এই অংশটা আমার কানাডা আসার পরের অংশ না , বাংলাদেশ থেকে আমার কানাডা আসার প্রক্রিয়ার বর্ণনা। তারপরও এই শিরোনামের মধ্যে রাখলাম যেহেতু এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমার কানাডার জীবন শুরু হয়।
বড় দুঃসময় ছিল তখন। বন্ধুরা সব একে একে বাইরে চলে যাচ্ছে। সময়ও চলে যাচ্ছে দ্রুত।
দেশে একেবারে খারাপ ছিলাম এরকম না। কিন্তু আশেপাশের সবার চলে যাওয়া দেখে ভাল লাগত না। পড়াশুনাটা আর চালিয়ে নিতে পারছিনা এই হতাশাও কাজ করত খুব। মাঝে কিছুদিন মাস্টার্স এ ক্লাস করেছিলাম। কিন্তু অনেক দিনের পরিচিত বন্ধু কাউকে সহপাঠী হিসেবে না পেয়ে এবং জুনিয়রদের সাথে ক্লাস করতে ভাল লাগত না বলে মাঝ পথেই ক্লাস করা বন্ধ করে দেই।
তার উপর চাকরী করে ঠিকমত পড়তে পারি না বলে ক্লাস এর কোন এসাইনমেন্টও ঠিকমত করতে পারি না। এভাবেই দেশে আমার মাস্টার্স এর খুব দ্রুত সমাপ্তি ঘটে। সব কিছু মিলিয়ে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে মাঝে মাঝেই খুব সন্দেহে ভুগতাম।
তারপর হটাৎ করেই একদিন GRE রেজিস্ট্রেশান করে ফেলি। লোকমুখে শুনে শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি GRE দেয়ার।
সবাই বলে বাইরে যাওয়ার প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে GRE দেয়া। তখনও ধারনা ছিল না GRE মূলত ইউএসএ যাওয়ার ক্ষেত্রেই লাগে। কানাডায় যাওয়ার জন্য অধিকাংশ ইউনিতেই GRE ম্যান্ডেটরী না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু GRE দিচ্ছি ইউএসএতে চেষ্টা তো করবই, সেই সাথে কানাডায়ও ২/১ যায়গায় করব যেহেতু আমার খুব ক্লোজ একটা ফ্রেন্ড আছে সেখানে। যাই হোক, GRE দেয়ার আগেই আমি আমার কানাডার ফ্রেন্ড এর ইউনিতে প্রথম অ্যাপ্লাই করে ফেলি।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম এখানে আমার হবে না যেহেতু ইউনির র্যাংকিং মোটামুটি ভাল- তারপরও ফ্রেন্ড এর কথায় এবং যেহেতু এখানে অ্যাপ্লাই করতে খরচ খুব কম তাই অ্যাপ্লাই করে ফেলি।
কানাডায় আরও ২/১ জায়গায় অ্যাপ্লাই করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু প্রথমত কানাডার ইউনিগুলা সম্পর্কে ভাল ধারণা না থাকায় এবং ইতিমধ্যে মোটামুটি মানের একটা GRE স্কোর থাকায় ইউএস এর দিকেই পুরো মনোযোগ দেই। কিন্তু ইউএসএতে এত এত ইউনিভার্সিটি, প্রথমত ইউনি সিলেক্ট করতে গিয়েই মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। যেহেতু খুব বেশি টাকা খরচ করার ইচ্ছা নাই, তাই হাতে গোনা কয়েকটা ইউনিতেই শুধু অ্যাপ্লাই করার ইচ্ছা।
তবে ইউএসএতে আমার দুই ফ্রেন্ড একই সময় অ্যাপ্লাই করছিল বলে তাদের সহায়তায় কিছু ইউনি সিলেক্ট করতে পারলাম। এর মধ্যেই আমার ইউএসএর এক ফ্রেন্ড জানায় ইউএসএতে তার ইউনিতেই আমার ভর্তি এবং ফান্ড মোটামুটি নিশ্চিত। সে তার প্রফকে মোটামুটি রাজি করিয়ে ফেলেছে, এখন শুধু তার প্রফ এর কাছ থেকে ফাইনাল ডকুমেন্ট গুলো পাওয়ার অপেক্ষা। তখনও আমার ধারণা ছিল না, ১০০% নিশ্চিত হওয়ার আগে কিছুই আসলে জগতে নিশ্চিত নয়। আর অ্যাডমিশন প্রসেস হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে অনিশ্চিত একটা প্রসেস।
