হৃদয়ের কাছে বুদ্ধির বাস ভাল কথা। কিন্তু মাঝে মঝে হৃদয়ের ওপর থেকে বুদ্ধির শাসন তুলে দিতে হয়, হৃদয়কে স্বাধীন করে দিতে হয়, মুক্ত করে দিতে হয়। স্বাধীন মুক্ত হৃদয়ের ধর্মকে সব সময় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই
জেমস রেনেল এর জন্ম কিন্ত সোনার চামচ মুখে দিয়ে হয়নি, ছোটবেলে থেকেই অপরিসীম কষ্ট সহ্য করে বড় হন। ৩ রা ডিসেম্বর ১৭৪২ সালে লন্ডনের ডেবন শহরের কাছে চাডলে গ্রামে রেনেলের জন্ম হয়। তার বাবা জন রেনেল চাকরি করতেন সেনাবাহিনীতে।
ছেলের জন্মের চার বৎসর পর এক যূদ্বে মারা যান। রেনেলের মা রেনেলকে রেখে অন্য জায়গায় বিয়ে করেন। অনাথ রেনেলকে মাণূষ করেন চাডলী গ্রামের গির্জার পাদ্রী গিলবার্ট ব্যারিংটন। ছোটকাল থেকেই মানচিত্র আকায় এক সহজাত দক্ষতা ছিল মাত্র ১২ বৎসর বয়সে চাডলে গ্রামের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র একে সবাইকে অবাক করে দেন।
১৭৫৬ সালে রেনেল জাহাজে নাবিক হিসাবে যোগ দেন।
যুদ্ব বিগ্রহ তখন খুব স্বভাবিক ব্যাপার। তাই মাত্র দু বছর বাদে ১৭৫৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে চেরবার্গের যুদ্ব এবং বাষ্টের যুদ্বে অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১৭৬০ সালে অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন হাইড পার্কারের অধীনে সমুদ্র জরিপের কাজ শিখতে থাকেন। ওই সময় তিনি ভারতের পন্ডিচেরি আসছিলেন, ১৭৬৩ সালে নেপচুন নামে এক জাহাজে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসেন, সে সময় বাংলার গভর্নরের সেক্রেটারি ছিলেন রেনেল এর বন্ধু, তার সুপারিশ এ তিনি বাংলার সার্ভেয়ার জেনারেল এর পদে যোগ দেন, কাজের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা, সার্ভের কাজ যেহেতু সেনাবাহিনীর অধীনে হত তাই রেনেলর চাকরি সেনা অধিদপ্তরের অধীনে Bengal Regiment এ হল। মাত্র তিন বৎসরে তিনি এমন দক্ষতা দেখালেন লর্ড ক্লাইভ তাকে ভারতে সার্ভেয়ার জেনারেল হিসাবে নিয়োগ দিলেন।
জেমস রেনাল বাংলাদেশের কাজ শুরু করেন ২১শে মার্চ ১৯৬৪, পরিস্থিতি মোটেও অনুকুলে না, চারিদিকে ডাকাতি ছাড়াও জলদস্যু, ফকির সন্ন্যাসী, সাপখোপা আর বাঘের অত্যাচারতো ছিলই। তার প্রতি নির্দেশ ছিল জলঙ্গী থেকে শুরু করে গঙ্গা (বর্তমানে পদ্মা) ও মেঘনার সঙ্গমস্থল পর্যন্ত দক্ষিন তীরে গোটা এলাকা জরীপ করতে হবে। এরপর বা দিকের তীর জরীপ করে তিনি ক্রমশ মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, আসাম পর্যন্ত গোট এলাকায় কাজ করেন। সঙ্গে লোক লস্কর অবশ্য ছিল কিন্ত জরীপের মূল যন্ত্র বলতে ছিল আদ্যিকালের পেরামবুলেটর (এখন এর বদলে এসেছে সাইক্লোমিটার) আর কম্পাস। রাতের আকাশে দিকনির্নয়ে সাহায্যকারী তারা।
২১শে মার্চ থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত তিনি জলঙ্গী থেকে শুরু করে দামোদর হয়ে কুষ্ঠিয়ার উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত ম্যাপ তৈরী করেন। ১লা জুন থেকে ১৭ই জুন পর্যন্ত কুষ্ঠিয়ার বাকী অংশ থেকে শুরু করে গুবিন্দপুর হয়ে চরবাঘাটা পর্যন্ত ম্যাপ আকা হয়ে গেল। আরো ৫ দিন মুকুন্দপুরের খালের ৭ মাইল অংশ আকা হল। বৃষ্টি শুরু হবার জন্য কাজ সাময়িক বন্ধ থাকার পর চরবাঘাট থেকে আবার কাজ শুরু করার পর অরিংবেড়ী খাল সহ বেতুরী পর্য্যন্ত মাপযোক করে ৮ই অক্টোবর বেতুরিতে ক্যম্প তৈরী করা হল, অক্টোবর আকা হল বেতুরি থেকে মুল্লেপাড়া পর্যন্ত গঙ্গার মানচিত্র। অক্টোবর মাসটা গেল মুল্লেপাড়া থেকে মনসুরাবাদ পর্যন্ত ম্যাপ আকতে, যার মধ্যে ছিল কর্তাখালি ও হেসিয়াগঞ্জ খাল।
