শিক্ষক ও উপকরণের অভাব, যথাযথ তদারকি না থাকা, দায়সারা গোছের শিক্ষা প্রদানসহ নানা সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। ১০ হাজারেরও বেশি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। গ্রামীণ পর্যায়ের স্কুলঘর জরাজীর্ণ আর শহুরে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। প্রয়োজনীয়-সংখ্যক শ্রেণীকক্ষ নেই। নেই চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সরকারদলীয় নেতাদের বেশুমার দাপট। স্কুলের জায়গা দখল করে ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন কেউ। কেউবা স্কুলের গাছ কেটে বানাচ্ছেন নিজ বাড়ির ফার্নিচার। 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান দিয়ে শ্রেণীকক্ষে ঢুকতেও বাধ্য করা হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।
২০১৩ শিক্ষাবর্ষের শেষ দুই মাসের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় শিক্ষাক্ষেত্র যে লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতির মুখে পড়ে, এর প্রধান শিকার হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা।
নতুন শিক্ষাবর্ষের তিন মাসেও সে ধকল সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। জেএসসি-জেডিসি, পিএসসি-ইবতেদায়ির ৫০ লাখ শিশুশিক্ষার্থীর ওপর পড়ে হরতাল-অবরোধের থাবা। দফায় দফায় পরীক্ষার সূচি পিছিয়ে অপ্রস্তুত করে তোলা হয় তাদের। এমনকি চলতি শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন স্কুলের ভর্তি-পরীক্ষার ক্ষেত্রেও বেহাল অবস্থার শিকার হয় খুদে শিক্ষার্থীরা। প্রধান শিক্ষকের পদশূন্য অবস্থায় দেশে পরিচালিত হচ্ছে ১০ হাজারেরও বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকরাই সাময়িকভাবে পালন করছেন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক প্রধান শিক্ষক অবসরে গেলেও সে তুলনায় নতুন শিক্ষকের যোগদানের হার খুবই সীমিত। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরও সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি দিয়ে প্রধান শিক্ষক করতে পারে না। পদোন্নতির এ অন্তরায়ের বিরুদ্ধে কিছু শিক্ষক সম্প্রতি আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছেন। অধিদফতর সূত্র জানায়, শর্ত অনুযায়ী শতকরা ৩৫ শতাংশ প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি এবং বাকিগুলো পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
অধিদফতর প্রধান শিক্ষক পদে কিছুসংখ্যক প্রার্থীকে সরাসরি নিয়োগ দিলেও মামলাজনিত কারণে তারা দায়িত্ব পাননি। প্রশাসনিক কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে প্রধান শিক্ষকশূন্য বেশির ভাগ বিদ্যালয়ের। নেই শিক্ষাদানের যথাযথ পরিবেশ। সাধারণ শিক্ষকরা 'ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক' হিসেবে দায়িত্ব পেলেও অদক্ষ পরিচালনায় সৃষ্টি করছেন লেজে-গোবরে পরিস্থিতি। প্রশাসনিক নানা জটিলতা বাধিয়ে প্রায়ই শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এমনকি বিদ্যালয়কেও নানা রকম ঝক্কির মধ্যে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। প্রতিবছরই প্রধান শিক্ষকের পদশূন্যতা বেড়েই চলেছে। ২০১৩ সালেও সারা দেশে শূন্য ছিল প্রধান শিক্ষকের ছয় হাজার পদ। কিন্তু ২০১৪ সালের প্রথম দুই মাসেই প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রধান শিক্ষক অবসরে গেছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চলতি সালের শেষ নাগাদ প্রধান শিক্ষকবিহীন বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে অধিদফতরের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।
এতে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বড় রকম বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিশ্চিত হচ্ছে না দরিদ্র শিশুর শিক্ষা : বৃত্তির পরিমাণ কম হওয়া এবং পারিবারিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় বৃত্তি কর্মসূচির উদ্দেশ্যও হচ্ছে ব্যাহত। এ ব্যাপারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছতে হলে সরকারকে আরও কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা বাড়াতে হবে বলে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ইউনিসেফ যৌথভাবে 'বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড : অ্যাচিভমেন্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
এতে আরও বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হলেও চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর বার্ষিক খাওয়া-খরচ ছাড়াও পারিবারিক ব্যয় দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৭৪৪ টাকা। আর শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পাচ্ছে প্রতিমাসে ১০০ টাকা। এ টাকাও খরচ হচ্ছে তাদের পারিবারিক চাহিদা মেটানোয়। ২০০২ সাল থেকে শুরু হওয়া এ বৃত্তি কর্মসূচিতে এ পর্যন্ত ৭৮ লাখ শিক্ষার্থীকে মাসিক ১০০ টাকা হারে বৃত্তি দিয়েছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করা উচিত শিক্ষাক্ষেত্রে।
শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শিক্ষায় বিনিয়োগের ব্যাপারে তৎপর থাকা উচিত। '
শিক্ষক অস্থির ঘুষের রেটে : ঘুষ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে কোনো কাজই হয় না। নানা নামে নানা রেটে ঘুষ নেন কর্মকর্তারা। শিক্ষকের এমপিওভুক্তির জন্য ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তনে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।
