপজেলায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী প্রথমে প্রার্থী হলেও হানিফের মধ্যস্থতায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। কিন্তু তার সমর্থকরাও হানিফের প্রার্থীকে ভোট দেননি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্বাচনী এলাকা সিলেটের গোলাপগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমেদের পরাজয় হয়েছে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর কাছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থীও ছিলেন। মন্ত্রী তাদের সমঝোতায় নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন।

যে কারণে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর জয় নিশ্চিত হয়েছে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের সংসদীয় এলাকা নাটোরের সিংড়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শফিকুর রহমান পরাজিত হয়েছেন বিএনপির কাছে। সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন জাহিদুর রহমান ভোলা। প্রতিমন্ত্রী তাকে সমঝোতায় নিয়ে আসতে পারেননি। ফলে ভোলার কর্মী-সমর্থকরা পলকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

তাই অনেকটা সহজ জয় পান বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী। আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান এমপির নির্বাচনী এলাকা রংপুরের মিঠাপুকুরে জামায়াতের কাছে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ তিনটি পদেই ধরাশায়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মোতাহার আলী বলেন, ছয় বছর ধরে এমপি রয়েছেন আশিকুর রহমান। উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন জাকির হোসেন। তিনি ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন।

কিন্তু এমপি কোনো ব্যবস্থা নেননি। উপজেলা আওয়ামী লীগ 'জাকির লীগে' পরিণত হয়। তৃণমূলের সমর্থন না নিয়ে এমপি আশিক নিজের পছন্দের প্রার্থী জাকিরকেই আবারও উপজেলা চেয়ারম্যান পদে সমর্থন দেন। ফলে নেতা-কর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় এমপি হয়েও এলাকার কোনো উন্নয়ন না করে শুধু নিজের আখের গুছিয়েছেন আশিক।

যে কারণে জামায়াত এ এলাকায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম মাহমুদ আলীর সংসদীয় আসন দিনাজপুরের খানসামায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবুল হাতেমের পরাজয় ঘটেছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে। সেখানে আবু হাতেমকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করে জেলা আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মাহফুজুর রহমানকে সমর্থন দেয়। ১৪ দলের দুই প্রার্থী থাকায় অনেকটা ফাঁকা মাঠেই গোল দিয়েছে বিএনপি।

সেখানে সাবেক মন্ত্রী মাহমুদ আলী ও একই জেলায় বাড়ি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী স্বপন একক প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হন।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.