বাংলাদেশে পেশাদার যাত্রাদলে পালা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ দেশে বহু বছর ধরে দুই ধরনের যাত্রাপালা চর্চিত হয়ে আসছে। একটি ঝুমুর যাত্রা অপরটি সংলাপপ্রধান যাত্রা। ঝুমুর যাত্রাকে প্রথমে ঘেটু, পরে লোকনাট্য বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। মূলত তা গীতাত্দক যাত্রার সংজ্ঞায় পড়ে। এই জাতীয় পালার রচক সবাই এই দেশের। অন্যদিকে সংলাপপ্রধান পালাকে সংলাপাত্দক পালা বলা হয়ে থাকে। এ পালার লেখক অধিকাংশই কলকাতার। বর্তমানে দেশে প্রতি বছর প্রায় অর্ধশতের উপরে সংলাপাত্দক যাত্রা দল তৈরি হয়ে থাকে। এর একটি দলে ১৫ থেকে ১৬টি করে পালা থাকে, তাতে অর্ধশতক যাত্রাদলে প্রচুর পালার প্রয়োজন হয়। মালিকরা প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন পালা সংগ্রহ করতে না পেরে পুরনো পালাই বিভিন্ন নাম দিয়ে চালিয়ে আসছে। অনুসন্ধানে অবশ্য পালা সংকটের দুটি কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। একটি কলকাতা থেকে নতুন নতুন পালা খুঁজে আনায় কষ্টসাধ্য, প্রচুর অর্থ ব্যয় ও কলকাতায় যাওয়া-আসা আইনি বাধ্য-বাধকতা। কেননা, কোনো যাত্রাদল, মালিক, ম্যানেজার, নির্দেশকের সে দেশে যাওয়ার পাসপোর্টই নেই। চোরাপথে, বেআইনিভাবে কেউ দু-একখানা পালা আনলেও কোনো কোনো সময় তা মালিকের পছন্দ হয় না, নির্দেশকও কষ্ট করতে চায় না, ম্যানেজার পালা নামাতে উৎসাহ দেন না। ফলে বর্তমানে ব্যতিক্রমী ছাড়া কোনো দলেই নতুন পালা নামানো হচ্ছে না। অপর কারণটি হচ্ছে এখন কোনো দলে রিহার্সেল বাড়ি থাকছে না। যে কারণে এ দেশের পালাকারদের পালা ও মালিকরা আসরে নামানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন না। যুগ যুগ ধরে একই পালা বিভিন্ন দলে ভিন্ন ভিন্ন নাম নিয়ে আসরে উপস্থাপিত হচ্ছে। দর্শক পালা নতুন নাম শুনে বিপুল উৎসাহ নিয়ে প্যান্ডেলে আসছে কিন্তু ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের হতাশ হয়ে। যাত্রা দেখা বহু দর্শকের সঙ্গে বিভিন্ন প্যান্ডেলে এই প্রতিবেদকের কথা হলে তারা জানান, ইদানীং যাত্রার আসরে চর্বিত চর্বণ দেখছি। যাত্রা পারিবারিক বিনোদন শিল্প আর থাকছে না। পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। যাত্রা যুগ যুগ ধরে আমাদের লোকায়ত জীবনকে উজ্জীবিত করে আসছে। সঠিক তথ্য পেঁৗছে দিচ্ছে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে শহর-বন্দরে পালা সংকটের কারণে বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য যাত্রাগান দিন দিন নৃত্যনির্ভর হয়ে পড়ছে। এমন একটি স্বর্ণসময় ছিল যাত্রার, যখন পালার নাম শুনে দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ত প্যান্ডেলে। পৌরাণিক সীতার বনবাস, ভক্তিমূলক সাধক, রামপ্রসাদ, জীবনীমূলক লালন ফকির, ঐতিহাসিক ঈশা খাঁ, সম্রাট শাহজাহান, বিপ্লবাত্দক ক্ষুদিরাম, বিনয়-বাদল-দীনেশ, সামাজিক মা মাটি মানুষ, মায়ের অাঁচল, সমাজ, একটি পয়সা সে সময়ের দর্শকপ্রিয় পালা। এ ছাড়াও সোহরাব-রুস্তম, বাঙালি, নাচমহল অশ্রু দিয়ে লেখা, ধর্মের বলি, গাঁয়ের মেয়ে, গরিবের মেয়ে, সোনাই দীঘি, রক্ত দিয়ে কিনলাম, ভাওয়াল সন্ন্যাসী ইত্যাদি। এ জাতীয় পালাগুলো সংলাপাত্দক। এসব পালায় প্রয়াত অমলেন্দু বিশ্বাস, তুষার দাসগুপ্ত, চিত্তপাল, মেহেবুব ইসলাম, স্বপন দেবনাথসহ বহুজনের অভিনয়ের নান্দনিক ছাপ সমঝদার দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে আছে। যাত্রাদলের পালা সংকট মাথায় রেখে যারা এ দেশে পালা লিখেছেন তারা হচ্ছেন মাস্টার সেকেন্দার আলী, আরশাদ আলী, অরুণ দাস, ননী চক্রবর্তী, চিত্ত পাল, এছাহাক আলী, পরিতোষ ব্রহ্মচারী, (এরা সবাই প্রয়াত), জালাল উদ্দীন, মতিউর রহমান, আবদুস সামাদ, রাখাল বিশ্বাস, কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, আনোয়ার হোসেন, মিলন কান্তি দে ও এমএ মজিদ প্রমুখ। তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন বাঙলার ঐতিহ্যবাহী এই নাট্যধারা আরও সম্প্রসারিত হোক।
লেখক : পালাকার, সংগঠক, অভিনেতা ও সাংবাদিক
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।