জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) তিব্বত হল উদ্ধারকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই শিক্ষক গুলিবিদ্ধসহ অন্তত আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে পুলিশ ও সাংবাদিকও রয়েছেন। আহতদের মিটফোর্ড সলিমুল্লাহ মেডিকেল হাসপাতাল, সুমনা ক্লিনিক, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর পুলিশের নির্বিচারের গুলি, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও লাঠিচার্জের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে জবি শিক্ষক সমিতি, নীল দল, সাদা দল ও কর্মকর্তা সমিতি।
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুনুর রশীদ ও কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মনিরুজ্জামানকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে ছাত্র-শিক্ষকদের সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সকাল ১০টায় জবি ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের দখলে থাকা তিব্বত হল (বর্তমানে গুলশান আরা সিটি) উদ্ধারে ঘেরাও এবং হলের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেদখল তিব্বতসহ জবির ১০টি হল উদ্ধারের দাবিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান তিন ফটকসহ রায়সাহেব বাজার ও নয়াবাজার মোড়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় গুলিস্তান-সদরঘাট রোডের সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর বাংলাবাজার মোড়ে পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর একটি মিছিল ওয়াইজঘাটে অবস্থিত তিব্বত হলের সামনে অবস্থান ধর্মঘট ও সমাবেশ করে। একপর্যায়ে বেলা সাড়ে ১১টায় শিক্ষার্থীদের সরাতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিক্ষার্থীদের লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে ওসি মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন কোতোয়ালি থানা পুলিশ এবং হাজী সেলিম সমর্থক ব্যবসায়ীরা। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়লে পাটুয়াটুলী ও ইসলামপুর রোড রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে কোতোয়ালি থানার ওসি, পাঁচ পুলিশ কনস্টেবল ও ছাত্রীসহ প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হন। পরে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকলে লালবাগ জোনের ডিসি হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় প্রায় শতাধিক টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে।
এ সময় পুলিশ বাংলাবাজার, বাহাদুরশাহ পার্ক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সদরঘাট শাখার অফিসের ছাদ থেকে ক্যাম্পাসের ভেতরের মুহুর্মুহু টিয়ার শেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ভবনের ছাদ থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় বাহাদুরশাহ পার্কসহ পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন, মাইক্রোবাইলোজি বিভাগের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ গুলিবিদ্ধ হন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শামীম রেজা, শাহ আলম, তোফাজ্জাল, সালমান, মাসুম, স্পন্দন, মাসুম, দ্বীপ, বিদোষ, রনি, সিরাজ, মিরাজ, প্রসেনজিৎ, আরজু, নুর মোহাম্মদ গুলিবিদ্ধসহ প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের স্থানীয় সুমনা ক্লিনিক, ন্যাশনাল মেডিকেল, মিটফোর্ড মেডিকেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে।
পরে শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আলী নুরের নেতৃত্বে একটি শিক্ষক প্রতিনিধি দল পুলিশের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করে এবং তাদের মধ্যস্থতায় ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে টায়ারে আগুন দিয়ে সড়ক অবরোধ করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান সেখানে অবস্থান নিলে হামলায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে তাকে গণধোলাই দেন বিক্ষুব্ধরা। এ ঘটনায় লালবাগ-ওয়ারি জোন পুলিশের যৌথ আক্রমণে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আবারও শুরু হয় দফায় দফায় সংঘর্ষ। বেলা পৌনে ৩টায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশে একাত্দতা জানাতে আসেন ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। এ সময় তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের হলে এই আন্দোলন যৌক্তিক।
তিব্বতসহ বেদখল সব হল উদ্ধার করে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৬৯-৭০-এর আন্দোলনে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার কাছে জগন্নাথের ছাত্র কখনো মাথা নত করেনি। এই আন্দোলনেও মাথা নত করব না। এ সময় তিব্বত হল উদ্ধারের ব্যাপারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানান তিনি। সমাবেশ থেকে আজ (সোমবার) ক্যাম্পাসে সকাল ১০টায় মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
বেলা সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্বিচারে লাঠিচার্জ, গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। এ সময় ডিসি হারুন ও ওসি মনিরুজ্জামানকে প্রত্যাহার করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজ সকাল ১০টায় কালো ব্যাচ ধারণ করে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের উদ্দেশে শোভাযাত্রা করবেন বলে জানায় জবি শিক্ষক সমিতি। এ ছাড়াও পৃথক পৃথক বিবৃতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার নিন্দা-প্রতিবাদ ও ডিসি হারুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল, বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল ও কর্মকর্তা সমিতি। এ ব্যাপারে লালবাগ জোনের ডিসি হারুনুর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, আমি সাত দিন ধরে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে আসছি।
আজ (রবিবার) তারা ব্যবসায়ীদের মার্কেট দখল করতে গিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালালে পুলিশও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।