বদলি হতে বা বদলি ঠেকাতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। টাইম-স্কেলের জন্য পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। যে কোনো অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। অলিখিত এ ঘুষের রেট চলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে। কথিত আছে, মানুষ তো বটেই, অধিদফতরের চেয়ার, টেবিল, দরজা, জানালাও ঘুষের অপেক্ষায় থাকে।
একটি ফাইল যতগুলো টেবিলে ঘোরে, তত টেবিলেই লাগে নির্দিষ্ট অঙ্কের নগদ টাকা। প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের আগে পরিদর্শককে ঘুষ দিতে হয় ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। জীবনের বেশির ভাগ সময় শিক্ষকতার পেশায় কাটানোর পর পেনশনের কাগজপত্র প্রসেসিংয়েও দিতে হয় ঘুষ। পেনশন ফাইল নড়ে না ১৫-২০ হাজার টাকার নিচে। প্রতিটি ধাপেই টাকা আর টাকা।
টাকা হলেই নিয়ম তৈরি হয়, টাকা না হলে বৈধ কাজও আটকে পড়ে নানা আইনি বেড়াজালে।
খোলা মাঠে পাঠদান : ভোলার চরফ্যাশনের আছলামপুর ইউনিয়নের ২৪ নং আলীগাঁও প্রাইমারি স্কুলের পাঠদান বন্ধ হতে চলছে। ১৯৮২ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হলেও ভবন নির্মাণ হয় পঁচানব্বইয়ে। ১৮ বছরের মধেই জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে স্কুল ভবনটি। তাই সাভারে রানা প্লাজা ধসের পরপর অজানা আশঙ্কায় স্কুল ভবনটি পরিত্যক্ত করে দেয় উপজেলা শিক্ষা অফিস।
তখন থেকেই পাঠদানের কাজ চলছে স্কুলের খোলা মাঠে। শীতের ঠাণ্ডা আর গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে এভাবে শিক্ষাদান চললেও সামনের বর্ষায় পাঠদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্রামে আর কোনো স্কুল না থাকায় ২৬০ জন শিশুশিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। শুধু আলীগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ই নয়, সারা দেশে সাত শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলছে খোলা আকাশের নিচে কিংবা গাছতলায়। ঝুঁকিপূর্ণ পাকা ভবন কিংবা ভেঙে পড়া স্কুলগৃহের শিক্ষাদান চলছে এখানে-সেখানে।
স্কুল ঘিরে দখলবাজি : যশোরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক কোটি টাকার সম্পদ বছরের পর বছর বেদখল রয়েছে। প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবে এসব সম্পত্তি দখলকারীদের কব্জা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ না করায় ব্যাহত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। জানা যায়, কয়েক বছর ধরে জেলার ৬০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২১টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ৫০ একর জমি বেদখল রয়েছে। বেহাত হয়ে যাওয়া এসব জমির মূল্য কয়েক কোটি টাকা।
এর মধ্যে অনেক বিদ্যালয়ের জমি কব্জা করা হয়েছে ভুয়া দলিল তৈরির মাধ্যমে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা ১ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেও নেতা-নেত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোমিন উদ্দিন খান ও বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন মহিলা লীগের সভাপতি কাজী মাহেলা স্কুলটির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান দিয়ে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করেছেন। ওই দুই নেতা স্কুল-আঙিনার গাছগুলো কেটে নিয়ে নিজ বাড়ির ফার্নিচার তৈরি করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। এ ব্যাপারে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী কাজী মাহেলা বলেন, 'কেউ লিখিতভাবে আপত্তি করলে গাছগুলোর দাম দিয়ে দেব।
এখানে অভিযোগের কী আছে। ' ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার জগৎপুর-তালতলি নদীভাঙন এলাকায় তালতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রভাবশালী মহল সিএনজিচালিত ট্যাঙ্ িও রিকশাস্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে। সেখানেই বসানো হচ্ছে সাপ্তাহিক হাট। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভূমিতে দোকানঘর বানিয়ে বেদখল করারও অভিযোগ রয়েছে। খোদ রাজধানীতেও ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বহুমূল্যের জায়গা বেদখল হয়ে গেছে।
বিদ্যালয়ের জমিতে ভবন, ঘর ও দোকান নির্মাণ করে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। এসব জায়গা উদ্ধারে চলছে মামলা। চলছে দেনদরবার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শুধু বেদখলের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে কাপ্তানবাজার খোদাবঙ্ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
নাজিরাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০ শতাংশ জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। ১৯৯৬ সালে নিজস্ব জমিতে প্রতিষ্ঠিত মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস করতে হয়। স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণে বাধা দেয় পাশের কলোনি উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া বেদখল হয়ে গেছে ১৯৬ শতাংশ জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত শেরেবাংলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৩ শতাংশ জায়গা।
কামরাঙ্গীর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪২ শতাংশ জমির মধ্যে ১০ শতাংশই দখল হয়ে গেছে। ওয়ারীর এম এ আলীম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১১ শতাংশ জমির পাঁচ শতাংশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে পাঁচতলা ভবন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।