অনেক ভাল ক্রেডেনশিয়াল নিয়েও অনেকে বাদ পড়ে যায় ডকুমেন্ট গত কিছু ভুলের কারণে, আর মোটামুটি ক্রেডেনশিয়াল নিয়েও অনেকে পার পেয়ে যায়। আসলে অ্যাডমিশন এর সময় একজন আবেদনকারীর যোগ্যতা নির্ধারিত হয় তার সব কিছু মিলিয়েই। রেজাল্ট এখানে খুব বড় একটা নির্ধারক, কিন্তু এটাই সব কিছু নয়। যাই হোক, বন্ধুর কাছ থেকে এরকম একটা নিশ্চয়তা পেয়ে আমিও আমার অ্যাপ্লাই প্রসেস মোটামুটি বন্ধ করে দিলাম। এক জায়গায় যদি হয়েই থাকে তাহলে আর শুধু শুধু অন্য জায়গায় টাকা এবং শ্রম খরচ করার দরকার কি- এই ছিল আমার মানসিকতা।
যেহেতু মধ্যম সারির ছাত্র ছিলাম, তাই অ্যাপ্লাই করার জন্য অপরিহার্য রিকমেন্ডেশন এর জন্য স্যারদের কাছে অপমানিত হওয়ার হাত থেকে নিজেকে পরিত্রাণ দিতে পেরে বেশ ভালই ছিলাম কয়টা দিন।
কিন্তু ভাল বেশিদিন থাকা যায় নি । একদিকে অ্যাপ্লাই করার সময় চলে যাচ্ছে অন্য দিকে ইউএসএ বাসী সেই ফ্রেন্ড এর প্রফ এর কাছ থেকে কোন ফাইনাল সাড়া শব্দ না পেয়ে ভয়াবহ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সেই ফ্রেন্ডও ফাইনাল কিছু বলতে পারে না।
কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু বলে, হয়ে যাবে চিন্তা কর না। শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন কিছু হল না, তখন আমি আবার প্রাণপনে অ্যাপ্লাই করার দিকে মনোযোগ দেই। কিন্তু অনেক ইউনির তখন ডেডলাইন শেষ, যেগুলা আছে সেগুলাতেও প্রফরা হয়ত স্টুডেন্ট বাছাই করে ফেলেছে। তারপরও দেশের সেই দুই ফ্রেন্ড এর সহায়তায় তাদের অ্যাপ্লাই করা কিছু ইউনিতে আমিও অ্যাপ্লাই করে ফেললাম। কিন্তু আমার তখনও জানা ছিল না আমেরিকা/কানাডায় (হয়ত বাকি বিশ্বেও তাই) গ্র্যাজুয়েট অ্যাপ্লিকেশান গুলা প্রসেস হয় সাধারণত ব্যাচ মোড এ।
মানে সব অ্যাপ্লিকেশান একবারে প্রসেস না করে, বরং কিছুদিন কিছুদিন পর পর এই পর্যন্ত আসা অ্যাপ্লিকেশান গুলো প্রসেস করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয় ডিপার্ট্মেন্টে। এই অ্যাপ্লিকেশান গুলোর মধ্য থেকে যদি ইউনির রিকয়ার্মেন্ট ফুলফিল করে এমন স্টুডেন্ট পাওয়া যায় , তাহলে তাদেরকে ফান্ড দিয়ে দেয়া হয়। এই কারণে আগে যারা অ্যাপ্লাই করে তারা সুবিধা পায়। আগের স্টুডেন্টদের দেয়ার পর যদি কিছু ফান্ড অবশিষ্ট থাকে, তাহলে পরের স্টুডেন্টদের বিবেচনা করা হয়। বাংলায় যাকে বলে 'আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তি'।
এই জন্য পরে অ্যাপ্লাই করলে আগের স্টুডেন্টদের থেকে অনেক বেটার স্টুডেন্টও ফান্ড পাওয়া থেকে বাদ পরে যেতে পারে । অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের শুধু এডমিশন দিয়ে ফেলে রাখা হয়। ভাগ্য ভাল থাকলে অনেকে এরপরও রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ ম্যানেজ করতে পারে। তবে আমার যেহেতু মোটামুটি মানের ক্রেডেনশিয়াল , তার উপর অ্যাপ্লাই করেছি দেরিতে, তাই আমার জন্য ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়ে যায়। তারপরও কোন উপায়ান্তর না দেখে মনে ক্ষীণ আশা রেখে অ্যাপ্লাই করে ফেলি।
