কাশিমপুর কারাগার থেকে নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) দণ্ডিত তিন জঙ্গিকে নিয়ে ময়মনসিংয়ের আদালতে যাওয়ার পথে আক্রান্ত হলো নীল রংয়ের একটি প্রিজন ভ্যান।
সিনেমার ঢঙে ছিনিয়ে নেয়া হলো মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামিকে।
ওই প্রিজন ভ্যানের সামনের সিটে ছিলেন এসআই হাবিবুর রহমান ও কনস্টেবল সোহেল রানা। গাড়ি চালাচ্ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল সবুজ।
পিছনে কয়েদিদের রাখার বাইরের অংশে ছিলেন কনস্টেবল আতিকুল ইসলাম (৩০)।
এসআই হাবিব জানান, হঠাৎ একটি ট্রাক ও কালো রংয়ের একটি মাইক্রোবাস প্রিজনভ্যানের সামনে ও পিছনে এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। এরপর সামনে থেকে প্রিজন ভ্যানে গুলি ও বোমা ছোড়া হয়।
“সামনের কাচ ছিদ্র হয়ে আমার শরীরে দুটি গুলি লাগে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তারপর আর কিছু মনে নেই।
”
চালক সবুজ বলেন, “গুলির শব্দে মাথা নিচু করে ফেলেছিলাম বলে বেঁচে যাই। তারপর সামনের মাইক্রোবাস থেকে মুখোশধারী হামলাকারীরা এসে চাবি ছিনিয়ে নেয়। ”
এরপর বোমা হামলা হয় ভ্যানের পিছনে। গুরুতর আহত হন সেখানে থাকা কনস্টেবল আতিক।
তালা ভেঙে ডাণ্ডাবেড়ি পরা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেএমবি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮)ও রাকিবুল হাসান এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মিজান ওরফে জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে (৩৫)নিয়ে নিজেদের গাড়িতে করে দ্রুত পালিয়ে যায় হামলাকারীরা।
সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি তিনি ত্রিশাল থানার ওসিকে জানান। তৎক্ষণে হামলাকারীরা প্রিজন ভ্যান থেকে আসামিদের বের করে গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
এরপর আহত পুলিশ সদস্যদের তিনি একটি গাড়িতে তুলে হাসপাতালে পাঠান।
পুলিশ সদস্যদের দুটি বন্দুক রাস্তা থেকে কুড়িয়ে অপেক্ষা করেন ওসির জন্য।
ত্রিশাল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, হাসপাতালে নেয়ার পথেই কনস্টেবল আতিক মারা যান। হাবিব ও সোহেল রানাকে ভর্তি করা হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ জানান, আসামি ছিনতাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ময়মনসিংহ ও আশপাশের জেলাগুলোতে ব্যাপক সতর্কতা নেয়া হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মাঠে নামেন।
সড়কে শুরু হয় তল্লাশি।
সখীপুর থানার ওসি মোখলেছুর রহমান জানান,বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পৌর এলাকায় প্রশিকা অফিসের কাছে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস বেপরোয়া গতিতে এসে একটি অটোরিকশাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়।
দুর্ঘটনার পর গাড়ির আরোহীরা পালিয়ে গেলেও আশপাশের লোকজন চালক মো.জাকারিয়াকে (২৮) আটক করে। এরপর পুলিশ এসে তার কাছে পায় একটি পিস্তল,পাঁচটি গুলি ও ছয়টি ককটেল।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহাফুজুল হক নুরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“জাকারিয়া ওরফে মিলনের বাড়ি চাঁপাইনবাবঞ্জে। চার বছর আগে সে জেল থেকে জামিনে ছাড়া পায়। তার বিরুদ্ধে জেএমবি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। সকালের ঘটনায় সে জড়িত ছিল বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। ”
এরইমধ্যে পলাতক জঙ্গিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে সীমান্তে জারি করা হয় রেড অ্যালার্ট।
রাজশাহী,চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত জেএমবি জঙ্গিরা থাকায় সতর্কতা বাড়ানো হয়। পলাতক তিন জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে দুই লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
এরপর প্রথম সাফল্য আসে বেলা আড়াইটার দিকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। সখীপুরের প্রশিকা অফিস থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে তক্তারচালা এলাকায় পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সন্দেহ হওয়ায় দুইজনকে আটক করে পুলিশে দেয় স্থানীয় জনতা।
“তার গলা,হাত ও পায়ে ডাণ্ডাবেড়ির দাগ ছিল। এর সঙ্গে সদ্য দাড়ি কামানো চেহারা দেখেই আমাদের সন্দেহ হয়। ”
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ জানান,গ্রেপ্তার রায়হানের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায়। তিনিও আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ময়মনসিংহ আদালত পুলিশের পরিদর্শক শহীদ ফোরকান জানান,মুক্তাগাছা থানার ২০০৬ সালের একটি বোমা হামলার এজাহারভুক্ত আসামি ওই তিন জঙ্গি। ওই মামলায় শুনানির জন্য রোববার সকালে তাদের কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে করে ময়মনসিংহে আদালতে নেয়া হচ্ছিল।
কাশিমপুর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এর জেলার আব্দুল কুদ্দুস জানান, জেএমবির শুরা সদস্য সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানির বিরুদ্ধে ৪০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটিতে তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার রফিকুল ইসলামের ছেলে সালাউদ্দিন সালেহীন ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে গ্রেপ্তার হন।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ ও সামরিক শাখার প্রধান মিজান ওরফে বোমারু মিজান ২০০৯ সালের ১৪ মে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় র্যাবের এক বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হন।
কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর সুপার মো.জাহাঙ্গীর কবির জানান, মিজান জামালপুর সদরের শেখের ভিটা এলাকার সুজা মিয়ার ছেলে। তার বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের আদালতে বোমা হামলার ঘটনায় তার ২৬ বছরের সাজা হয়। এছাড়া আরো চারটি মামলায় তার সাজার আদেশ হয়েছে।
জেএমবির আরেক শুরা সদস্য রাকিবুল জামালপুরের মেলান্দহ থানার বংশীবাড়ি গ্রামের আবদুস সোবাহানের ছেলে। ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
রাকিবুলের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলার মধ্যে একটিতে ফাঁসির আদেশ হয়েছে বলে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের সুপার আব্দুর রাজ্জাক জানান।
তিনি বলেন,এসব মামলার মধ্যে তিনটিতে রাকিবুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড,একটিতে ১৪ বছর ও একটিতে সাত বছরের দণ্ডাদেশ রয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক বোমা হামলা চালিয়ে সবার নজরে আসে উগ্রবাদী সংগঠন জেএমবি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণপশ্চিমের জেলাগুলোতে সর্বহারা পার্টি ও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির মতো চরমপন্থী সংগঠনগুলোকে দমাতে জেএমবিকে ব্যবহার করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো,যার মধ্য দিয়ে এ জঙ্গি গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেট থেকে গ্রেপ্তার হন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান। এর চার দিনের মাথায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে আরেক নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
২০০৫ সালে ঝালকাঠিতে জেলার সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করার মামলায় ২০০৭ সালের মার্চ ৩০ এই দুজনসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয়।
[ এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক লিটন হায়দার, নিজস্ব প্রতিবেদক কামাল তালুকদার, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম লিটন, গাজীপুর প্রতিনিধি আবুল হোসেন ও টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কে এস রহমান শফি।
]
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।