আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিব্বত হলের সাত কাহন

জীবনটাকে জানতে চাই

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) তিব্বত হলের দখল নিয়ে ঢাকা-৭আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ হাজী সেলিম ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ পাল্টাপাল্টিচ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। হাজি সেলিম ও কম যাচ্ছেন না। তিনি বলেই দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্পত্তির মালিকানার পক্ষেকোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারলে সম্পত্তির দাবি ছেড়ে দেবেন। এদিকে শিক্ষার্থীরা যেকোনো মূল্যে হলের দখল নিতে মরিয়া। অন্যদিকে ভূমি মন্ত্রণালয় ০৯/০৭/২০০৯ তারিখেরভূঃমঃ/শা-৬/অর্পিত/বিবিধ/১৯/২০০৮/৪৬৪ সংখ্যক স্মারকমূলে উপর্যুক্ত ৫টিহল/হলের জায়গা (শহীদ আনোয়ার শফিক হল, শহীদ আজমল হোসেন হল, শহীদ শাহাবুদ্দিনহল, তিব্বত হল এবং ড. হাবিবুর রহমান হল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তরের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।

যার প্রেক্ষিতে ড. হাবিবুর রহমান হল সরকার ফেরত দেয়।

চলছে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি। হাজি সেলিম ২৯ অক্টোবর ২০১১ তারিখে এটিএন বাংলার ফলোআপ অনুষ্ঠানে বলছেন “তিনি ১৯৯১ সালে জায়গা কিনেন সাহাজাদি পারুল নামে এক মহিলার কাছ থেকে, কিন্তু আবার এখন বলছেন ২০০২ সালে খলিলুর রহমানের কাছ থেকে তিনি জায়গা কিনেছেন। আবার বলছেন জায়গাটি নাকি মৌলভি খাজা আব্দুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের কাছ থেকে ডেভলপার হয়ে মার্কেট তৈরি করেছেন। ২০০২ সালে মদিনাডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সঙ্গে ওই ট্রাস্টের বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ চুক্তিহওয়ার পর এখানে মার্কেট নির্মিত হয়েছে।

হাজী সেলিম আরও বলছেনজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাকে বলেছেন এই সম্পত্তির বিষয়ে তাদের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। এমনকিসরকারি নথিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ৯টি হলের নামের উল্লেখ রয়েছেসেখানেও তিব্বত হলের কোনো নাম নেই। শিক্ষার্থীরাও কম যাচ্ছেন না। তারা তাদের পক্ষে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন।

আসুন জেনে নেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিব্বত হল সম্পর্কে তথ্য এবং কে এই জায়গার প্রকৃত মালিক----

তিব্বত হলটির অবস্থান ঠিক আহসান মঞ্জিলের সামনে।

বিশাল জায়গা নিয়ে তিব্বত হলটির অবস্থান, হোল্ডিং নম্বর ৮ ও ৯ নং জিএল পার্থ লেন, ওয়াইজ ঘাট। হলটি ছিল দোতালা একটি প্রকাণ্ড ভবন। এই হলটিতে বা ছাত্রাবাসটিতে প্রায় ৪০০শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা ছিল। এর পূর্বে স্বাধীনতার সময় থেকে প্রায় ২ দশক এই হলটি “কুমারটুলি হল” নামে পরিচিত ছিল, মুলত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের জগন্নাথে আগমন উপলক্ষে তৎকালীন দুইটি হলের নামকরন করা হয় এরশাদের নামে। বর্তমান সামাজিক বিজ্ঞানভবন ও কলা ভবন যেখানে অবস্থিত সেখানে পূর্বে ছাত্রাবাস ছিল।

এরশাদের আগমন ও কুমারটুলি হলের কাগজপত্র হস্তান্তর করার উপলক্ষে সামাজিক বিজ্ঞানভবন ও কলা ভবনের জায়গার ছাত্রাবাসটির নাম দেয়া হয় “এরশাদ হল” এবং কুমারটুলি হলের নাম দেয়া হয় “সম্প্রসারিত এরশাদ হল”। কিন্তু ১৯৮৫ সালের দিকে যখন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার ছাত্ররাজনীতিবন্ধ করেন তখনই স্থানীয়দের সঙ্গে জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের কয়েকবারসংঘর্ষ হয়। তৎকালীন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষড. হাবিবুর রহমান সেখানে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। এতে কোনো কাজ হয়নি। বরং স্থানীয়রা হলের দোতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়।

তখন হাবিবুররহমান ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন। ঐ সংঘর্ষের সময় “তিব্বত” নামের এক ছাত্র গুরুতর আহত হন। মুলত তার নাম থেকেই হলটি মুখে মুখে পরিচিতি পায় “তিব্বত হল” নামে।

মূলত হল থেকে শিক্ষার্থীরা চলে গেলে হলটিতে রক্ষনাবেক্ষনের জন্য পুলিশ নিয়োজিত করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে পরে কলেজে একাধিক অধ্যক্ষ এলেও তিব্বতহলকে নিজ অধিভুক্ত করতে পারেননি।

পরবর্তীতে পুলিশরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে হলটিতে বসবাস শুরু করে। এরশাদের পতনের পর হলটি পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন দখলদারিত্ব কায়েম করেন। মূলত ২০০৯ সাল পর্যন্ত হলটি তিনি এবং পুলিশরা দখল করে রাখেন। তখন দোতলা ভবনটির নিচ তলায় ছিল একটি রিক্সা গ্যারেজ। ভবনের সামনে একটি সাইনবোর্ড টানানো ছিল আর তাতে লেখা ছিল ভবন ও জায়গার মালিক “আশরাফ আলি মৃধা”।



হাজী সেলিম মূলত হলটি দখল করেন ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে। ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারী হলের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে পুলিশরা হলটি ছেড়ে দেয়, এবং প্রায় অরক্ষিত হলটিতে হাজী সেলিম তার সন্ত্রাসি লেলিয়ে কমিশনার মোয়াজ্জাম হোসেন কে হটিয়ে জায়গা সহ হলটির দখল নেন। যা ঐ সময়ের প্রতিটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পায়।
হলের প্রকৃত মালিক কে??