এই মানচিত্রে বাঘের চলাচল পথও তিনি দেখিয়েছেন।
নভেম্বরের ৫ তারিখ পাচূর থেকে কাজ শুরু হল, গঙ্গানগর দ্বীপ, বুদারমন খাল থেকে হাবেলিগঞ্জ খাল হয়ে টিকিয়াদ্বীপ, বাকেরগঞ্জ খাল হয়ে কিস্তিমারিয়া, পর্যন্ত নদীর গতিপথ আকা হয়ে গেল, এই ম্যাপে দেখানো আছে দুটি বৌদ্ব মন্দির, এরপর কিস্তিমারিয়া থেকে সোনাপাড়া, চোরমদডাঙ্গা, মেহেন্দিগঞ্জ খাল হয়ে আসেকুর পর্যন্ত ধারা, সেখান থেকে কুমারখালি হয়ে মেঘনা নদীর ম্যাপ আকা হয়।
পরে তিনি মেহেন্দিগঞ্জ খাল থেকে মেঘনার শাখা ইছামতি, ধলেশ্বরী এবং ঢাকা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার মানচিত্র তৈরী করেন। ম্যাপের সংখ্যা ছিল ৫টি। এ গেল সামান্য কিছু কাজের বর্ননা।
পুরো লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।
জেমস রেনেল যেসব মানচিত্র একেছেন তার সম্পর্কে নিজেই লিখেগেছেন মোটামুটি চারভাগে ভাগ করা যায়। একস্যাকট সার্ভে বা নিখুত পরিমাপের ম্যাপ, কার্সারি সার্ভে, স্কেচ, সাধারন ম্যাপ বা জ়েনারেল ম্যাপ। স্বভাবিক কারনেই সব মানচিত্রে বিশুদ্বতার মাত্রা একরকম না। রেনেল মোট ১৬ টি ম্যাপ তৈরী করেছিলেন ক্ষেত্র সমীক্ষাকে ভিত্তি করে, এর মধ্যে ৩ টি হারিয়ে গেছে, বাকীগুলো লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে আছে্ রেনেলের নিজের ভাষায় বলতে গেলে স্কেল ৪”= সমুদ্রিক এক মাইল বা ম্যাপের ক্ষেত্রে এক ইঞ্চি = জমির ৫০০ গজ, এই মাপেই ম্যাপগুলো আকা হয়েছিল।
রেনেলের মানচিত্রের বৈশিষ্ট্য হল এতে যেসব নদী খাল, রাস্তা বা স্থান নাম বর্নিত আছে তা থেকে তৎকালীন অবস্থার একটা চিত্র পাওয়া যায়। রেনেল অনেক গূলো Index ম্যাপ ও তৈরি করেছেন। পুবে সিলেট থেকে পশ্চিমে বস্কার, উত্তরে হিমালয় থেকে শুরু করে দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর এই বিস্তৃত এলাকার তিনিই ছিলেন চিত্রকর। বাংলা বিহারের একটা Topographical ম্যাপ তিনি ওয়ারেন হেষ্টিংসকে এবং পালাশির যুদ্বের নকশা একে তিনি ক্লাইভকে উৎসর্গ করেন। ৫ ই এপ্রিল ১৭৭৭ সালে তিনি Major of Bengal Engineer পদে উন্নীত হয়ে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহন করেন।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ম্যাকপিসের থ্যাকারের আত্নীয় হ্যারো স্কুলের প্রধান শিক্ষক ডাঃ টমাস থ্যাকারের কন্যা যেন থ্যাকারকে ১৯৭২ সালে বিবাহ করেন, তাদের ২ পূত্র এক কন্যা সবাই বাবা মার শিক্ষাগুনে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন
জেমস রেনেলের মৃত্যু হয় ২৯ শে মার্চ ১৮৩০ সালে। মৃত্যুর পর সন্মানীয় এই মানুষটিকে ওয়েষ্ট মিনিষ্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়। পশ্চিম দরজার কাছে বসানো হয় তার আবক্ষ মুর্তি আর নামফলক।
তার “Bengal Atlas” সম্পর্কে পরবর্তি কালে এক সার্ভেয়ার জেনারেল G.F. Henry মন্তব্য করেন, “রেনেলের এদেশে কাজ করার ৭০ বছর পরও তার কাজের অর্ধাংশ ও সার্ভে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্বেও। না বাংলাদেশ তাকে কোন সন্মান জানায়নি, যার মানচিত্র অজস্র গবেষনার কাজে লাগে, এখনও লাগছে সেই মানুষটির নামে না আছে কোন রাস্তা না আছে কোন স্মৃতিচিহ্ন।
তার বিস্তৃত কর্মকান্ডের পূর্নাংগ জীবন কাহিনী ও চোখে পরেনা। কবে আমরা এই মহান মানুষটিকে শ্রদ্বা জানাব?
কারো যদি পুরানো মানচিত্রর ইতিহাস জানার সময় থাকে এখানে দেখুন
সুত্রঃ Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/James_Rennell
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।