অ্যাপ্লাই করার পরের সময়টা আমার কাছে মনে হয়েছে অ্যাপ্লাই করার সময়ের থেকেও ভয়ানক। একজন মানুষের ধৈর্য্যশক্তির চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে যায় এই সময়ে। রাতের বেলায় যতক্ষণ জেগে থাকতাম ততক্ষণ তো মেইল চেক করতামই, দিনেও যতক্ষণ অফিস থাকতাম সারাক্ষণই একটু পর পর চেক করতাম, যদিও জানি দিনের বেলায় ইউএসএ, কানাডা থেকে কোন মেইল আসার কথা না। আমার বউ বলত, তোমার মেইল আসলে কি সাথে সাথে না দেখলে মেইল হারিয়ে যাবে? আমি হাসতাম। এসময় অফিসের কাজের প্রতি আমার মনোযোগ পূরোপূরি উঠে যায়।
সারাক্ষণ বিভিন্ন ইউনির ওয়েবসাইট ঘাটতাম আর প্রফ খুজে বের করতাম যাকে মেইল করা যায়। মেইল এর টেমপ্লেটও অফিসে বসেই বানাতাম। রাতে বাসায় ফিরে ইউএসএ, কানাডায় দিন শুরু হওয়ার সাথে সাথে মেইল গুলো পাঠিয়ে দিতাম। আর সমানতালে চলত মেইল চেক করা। এভাবে পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করে যখন শুক্রবার রাতেও কোন মেইল এর দেখা পেতাম না, তখন তীব্র হতাশায় নুয়ে পড়ার মত অবস্থা হত।
শনি রবিবার ইউএসএ, কানাডার সব অফিসিয়াল কার্যক্রম বন্ধ থাকে। সপ্তাহের অন্যান্য দিন তাও কিছু সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু ওই দুই দিন কিছু হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। এই জন্য শনি রবিবারটা ভয়াবহ অস্থিরতায় কাটত।
এপ্রিল চলে আসে। এর মধ্যেই এক ইউনি থেকে মেইল আসে একটা।
কিন্তু মেইল খুলে যখন দেখি রিজেকশন মেইল তখন মনে হয় মেইল না আসাই তো ভাল ছিল। যদিও আমি মোটামুটি আগেই ধরে নিয়েছিলাম এই ইউনিতে আমার হবে না, তারপরও এইরকম মেইল পেয়ে হতাশার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এর মধ্যেই শুনি আমার এক ফ্রেন্ডকে ইউএসএর এক ইউনি থেকে ভর্তি এবং ফান্ড দুই টাই নিশ্চিত করেছে। এই ইউনিতে আমিও অ্যাপ্লাই করেছিলাম । কিন্তু আমাকে তখনও কিছু জানায় নি।
প্রথমবারের মত তখন দেরীতে অ্যাপ্লাই করার কুফল বুঝতে পারি। আমার ফ্রেন্ড যখন I-২০ এর জন্য অ্যাপ্লাই করছে আমি তখনও প্রতিদিনই অমানুষিকভাবে মেইল চেক করেই যাচ্ছি। দিনে দিনেই অস্থিরতা আরও বাড়তে থাকে।
ওইদিকে কানাডার ইউনি থেকেও কোন রেস্পপন্স না পেয়ে প্রফকে মেইল করার সিধান্ত নেই। আমার ফ্রেন্ড এর সাথে পরামর্শ করে মেইল দিয়ে দেই একটা।
মেইল করা শেষ করে প্রতি রাতের মত সেই রাতেও আমি আর আমার বউ নতুন একটা মুভি দেখা শুরু করি। ছবি দেখার মাঝখানেই আবার একবার মেইল চেক করার জন্য সাময়িক বিরতি নেই। মেইল খুলে দেখি প্রফ রিপ্লাই দিয়েছে এইভাবে,
প্রিয় হাসান,
তুমি খুব ভাল সময়ে মেইল করেছ। আমি আজকেই তোমার জন্য অফার লেটার ফাইনাল করে মেইল রেডি করছিলাম। তোমাকে আমরা ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট ফেলোশিপের জন্য মনোনয়ন করেছি।
এছাড়া, তুমি আমার সাথে রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করবে। এই জন্য তুমি বছরে পাবে এক্স পরিমাণ ডলার। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না, বউকে দিয়ে আবার মেইলটা পড়ালাম। অনেক দিনের জমানো হতাশা কেটে গিয়ে ফুরফুরে আনন্দ আর হাফ ছেঁড়ে বাচার অনুভূতি হল।
(চলবে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।