মূলত এই জায়গা ও ভবনের প্রকৃত মালিক ছিলেন “শ্রী রাঁধা কুন্ডেশরী” নামে এক হিন্দু মহানুভব ব্যক্তি। তিনি ১৯৭১ সালে হলটিকে জগন্নাথ কলেজের কাছে দান করে ভারতে চলে যান।

পরবর্তীতে সরকার এই জায়গা রিকুইজিশন করে এবং এরশাদ সরকারের আমলে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হস্তান্তর করা হয়। যা ২০০৭ সালে মাসিহ মুহিত এন্ড কোং নামে একটি জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের জরিপে বেরিয়ে আসে। এবং সরকারের হিসাবে এখনো তিব্বত হলের জায়গা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে নথিভুক্ত হয়ে আছে।

হাজী সেলিমের গল্প-
হাজী সেলিম ২০০৯ সালে জায়গাটির দখল পাবার পর দ্রুত গতিতে মার্কেট নির্মাণের কাজে হাত দেন এবং প্রায় ৮ মাসের মধ্যেই গড়ে তোলেন গুলশান আরা সিটি নামে বিশাল এক মার্কেট। জায়গাটি তার নিজের নামে দেখাতে তিনি একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করেন।



প্রথম দিকে হাজি সেলিম ২৯ অক্টোবর ২০১১ তারিখে এটিএন বাংলার ফলোআপ অনুষ্ঠানে বলেন“তিনি ১৯৯১ সালে তিব্বত হলের জায়গাটি কিনেন সাহাজাদি পারুল নামে এক মহিলার কাছ থেকে। অন্য একটি দলিল থেকে”। কিন্তু তিনি এই সময় এটিএন নিউজ এর ক্যামেরার সামনে হাজির হননি। ফোনে তিনি প্রতিবেদক নাজিয়া আফরিন কে জানান এই তথ্য। কিন্তু অনুসন্ধানে তার এই গল্প মিথ্যা প্রমান হয়।

যা ২৯ অক্টোবর ২০১১ তারিখে এটিএন নিউজ এ প্রচারিত হয়।

পরবর্তীতে তিনি নতুন এক গল্প ফাদেন । তার এবারের গল্প কিছুটা ভিন্ন। এবার তিনি বলেন আদালতের মাধ্যমে মালিকানা প্রাপ্ত খলিলুর রহমান বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গাটি তার স্ত্রী ক্রয় করেছেন। এবং এই নামে একটি সাইনবোর্ডও টানিয়ে দেন।

বাস্তবে অনুসন্ধানে খলিলুর রহমান বিশ্বাস নামে কাউকে পাওয়া যায় নি। এবং তার এই গল্পও মিথ্যা প্রমানিত হয়।

আবার এখন তিনি বলছেন সম্পত্তিটি মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের। ২০০২ সালে মদিনাডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সঙ্গে ওই ট্রাস্টের বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ চুক্তিহওয়ার পর এখানে মার্কেট নির্মিত হয়েছে। হাজী সেলিম আরও বলছেনজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাকে বলেছেন এই সম্পত্তির বিষয়ে তাদের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।

এমনকিসরকারি নথিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ৯টি হলের নামের উল্লেখ রয়েছেসেখানেও তিব্বত হলের কোনো নাম নেই।

বাস্তবতা হল তিব্বত হলের কোন নাম কাগজপত্রে নেই তার কারন এই হলটি পরিচিত ছিল কুমারটুলি হল নামে তাই হাজী সেলিম তিব্বত নামটি কোথাও খুজে পাননি। আর এই সম্পত্তিটি বর্তমানে পরিত্তাক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের তালিকায় রয়েছে। আর হল বেদখল হবার পরে প্রশাসন আদালতে মামলা করে হলগুলি ফেরত পাবার জন্য। মামলা নং ১৩১/৯৫, ১৬১/৯৯ এবং টাইটেল স্যুট বিক্রি মামলা নং-৯৬/৬৫।

মামলা গুলোর রায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রয়েছে।

অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে যে কয়টি হল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তরের কথা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম তিব্বত হল। কারন ভূমি মন্ত্রণালয় ০৯/০৭/২০০৯ তারিখেরভূঃমঃ/শা-৬/অর্পিত/বিবিধ/১৯/২০০৮/৪৬৪ সংখ্যক স্মারকমূলে উপর্যুক্ত ৫টিহল/হলের জায়গা (শহীদ আনোয়ার শফিক হল, শহীদ আজমল হোসেন হল, শহীদ শাহাবুদ্দিনহল, তিব্বত হল এবং ড. হাবিবুর রহমান হল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তরের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে ড. হাবিবুর রহমান হল সরকার ফেরত দেয়। সুতরাং তিব্বত হল ফেরত পেতে কোন বাধা নেই।



সুতরাং হাজী সেলিমের বক্তব্য পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট এই ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই। শুধুমাত্র প্রশাসনের সদিচ্ছাই পারে তিব্বত হলটি হাজী সেলিমের মত মিথ্যুক পলটিবাজ ভূমিদস্যুর হাত থেকে উদ্ধার করতে। আর এর মাধ্যমেই পুরন হবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসনের সপ্ন।

(উৎসঃ ফেসবুকের জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পেজ)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।